ভারতের অযোধ্যায় মোগল আমলে তৈরি একটি মসজিদের ইতি কথা ।। ইতহাসের পাতা থেকে
ভারতের অযোধ্যায় মোগল আমলে তৈরি একটি মসজিদের জমির মালিক কারা বিতর্কের নিষ্পত্তি করেছে সুপ্রীম কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ৯ নভেম্বর ২০১৯
নভেম্বর ২০১৯: সে জায়গাটিতে মন্দির তৈরির পক্ষেই চূড়ান্ত রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলা হয়েছে, অযোধ্যার বিতর্কিত জমি শর্তসাপেক্ষে দেওয়া হোক হিন্দুদের। মুসলিমদের মসজিদ তৈরির জন্য বিকল্প জমি দেওয়া হোক। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন,৩-৪ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে তৈরি করতে হবে ট্রাস্ট। সেই ট্রাস্ট ওই জমিতে মন্দির নির্মাণের জন্য রূপরেখা তৈরি করবে। আর অযোধ্যাতেই মসজিদের জন্য মুসলিম সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডকে দেওয়া হবে ৫ একর বিকল্প জমি।
ঐতিহাসিক রায় দিতে গিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আরও বলেছিলেন, ৯২ সালে মসজিদ ভাঙা বে–আইনি কাজ ছিল। বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মামলা চলছে লক্ষ্ণৌয়ের সিবিআই আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের এ পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট এ দিন রায়ে আরও বলেছেন, জমির স্বত্ব ধর্মীয় ভাবনার ভিত্তিতে দেওয়া যেতে পারে না। হিন্দুরা ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বাস করে, অযোধ্যা রামের জন্মভূমি। বিতর্কিত জমির বাইরের অংশের মালিকানা হিন্দুদের ছিল, তার প্রামাণ্য দলিল রয়েছে।
তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে ভারত জুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে স্বস্তির পাশাপাশি রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দেশের সরকার প্রধান থেকে আমজনতা সবার বক্তব্য উঠে এসেছে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
কট্টরপন্থী হিন্দুরা দাবি করেন বাবরি মসজিদের জায়গাতেই ভগবান রামের জন্ম হয়েছিল এবং একটি রামমন্দির ভেঙ্গে মোগল আমলে সেখানে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৯২ সালে কট্টর হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কমবেশি ২০০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল।
অযোধ্যা, ১৯৯২ সালের ছয়ই ডিসেম্বর। কয়েক লক্ষ হিন্দু ‘করসেবক’ সেদিন অযোধ্যায়। বেশ কয়েকজনকে দেখা গিয়েছিল বাবরি মসজিদের মাথায় উঠে পড়তে দেখা যায়।
সে সময় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বিবিসিকে বলছিলেন, এই মামলায় এখনও সাজার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ঠিকই – কিন্তু বাবরি ভাঙাটা যে বিরাট এক অপরাধ সেটা ভারতের বিচারবিভাগ অনেক আগেই মেনে নিয়েছে।
“১৯৯৪-এ ইসমাইল ফারুকি মামলাতেই কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙাটা একটা ‘ন্যাশনাল সিন’, মানে জাতীয় পর্যায়ের পাপ।”
“তখন আরও বলা হয়েছিল এখানে এমন একটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতটাকেই নড়িয়ে দিয়েছে।”
“এমন কী ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায়েও উল্লেখ করা হয়েছে, বাবরি ভাঙার মধ্যে দিয়ে আইনের শাসনের সাঙ্ঘাতিক একটা অবমাননা করা হয়েছে।”
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভিএইচপি ও বিজেপি ঐ স্থানে দেড় লাখ করসেবককে নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রা চলাকালে তারা সহিংস হয়ে পড়ে এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে মসজিদটি ভেঙে ফেলে।
“লাল কৃষ্ণ আডবাণী সেই সময়ে বক্তৃতা করছিলেন, মনে আছে। বাবরি মসজিদের মাথায় তখন বেশ কয়েকজন করসেবক উঠে পড়লেন। মঞ্চের মাইক থেকে কয়েকবার বলা হয়েছিল যে মসজিদের গম্বুজে পতাকা তোলা হয়ে গেছে, এবারে নেমে আসুন আপনারা,” ছয়ই ডিসেম্বর অযোধ্যায় হাজির থাকা প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন।
তার কথায়, “সেই আবেদন তো কেউ শোনেই নি, উল্টে আরও বহু মানুষ উঠে পড়তে লাগল মসজিদের গম্বুজে। একটা সময়ে মি. আডবাণী মঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেটাও মনে আছে। মুরলী মনোহর জোশীও মঞ্চে ছিলেন। তারপর তো সবাই জানেন যে কীভাবে মসজিদটি ভেঙ্গে পড়েছিল।”
রাম মন্দির আন্দোলনের আদি নেতা আডবাণী
বিজেপির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মি. আডবাণীর বয়স এখন ৯৬ বছর আর মুরলী মনোহর জোশী পরের বছর ৯০-তে পা দেবেন।
এঁরা দুজনে এবং তাদের সঙ্গে উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্ভরা, কল্যাণ সিং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংঘল, প্রবীণ তোগারিয়া এবং বজরং দলের বিনয় কাটিয়ার – এই কয়েকটি মুখই ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে রাম মন্দির আন্দোলনের সবথেকে পরিচিত চেহারা।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দুই নেতা ছাড়া বাকিরা প্রত্যেকেই বিজেপির হয়ে কেউ মুখ্যমন্ত্রী, কেউ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কেউ একাধিকবারের সংসদ সদস্য হয়েছেন।
লালকৃষ্ণ আডবাণী আশির দশকের শেষ দিকে রাম মন্দিরের পক্ষে জনসমর্থন জোটাতে গুজরাতের সোমনাথ থেকে সারা ভারত জুড়ে একটা রথযাত্রা করেছিলেন। সেই যাত্রা শেষ হয়েছিল অযোধ্যায় গিয়ে এক ‘করসেবা’র মধ্যে দিয়ে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সেই প্রথম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভাবনা ভারতের একটা বৃহৎ অংশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন মি আডবাণী-সহ বিজেপি নেতারা।
এরপরে ১৯৯২ সালেও করসেবার আয়োজন করে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। সেই সময়েই ধ্বংস হয় বাবরি মসজিদ।
কলকাতার প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রর কথায়, “লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার সময়ে অনেক জায়গাতেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছিল। আবার এটাও ঘটনা যে ছয়ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা প্রসঙ্গে তিনি নিজের আত্মজীবনীতে ওই দিনটিকে ‘জীবনের সবথেকে দুঃখের দিন’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।”
দিন দশেক পরই অযোধ্যায় রামমন্দিরের (Ram Mandir) উদ্বোধন। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে। আর ‘ঐতিহাসিক’ মুহূর্তটির সাক্ষী থাকতে সেখানে উপস্থিত থাকবেন গেরুয়া শিবিরের ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আডবাণী (LK Advani)। রামমন্দির আন্দোলনের পুরোধা তিনিই। যদিও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানালেন, ”রামমন্দির বিধির লিখন।”
তাঁর মতে, অযোধ্যায় রামমন্দির নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। আডবাণীর কথায়, ”ওই সময়ই (১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে, যে সময় ‘রথ যাত্রা’ করেছিলেন বিজেপি নেতা) আমি বুঝতে পারি নিয়তি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে একদিন অযোধ্যাতেই রামমন্দির হবে। পুরো বিষয়টাই ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা।