ভারতের চন্দ্রযানের পা দেওয়া ঘিরে উন্মাদনায় টগবগ করে ফুটছে ভারত।।চন্দ্রযানের সাফল্য কামনা করে আজমির শরিফে লখনউয়ে ইসলামিক সেন্টার অফ ইন্ডিয়ায় বিশেষ নমাজ ।। উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশের পরমার্থ নিকেতন ঘাটে জাতীয় পতাকা হাতে গঙ্গা আরতিতে অংশ নেন বহু সাধারণ মানুষ
আলাপচারিতা
ভারত ১৪ জুলাই ২০২৩ চাঁদের উদ্দেশ্যে তৃতীয় অভিযান শুরু করেছে। ভারতীয় সময় দুপুর ২টো ৩৫ মিনিটে অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে চাঁদের দিকে রওনা দিয়েছে চন্দ্রযান ৩। একটি এলভিএম-৩ রকেট দিয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে চন্দ্রযানটিকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
ছবি : ১৪ জুলাই ২০২৩ ভারতীয় সময় দুপুর ২.৩৫মিনিটে চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল চন্দ্রযান ৩
চন্দ্রাভিযানে থাকছে একটি ল্যাণ্ডার ও একটি রোভার। ল্যাণ্ডার চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবে আর রোভার চাঁদের মাটিতে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকবে।
ল্যাণ্ডারটি অগাস্টের ২৩ তারিখে চাঁদের পিঠে নামার কথা। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইয়ের নামে ল্যাণ্ডারটির নাম রাখা হয়েছে ‘বিক্রম’ আর রোভারটির নাম ‘প্রজ্ঞান’।
এই অভিযানে সফল হলে ভারত চতুর্থ দেশ হবে, যারা চাঁদের পিঠে পৌঁছবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন চাঁদে নামতে সফল হয়েছে।
আজ বুধবার ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের বুকে অবতরণ করবে দেশটির চন্দ্রযান-৩। চন্দ্রযানটির ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণের কথা রয়েছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তথ্য এখনো অজানা রয়েছে। চন্দ্রযান-৩ সফল হলে চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছাতে পারা প্রথম দেশ হবে ভারত।
উৎক্ষেপণের ৪০ দিন পরে চাঁদের মাটিতে নামার কথা ল্যাণ্ডার বিক্রমের। চন্দ্রযান ১ সময় নিয়েছিল ৭৭ দিন আর চন্দ্রযান ২ সময় নিয়েছিল ৪৮ দিন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাসার প্রথম মনুষ্যবাহী চন্দ্রযান অ্যাপোলো ১১ কিন্তু এর থেকে অনেক কম সময়ে, মাত্র চার দিনেই চাঁদের পৌঁছিয়ে গিয়েছিল।
অ্যাপোলোর তিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্সকে নিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসেন উৎক্ষেপণের আট দিনের মাথায়।
যে দূরত্ব ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ পেরতে পেরেছিল চারদিনে, সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে ২০২৩ সালেও কেন ৪০ দিন সময় লাগছে?
