ভোট হতে পারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ।। নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ।। বিএনপি একতরফা তফসিল ঘোষণা করা হলে লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যাবে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ সমূহ থেকে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান সরকার নির্বাচন তাদের অধীনে করতে বদ্ধপরিকর । অপর দিকে বিএনপি একতরফা তফসিল ঘোষণা করা হলে তা মানবে না বলে অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে ।বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের আভন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলে জানিয়েছে।
বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে সরকারবিরোধী বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল ও জোটের বিপরীতমুখী এমন অবস্থানের মধ্যেই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি তুলে ধরে হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে আমরা বদ্ধপরিকর। আর দ্রুতই সংসদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করা হবে। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। গত ১ নভেম্বর থেকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনাও শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার জন্য ইসির হাতে খুব বেশি সময় বাকি নেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন যত ব্যস্ততা শুধুই তপসিলকে ঘিরেই। ইতিমধ্যেই তপসিল ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে রেখেছে কমিশন। কমিশন সভার মাধ্যমে সেটি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতাই কেবল বাকি রয়েছে। যা এ সপ্তাহের যে কোনো দিনই হতে পারে। বিশেষ করে মঙ্গলবার অথবা বুধবারই জাতীয় নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আজ রবিবার কমিশন সভা আহ্বানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। ভোট হতে পারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।
ইসি সূত্র জানায়, এবার তপসিল অনুমোদন ও ঘোষণা একই দিন হতে পারে। অর্থাৎ, কমিশন সভা যেদিন হবে সেদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বক্তব্য রেকর্ড এবং একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে সেই তপসিল ঘোষণা করবেন। সেজন্য তপসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই ব্যস্ত সময় পার করছে কমিশন। এখন সিইসির ভাষণ প্রস্তুতি ও নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা। এছাড়াও বিগত সময়ের সিইসির প্রদত্ত ভাষণগুলো পর্যালোচনা চলছে।
তপসিল ঘোষণার পরই শুরু হবে ‘নির্বাচন পূর্ব সময়’ এবং নির্বাচনি আইন অনুসারে এ সময়ে যে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা ফলক উন্মোচন বন্ধ হয়ে যাবে। নির্বাচনি ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা বহাল থাকবে। এ সময় সরকার নির্বাচনকালীন সরকারে পরিণত হবে। সরকারের কার্যক্রম রুটিন ওয়ার্কে সীমিত হয়ে পড়বে।
ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইনি কাঠামোতে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে। সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। নতুন দলের নিবন্ধনের কাজও শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি। আর ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। ভোট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ আরও কিছু কাজ চলমান রয়েছে। তপসিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা, আসনওয়ারি ভোটার তালিকার সিডির প্রিন্ট শেষ হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চূড়ান্ত হয়েছে বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালাও। সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলের অনুমতি দিয়ে সাংবাদিক নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর এক সংলাপের মাধ্যমে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ইসির সর্বশেষ প্রস্তুতি প্রজেক্টরের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
ইসি সূত্র জানায়, এবার নির্বাচনি দায়িত্বে থাকবেন ৯ লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভাতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে। এর বাইরে নির্বাচনি প্রশিক্ষণে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি।
দিল্লির ও যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানের মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল ছিল। দিল্লিতে শুক্রবার ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়-যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এভাবেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুদেশের নেতারা আলোচনা করেছেন।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিনয় কোয়াত্রার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা।
উত্তরে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট তুলে ধরেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, এক বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আমরা সম্মান জানাই। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ভিশনকে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে। এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
দৃশ্যত ভারতের এ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের থেকে ভিন্ন। চীনের প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু হলেও বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তারা একমত নন। বরং দিল্লি ও ওয়াশিংটন এই ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়।
ভারতের বক্তব্যের একদিন আগে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়ো ওয়েন বলেছেন, বাংলাদেশে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এই দেশের আইন মেনে নির্বাচন প্রত্যাশা করে চীন। এই ক্ষেত্রে বাইরের চাপ কিংবা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিছুদিন আগে রাশিয়াও প্রায় একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলে জানিয়েছে। দেশগুলো সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে পর্দার আড়ালে তৎপরতা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে।
যদিও বাংলাদেশে সংকট নিরসনে বিদেশি তৎপরতা সফল হওয়ার ঘটনা দৃশ্যমান নয়। তবে বাংলাদেশে এই সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে তাদের মধ্যস্থতা দুই পক্ষের দূরত্ব কমাবে বলে আশা করেন। সবাই তাই তফশিলের আগেই সংলাপ চান।
অপরদিকে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে, দেশে নির্বাচনের কোনো ‘পরিবেশ না থাকায়’ এখনি তফসিল ঘোষণার পক্ষে নয় বিএনপিসহ রাজপথে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো।
বিএনপি একতরফা তফসিল ঘোষণা করা হলে লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যাবে দলটি। কোনো সমঝোতা না হলে কিংবা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি থেকে তারা পিছু হটবে না।
আজ চতুর্থ দফায় সারা দেশে ৪৮ ঘন্টার সড়ক, রেল ও নৌপথে এই অবরোধ শুরু হয়েছে। রোববার সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত্বেএ অরোধ চলবে।
তথ্য সূত্র: বিবিসি, ইত্তেফাক,যুগান্তর, নয়াদিগন্ত