ভারতের ঝাড়খণ্ডে ব্রাজিল-স্প্যানিশ দ্বৈত নাগরিক এক নারী পর্যটককে গণধর্ষণ ।। দেশজুড়ে ঘটনার প্রতিবাদ
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ব্রাজিল-স্প্যানিশ দ্বৈত নাগরিক এক নারী পর্যটককে গণধর্ষণের অভিযোগে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মোটরবাইক সফরে আসা ২৮ বছরের ওই নারী ও তাঁর স্বামী ঝাড়খণ্ডের দুমকায় রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন গত শুক্রবার।
সেই সময় সাতজন যুবক তাদের তাবুতে আক্রমণ চালায় এবং ওই নারীকে গণধর্ষণ করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তাকে এবং তার স্বামীকে মারধোরও করা হয় বলে জানিয়েছে ওই যুগল। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বাকিদের খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ।
ডেপুটি কমিশনার অঞ্জনেউলু ডোড্ডে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আমরা একটি দ্রুত তদন্ত করেছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে, আমরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমরা দ্রুত বিচারের জন্য চেষ্টা করব।”
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সোরেন ঘটনাটির নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “পুলিশ ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। অভিযুক্তরা দ্রুত শাস্তি পাবে।”
ঝাড়খণ্ড হাই কোর্ট এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছে।
গণধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সরব হয়েছেন সমাজকর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা।
সমাজকর্মী শবনম হাসমি বলেন, “নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। ওই দম্পতি এর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন, এবং ভারতে এসে তাদের এ জাতীয় ভয়ঙ্কর ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে, এটা খুবই দুঃখজনক।”
‘বিশেষ কিছু লুঠ করেনি, ওরা আমাকে ধর্ষণই করতে চেয়েছিল’
ওই পর্যটক যুগল বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছা নিয়ে ইতিমধ্য ৬৩টি দেশ ঘুরেছেন। ভারতে এসেছিলেন সেই ইচ্ছা নিয়েই।
গত কয়েক মাস ধরে কাশ্মীর, উত্তর প্রদেশসহ একাধিক রাজ্যে ভ্রমণ করেছেন। ঝাড়খণ্ড থেকে বিহার হয়ে নেপালে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। গত শুক্রবার রাতে ঝাড়খণ্ডের হাঁসডিহা গ্রামের কাছে একটি নির্জন এলাকায় তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। সেই সময় তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয় বলে অভিযোগ।
ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সমাজ মাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেন ওই পর্যটক দম্পতি।
ওই পোস্টে তিনি বলেছিলেন, “সাতজন মিলে আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমাদের মারধর করেছে, ছিনতাই করেছে, যদিও বেশি কিছু নেয়নি ওরা। কারণ ওরা আমাকে ধর্ষণই করতে চেয়েছিল।”
তাদের ব্যাপক মারধোর করা হয় এবং মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ জানিয়েছেন।
ওই নারীর স্বামীও একটি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “আমার মুখ নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু আমার সঙ্গীর পরিস্থিতি আমার চেয়েও বেশি খারাপ। ওরা (অভিযুক্তরা) আমার মাথায় হেলমেট দিয়ে আঘাত করেছে, পাথর দিয়েও মেরেছে। সৌভাগ্যক্রমে ও (নির্যাতিতা নারী) জ্যাকেট পরেছিল, যার ফলে আঘাতের তীব্রতা কিছুটা কম।”
এই ভিডিওগুলি অবশ্য পরে মুছে ফেলেন ওই দম্পতি এবং জানান, পুলিশি তদন্তে যাতে কোনও প্রভাব না পড়ে, তাই এই সিদ্ধান্ত।
দুমকার পুলিশ সুপার পীতাম্বর সিং খেরওয়ার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই দম্পতি টহলরত একটি পুলিশ ভ্যানকে থামিয়ে ঘটনার কথা জানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ভাষা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
তবে টহলরত পুলিশকর্মীরা বুঝতে পারেন যে ওই বিদেশী দম্পতি আহত। তাদের ওই ভ্যানে করেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
মি সিং সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ওই দম্পতি ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষার মিশ্রণে কথা বলছিলেন, তাই টহলদারি দল প্রথমে তাদের কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ওই পর্যটকেরা আহত বুঝতে পারায় তাদের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।”
পরে, চিকিৎসকের কাছে গণধর্ষণের বিষয়টি জানান ওই দম্পতি।
‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে’
এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছে ঝাড়খণ্ড হাই কোর্ট।
উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শ্রী চন্দ্রশেখর এবং বিচারপতি নবনীত কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে এ জাতীয় ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
ডিভিশন বেঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “বিদেশী নাগরিকের উপর ঘটা যে কোনও ধরনের অপরাধের ঘটনা গুরুতর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যার প্রভাব দেশের পর্যটন অর্থনীতিতেও পড়তে পারে। একজন বিদেশী নারীর উপর যৌন হিংসার ঘটনা দেশের নেতিবাচক প্রচার করে এবং এর ফলে সারা বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।”
হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ একজন বিদেশির বিরুদ্ধে অপরাধের গুরুত্ব পর্যবেক্ষণ করে সিনিয়র অ্যাডভোকেট রিতু কুমারকে অ্যামিকাস কিউরি বা আদালত বন্ধু হিসাবে নিয়োগ করেছে। আগামী ৭ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজিপি ও এসপিকে নোটিস পাঠিয়েছে আদালত।
অন্যদিকে, দুমকার প্রিন্সিপাল ডিস্ট্রিক্ট জজ তথা ডিস্ট্রিক্ট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটির চেয়ারম্যান অনিল কুমার মিশ্র দুমকায় নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তার রিপোর্টে জানিয়েছেন, তদন্ত চলাকালীন ওই নারীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অধীনে ওই নারীর গোপন জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তরফে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
মি মিশ্র তার রিপোর্টে বলেছেন, “(আমরা) তাঁদের আশ্বস্ত করেছি যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্যায়কারীদের গ্রেফতার করে বিচার করা হবে। ওই নারী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তবে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। তার শারীরিক পরীক্ষা হয়েছে।”
দেশজুড়ে ঘটনার প্রতিবাদ
ভারতে ব্রাজিলের দূতাবাস বিবিসিকে জানিয়েছে, ওই নারী ও তার স্বামী ‘গুরুতর অপরাধমূলক হামলার শিকার’ হয়েছেন। দূতাবাসের তরফে জানানো হয়েছে, তারা ওই নারী ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি স্প্যানিশ দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে, কারণ ওই দম্পতি স্প্যানিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।
ব্রাজিলিয়ান দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “স্প্যানিশ দূতাবাস জানিয়েছে তাদের তরফে আক্রান্ত ওই দম্পতিকে সমস্ত রকম সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা তা নেননি। কারণ ভারত সরকারের তরফ থেকে ইতিমধ্যে তাদের সাহায্য করা হচ্ছে।” এই বিষয়টির উপর ব্রাজিলিয়ান দূতাবাস লক্ষ্য রাখবে বলেও জানানো হয়েছে।
ভারতে অবস্থিত স্প্যানিশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক্স প্ল্যাটফর্মে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টে বলা হয়, ‘বিশ্বের সর্বত্র নারীর উপর সহিংসতা বন্ধ করার অঙ্গীকারে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।’
ইতিমধ্যে এই ঘটনাকে ঘিরে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী এবং সংগঠনগুলি সোচ্চার হয়েছে। ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মা ওই নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করে, সমস্ত রকমের সহায়তার আশ্বাস দেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। সমাজকর্মী শবনম হাসমি বলেন, “সন্ত্রাস কিন্তু একটা হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা দেশের পক্ষে সত্যিই খারাপ। সমাজে যদি নারীরা নিরাপদ না হন, তার চেয়ে বেশি লজ্জার আর কী থাকতে পারে?”
গত কয়েক বছরে বিদেশি পর্যটকদের উপর নির্যাতন ও যৌন হিংসার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। “এই ঘটনা তো নতুন নয়। এর আগেও নারী পর্যটকদের উপর যৌন হিংসার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ব দরবারে ভারতকে কালিমালিপ্ত করেছে এই ঘটনা। আর দুঃখের বিষয় হল দেশের নারীরাও তো নিরাপদ নন,” বলেছেন তিনি।
একই কথা শোনা গিয়েছে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী আলতাফ আহমেদের মুখে।
মানবাধিকার সংঠন এপিডিআর এর অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি মি আহমেদ বলেন, “অত্যন্ত নিন্দাজনক ঘটনা এটা। নারীদের পক্ষে নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে। ভিন্ন দেশের পর্যটককে এখানে এসে হেনস্থা হতে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি দুঃখজনক আর কী হতে পারে! রাষ্ট্র নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। ভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদেরও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। দেশে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে কিন্তু সরকার নির্বিকার!”
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা