মঈন হোসেন রাজু কে তিনি কি করে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থেকে গেলেন
রুহুল কুদ্দুস টিটো
কালের পরিক্রমায় মানুষ অতীত ভুলে যায় History repeats itself ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে সন্ত্রাসী চেতনার রাজনীতি নতুন মোড়কে ফিরে আসে আমাদের সমাজে ।
নীতি নৈতিকতা বিবর্জীত ছাত্র রাজনীতি আস্ফলন ধর্মর মোড়কে স্বার্থ হাছিলের খেলা দেখি ছত্রদের রক্ত নিয়ে উন্মত্ত রাজনীতির খেলা চলেছে আজও রাজুর মত সরল বিশ্বাসে হাজারো ছাত্র দেশে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস মুক্তির দাবীতে জীবন দান করে শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাস মুক্ত হয়না রাজনীতির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের খেলায় ।
১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হন। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চে “এদিকে পুলিশ অস্ত্রধারীদের কিছু না বলে উল্টো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরে যেতে বলে। তখন রাজু ও তাঁর বন্ধুরা ডাসের (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাকস) পূর্বদিকে টিএসসির দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ান। পুলিশের রমনা থানার তৎকালীন ওসি তাঁদেরও সরে যেতে বলেন, ‘তোমরা সরে যাও, আমরা দেখছি।’
রাজু প্রতিবাদী উত্তর দিয়ে বসেন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্দেশে, ‘আপনারা কী দেখছেন তা তো আমরা সবাই দেখলাম। আপনার দুই পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের কি চোখে পড়ছে না?’ পুলিশ কর্মকর্তা রাজুর দিকে আঙুল তুলে অন্য পুলিশদের আদেশ করতে থাকেন, ‘এই ছেলেকে ধর।’ রাজু উত্তেজিত হয়ে নিজের বুকের শার্টে হাত ধরে বলেন, ‘ধর আমাকে’।
মাহমুদ সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। তিনি রাজুকে টেনে নিয়ে আসেন টিএসসির ঠিক মাঝখানটায়। রাজু তখন রহিমের (তাঁদের সহপাঠী) দিকে আঙুল তুলে আদেশ করলেন, ‘স্লোগান ধর রহিম।’ রহিম জিজ্ঞেস করলেন কোন সংগঠনের ব্যানারে মিছিলটা হবে। রাজু বললেন গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নামে স্লোগান দিতে।শুরু হলো রাজুদের মিছিল। ‘সামনের সারিতে ছিলাম আমরা পাঁচজন। আমার ডানে রাজু। ঠিক ভাস্কর্যের মতোই হাতে হাত ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম।’ বলেন মাহমুদ।
তাঁদের ১০-১২ জনের মিছিলটি টিএসসির পূর্ব গেট ধরে ডাস (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাকস) ঘুরে হাকিম চত্বরের পাশ দিয়ে বর্তমান রাজু ভাস্কর্য ঘুরে টিএসসিতে অবস্থান নেয়। তখন মিছিল বিশাল আকার ধারণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিয়েছে। এরপর আবার ঘুরে টিএসসির পশ্চিম দিকের সিঁড়িঘরের সামনে মিছিলটি থামে। নেতা-কর্মীরা সমাপনী বক্তব্য দিতে থাকেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে আবার গোলাগুলি শুরু হয়। রাজু ও মিছিলের সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন সাহসী প্রতিবাদের। এগিয়ে যান আবারও একই পথে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য অতিক্রম করে কিছু দূর যাওয়ার পর এক রাউন্ড গুলি হয়। রাজু চিৎকার করে মাহমুদকে বলে ওঠেন, ‘ওরা মিছিলের ওপর গুলি করেছে।’ পরমুহূর্তে আরেক রাউন্ড গুলি। রাজু তাঁকে টান দিলেন। মাহমুদ ভাবলেন, রাজু শুয়ে পড়ার জন্য তাঁকে টানছেন। মাহমুদ হাঁটু গেড়ে বসতেই রাজু হেলে পড়লেন মাহমুদের কাঁধে। তাঁর চোখ জোড়া তখন উল্টে গেছে।