বৈজ্ঞানিকরা বলছেন এর পিছনে মূল কারণ জ্বালানির ওজনের তারতম্য।
জ্বালানি সহ অ্যাপোলো ১১ ওজন ছিল প্রায় ২৮০০ টন, কিন্তু ইসরো যে রকেট উৎক্ষেপণ করবে তার ওজন জ্বালানি সহ ৬৪০ টন। অ্যাপোলো ১১র মোট ওজনের ৮০ শতাংশই ছিল জ্বালানি।
অ্যাপোলোর ল্যাণ্ডার ঈগল চাঁদে অবতরণ করার পরে, গবেষণা করে এবং ল্যান্ডার অরবিটারে ফিরে আসা এবং শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসতেই ওই পরিমাণ জ্বালানির দরকার ছিল।
আর ইসরো চেষ্টা করছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে কম পরিমাণ জ্বালানি খরচ করে চাঁদে পৌঁছনর।
এই পদ্ধতিতে, রকেটটি সরাসরি চাঁদের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে এটি একটি দীর্ঘ বৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে তারপরে ধীরে ধীরে চাঁদের দিকে এগোবে আর শেষে অবতরণ করবে।
সেই জন্যই অ্যাপোলো ১১ এর তুলনায় প্রায় দশগুণ সময় বেশি নেবে চন্দ্রযান ৩।
আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে
আজ সন্ধ্যা ৬টা ৪মিনিট। ভারতের দেড়শো কোটি জনসংখ্যার সম্মিলিত প্রতীক্ষা করছে সন্ধ্যার সেই মহার্ঘ প্রহরের জন্য। সেই সময়ই চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে চন্দ্রযান ৩। আর অধীর অপেক্ষায় থাকা দেশবাসী উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। তর আর সইছে না।
চরকাকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা মহাত্মা গান্ধীর দেশের চন্দ্রযান স্পর্শ করতে চলেছে চরকাবুড়ির দেশের মাটি। মহার্ঘ সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় কোটি কোটি দেশবাসী। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে, বিজ্ঞানের অনবদ্য প্রয়োগ, চন্দ্রযানের চূড়ান্ত সাফল্যের কামনায় যাগযজ্ঞ, নমাজ, বিশেষ পুজো থেকে শুরু করে স্কুলে স্কুলে লাইভ অবতরণ দেখানোর প্রক্রিয়া। মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারতের এমন রাজসিক পদচারণার প্রাক্মুহূর্তে তাই উত্তেজনা আর বাঁধ মানছে না।বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমাজমাধ্যমের নিজস্ব হ্যান্ডলে সমস্ত বিভেদ ভুলে দেশবাসীকে একসঙ্গে চন্দ্রযানের সাফল্য কামনার আবেদন জানিয়েছেন। ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছেন, রাজ্যের সমস্ত সরকারি স্কুলে চন্দ্রযানের চন্দ্রাবতরণ সরাসরি দেখানো হবে। পড়ুয়ারা যাতে সাক্ষী থাকতে পারে এই অনবদ্য ঘটনার।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে জানিয়েছেন, রাজ্যবাসীকে নিয়ে তিনিও চন্দ্রযানের চন্দ্রে অবতরণকে উদ্যাপন করবেন।
এ তো গেল রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের কথা। সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মাদনা যেন আরও কয়েক পর্দা বেশি। আজমির শরিফের পাশাপাশি লখনউয়ে ইসলামিক সেন্টার অফ ইন্ডিয়ায় আয়োজন করা হয়েছিল বিশেষ নমাজের। সেখানে বহু মানুষ চন্দ্রযানের সাফল্য কামনা করেন।
মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে বিশেষ ভস্ম আরতির আয়োজন করা হয়েছিল।উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশের পরমার্থ নিকেতন ঘাটে জাতীয় পতাকা হাতে গঙ্গা আরতিতে অংশ নেন বহু সাধারণ মানুষ।
অভিনেতা অনুপম খেরও সমান উত্তেজিত। নিজের সমাজমাধ্যমের হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন সে কথা। জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধ্যা ঠিক ৬টা বেজে ৪মিনিটে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে চন্দ্রযানের ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’ উপভোগ করবেন তিনি।
বাংলার বিভিন্ন জায়গাতেও চন্দ্রযানের অবতরণ ঘিরে উন্মাদনা ভরপুর। আসানসোলে চন্দ্র অভিযানে ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাফল্য কামনায় মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে মণ্ডপ বেঁধে মন্দিরের সামনে হোমযজ্ঞ অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চাঁদের মাটিতে ভারতের চন্দ্রযানের পা দেওয়া ঘিরে উন্মাদনায় টগবগ করে ফুটছে দেশ।
তথ্যসূত্র: বিবিসিবাংলা, আনন্দবাজারপত্রিকা