ভালো-মন্দ বিচারে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
শামসুল হুদা
‘উত্তপ্ত পরিবেশে চুপ থাকা যেমন বিনা পরিশ্রমে ইবাদত, ভালো মানুষ হওয়া তেমনি বিনা পরিশ্রমে সৎ গুণ।’ কথাটা দিয়ে বিষয়টির আলোচনার সূত্রপাত করছি। বর্তমান পৃথিবীতে হরেক রকমের মানুষ আছে। বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতার মানুষ আছে। কেউ দুধ বেচে মদ খায়, আর কেউ মদ বেচে দুধ খায়। একশ্রেণির মানুষ আছে আত্মদম্ভে, অন্তঃসারশূন্য দম্ভে দাম্ভিক। নিজেকে সকলের ঊর্ধ্বে মনে করে। কেউ দোষত্রুটি ধরে দিলে সংশোধনের সুযোগ পেয়ে যেখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত, সেখানে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে, উত্তেজিত হয়ে অশোভনীয় বক্তব্য রাখা শুরু করে। আবোলতাবোল কথা বলে।
বর্তমান সভ্য সমাজে ইন্টারনেট ও ফেসবুকের প্রচলনে যা খুশি বক্তব্য পেশ করা যায়, যেহেতু খরচ লাগে না। কথায় আছে, মানুষ যা দেখতে চায়, যেভাবে দেখতে চায়, তা সেভাবে দেখে। কিন্তু সে দেখাকে যদি অন্যের চোখ দিয়ে দেখা যায়, তাহলে তা অনেক আবৃত বাস্তবতাকে উদ্্ঘাটন করতে সাহায্য করে।লর্ড ক্যানিং বলেছেন, ‘তোমার বিরোধীকে উত্তর দেওয়ার আগে তাকে বুঝতে চেষ্টা করো।’ পক্ষান্তরে জেমস স্টুয়ার্ট মিলের ভাষায়, ‘যে শুধু নিজের দিকটা দেখে, সে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি খুব কমই জানে।’ দুটো বক্তব্যের অর্থ কাছাকাছি।
যেকোনো বিষয়ে সামগ্রিকভাবে দেখা প্রয়োজন। কোনো কিছু বলার আগে সমগ্র জিনিসটি গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলে যে অর্থবোধগম্য হতে পারে, আংশিক বা একপেশে দেখায়, তা না-ও হতে পারে।
আমাদের সভ্য মানুষের চেহারা কী ভয়ংকর, স্বার্থপর! আত্মকেন্দ্রিক আমাদের এই সুসভ্য সমাজ, কী এক ফাঁপা আভিজাত্যের প্রাসাদে একশ্রেণির মানুষের বসবাস। মানুষরূপী কিছু অমানুষ সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মানুষরূপে জন্ম নিয়েও অনেক মানুষ অমানুষের আচরণ করে। মানুষের মতো চেহারা হলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে সবার আগে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মানুষকে সম্মান না করেও নিজে সম্মান পাওয়ার বিলাসী ভাবনা। We are all equal, but some are more equal than others. আমরা সবাই সমান, কিন্তু কেউ অন্যদের তুলনায় একটু বেশি সমান। এটাই হচ্ছে সমস্যা। জগৎ সংসারে সুজন ও দুর্জন দুই-ই বিদ্যমান। সুজনেরা গড়েন, দুর্জনেরা ভাঙে। সুজনের দৃষ্টি সামনে। দুর্জনের কাজ পেছনে টানা। দুর্জন চায় মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করতে। সেই কাঁটায় মানুষের পা রক্তাক্ত হয়।
রক্তাক্ত পা নিরাময় লাভ করে। কিন্তু পরাজিত হয় দুর্জনেরা। এটাই পৃথিবী এগিয়ে যাওয়ার নিয়ম। কচু পাতার উপরটা সবুজ, কিন্তু ভেতরটা আবর্জনায় ভরা। সমাজে আরেক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ভালো-মন্দের সঠিক ব্যবহার করতে পারে না, ভুল ব্যবহার করে।
অনেক মানুষের মধ্যে হিতাহিতজ্ঞান নেই। ন্যায়পরায়ণতা নেই। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ-বিবেচনা নেই। নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে অপরের ক্ষতিকে অন্যায় মনে করে না। স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই বেঁকে বসে, খেপে ওঠে, অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যায়। ভালো হওয়া সহজসাধ্য মৌলিকত্বের কারণে। আর মন্দ হতে শ্রম ও সময় ব্যয় করে কঠিন প্রক্রিয়ার অবলম্বন প্রয়োজন হয়, যেহেতু পরিশ্রম করে অমৌলিক মন্দকে ভালোর বিপরীতে বানাতে হয়। অসত্যের কাহিনি হয় বিশাল। কারণ তার পেছনে মূর্খ, লোভী, স্বার্থপর ও বিশ্বাসঘাতকেরা থাকে। এ ধরনের মনোবৃত্তি সমাজের একধরনের মানুষের পৈশাচিক বা কুপ্রবৃত্তির পরিচায়ক।
মনে রাখা প্রয়োজন-ভালো মানুষ হতে পরিশ্রম লাগে না, পয়সা খরচ হয় না। কেউ দোষত্রুটি ধরে দিলে ক্ষিপ্ত না হয়ে আত্মসমালোচনা করা উচিত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া উচিত। মিথ্যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটা হয়তো সাময়িক সুখী করবে, কিন্তু ভবিষ্যতে এর জন্য কাঁদতে হবে। মিথ্যাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সত্যকে লুকিয়ে রাখা হলেও বিলুপ্ত করা যায় না। আমাদের মতো দেশে অন্যায় শব্দটি অন্যায়ের জায়গাতেই অনড় হয়ে বসে থাকে, কারও চৌদ্দ পুরুষের সাধ্য নেই সেই অন্যায়কে তাদের বাপ-দাদার জায়গা থেকে নড়ায়। ন্যায় শব্দটি বরং শুধু শুধু হইচই করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে। অবশেষে জুতার ফেলে দেওয়া শুকতলার মতো রাস্তায় ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ ত্যাগ করে।অসমাপ্ততে সমাপ্তির পথে এগিয়ে আরেকটু বলতে চাই-মানুষ বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে পাপমুক্ত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু দুনিয়ার কলুষতা তাদের মন্দ অবস্থাতে লিপ্ত করে। Life is funny. Man comes to the world empty with nothing. Then men fight for everything. Later men leave everything and go to the grave with nothing but only the body. Still majority men become greedy. Still majority show the pride of wealth and power.
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি পঙ্্ক্তি মনে পড়ে গেল : ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।’ এর সঙ্গে আমার একটা কথা যুক্ত করার প্রয়াস পাচ্ছি : ‘মাটির দেহ নিয়ে কখনো করিবে না বড়াই, দু’চোখ বন্ধ হলে চলে যেতে হবে একাই।’
প্রসঙ্গক্রমে বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি, আমরা আমাদের জন্মতারিখ ও সময় জানতে পারি, কিন্তু মৃত্যুতারিখ ও সময় জানি না। আমরা স্বীকার করি বা না করি, জীবনের মহাসত্য মৃত্যু। জন্মগ্রহণ মানে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ। মৃত্যুর পর আমরা লাশ কবরে ফেলে চলে আসি। আপনজন হারানোর দুঃখে দু-এক দিন অশ্রু ঝরাই। কিন্তু কখনো সত্যিকারের গুরুত্বসহকারে কি ভেবে দেখি নিজেকেও যেকোনো সময় লাশে পরিণত হতে হবে। সবাই সাজিয়ে কবরে রেখে আসবে। পরিবারের যত গুরুত্বপূর্ণ কিংবা ভালোবাসার পাত্র হোন না কেন, মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব দাফন দিয়ে দেবে। কয়েক দিন পর সব ভুলে সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। মৃতজনের জন্য কারও জীবন থেমে থাকবে না। তাহলে লাশ হওয়ার আগে জীবদ্দশায় নিজেরা কবরে শান্তির জন্য কী করেছি? আমরা ইহকালের ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য অনেক সম্পদ জোগাড় করি। আর পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য সৎকর্ম করা, সৎভাবে চলা, ভালো মানুষরূপে জীবনযাপন ইত্যাদি সম্পদের কথা তেমন গুরুত্বসহকারে ভাবি না। মৃত্যুর মতো নির্মম বাস্তবতা আমাদের জীবনে আসবে জেনেও আমরা আমাদের চলার পথে ইহজগতে শুধু সম্পদ আর সম্পদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। অন্যকে ঠকিয়ে আমাদের নিজেদের উপরে ওঠার প্রবণতা। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষকে ঠকিয়ে আজ যতই মজা পাওয়া যায়, সঠিক হিসাব একদিন এই পৃথিবীতেই দিয়ে যেতে হবে। আজ পর্যন্ত কেউ ছাড়া পায়নি, আর পাবেও না। কারণ প্রকৃতি আপন গতিতে প্রতিশোধ নেয়।
পৃথিবীতে প্রায় ১৮ হাজার রকমের জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই অর্থ উপার্জন করে এবং জীবনযাপনের খরচ নির্বাহ করে। কিন্তু পৃথিবীতে অন্য কোনো প্রাণী না খেয়ে মরে না, অথচ মানুষের পেট কখনোই ভরে না। ইহকালের পৃথিবীতে সবকিছু পাওয়ার পরও মানুষের জীবনে অপূর্ণতা বা না পাওয়ার কিছু দুঃখ দূর হয় না। সুখের জন্য হাহাকার। অর্থ মানুষের রূপ বদলে ফেলে, স্বার্থ মানুষের চরিত্র বদলে ফেলে, অর্থ আর স্বার্থ একসঙ্গে থাকলে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়। মনে রাখা প্রয়োজন, অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সার সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি থাকত, তাহলে সুখ বাজারে বিক্রি হতো। অধিকাংশ মানুষ ভাবে, তারা সম্পূর্ণরূপে সুখী নয়। এত সুখের পরও দুঃখ তাদের আচ্ছন্ন করেই। মনে রাখতে হবে, জীবন যেমন সম্পূর্ণ সুখের নয়, তেমনি সম্পূর্ণ দুঃখময়ও নয়। জীবনে সুখও আছে দুঃখও আছে। এই সবকিছু নিয়েই জীবন সুন্দর। Good Should Have To Be Taken With The Bad. উল্লেখ্য, মানুষ দুঃখ ও অশান্তি চায় না। আর মজার ব্যাপার হলো স্বার্থান্ধ ও স্বার্থান্বেষী হয়ে বিবাদ- বিসম্বাদ এবং কলহ-বিগ্রহ করে এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষই দুঃখ ও অশান্তির কারণ।
শ্রম ও সময় ব্যয় করে এবং কঠিন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মন্দ মানুষ না হয়ে সহজসাধ্য ভালো মানুষ হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে এই ক্ষুদ্রকায় লেখার ইতি টানছি।
লেখাটি ঠিকানা থেকে সংগৃহীত
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট, বাফেলো, নিউইয়র্ক