মাহমুদ সেই করুণ মুহূর্তের কথা বলে যান ধরা গলায়, ‘রাজুকে জড়িয়ে ধরে দেখলাম ওর হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। মুহূর্তেই বুঝলাম রাজু গুলিবিদ্ধ।’ পাশেই ছিল পুলিশ। সাহায্য চাইলেন মাহমুদ। পুলিশ উল্টো দিকে দৌড় দিল। গিয়ে তাঁদের দিকেই টিয়ার শেল ছুড়ল।মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যেই মাহমুদ দেখতে পেলেন, ডাসের দিক থেকে দুজন এগিয়ে আসছেন। রাজুকে তাঁরা কোলে করে রিকশায় তুলে নিলেন। গুলিবিদ্ধ রাজুকে নিয়ে ছুটলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ সে দিন ছিল শুক্রবার, রাজু মাকে কথা দিয়েছিল দুপুরে খেতে যাবে বাসায়। ঘাতকের বুলেট রাজুকে আর যেতে দেয়নি। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্ররা ছিল বিক্ষুদ্ধ। সকালে মধুর ক্যান্টিনে এক শিবির কর্মী প্রহৃত হয়।
এরপর পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ শুরু হলে রাজুর কনুই-এ আঘাত লাগে। সে চলে আসে শহীদুল্লাহ হলের ১২২নং রুমে। তারপর সাড়ে পাঁচটায় রাজু বন্ধুদের নিয়ে টিএসসি যায়।
সাথে ছিল রাজুর নিত্যসঙ্গী ব্যাগ। সেখানে বন্ধু এবং সহযোদ্ধাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করছিল রাজু। হঠাৎ ক্রমাগত গুলির শব্দ গেল। ছাত্রদল-ছাত্রলীগের বন্দুক যুদ্ধ। পুলিশের সামনেই অস্ত্রবাজরা মারাত্নক অস্ত্র নিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। পুলিশের এহেন আচরণে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তা নিয়ে রাজু ও গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের কয়েক জনের সাথে টিএসসিতে পুলিশের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। রাজু প্রতিবাদ করে বলে “দেখলাম তো আপনারা কি করছেন”। অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজু ও অন্যান্যরা বন্দুকবাজি এবং পুলিশের পক্ষপাতমূলক আচরণের প্রতিবাদে মিছিল সংগঠিত করে।
মিছিলে স্লোগান ছিল “অস্ত্র শিক্ষা, এক সাথে চলবে না”। “অস্ত্রবাজি সন্ত্রাস, রুখে দাঁড়াও ছাত্র সমাজ”। পুলিশের পক্ষপাতিত্ব সহ্য করা হবে না। মিছিলটি টিএসসি সড়ক দু’পাক দেবার পর ডাচের সামনে দিয়ে যাবার সময় হাকিম চত্বর থেকে এক পক্ষের সন্ত্রাসীরা মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। তবুও মিছিলের স্লোগান বন্ধ হয় না। একটি গুলি রাজুর মাথায় লাগে। স্লোগানরত রাজু লুটিয়ে পড়ে পিচ ঢালা রাস্তার উপর। তখন সোয়া ছয়টা। অবশ নিথর রক্তাক্ত দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩২ নং ওয়ার্ডে। রাজু আর ফেরে না। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীসহ অসংখ্য সহপাঠি সতীর্থরা মেডিকেলে আসে। রাজুর মা ভাই আসেন হাসপাতালে।
মা’কে রাজু বলতো “আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিতি পাবে”। রাজু সেই সত্যটাই প্রমাণ করে গেল।
“সেদিন তুই মাকে বললি বিকেলে বাসায় আসবি- আর তো এলি না- এলি লাশ হয়ে। সকালে তো তোকে টিএসসিতে নামিয়ে দিয়ে এলাম। কখনও তো মা তোকে ইউনিভাসির্টিতে দিয়ে আসতে যায় না অথচ সে দিন নামাতে গেল- নিয়তির কি পরিহাস, আর কোন দিন তোকে ঐ প্রিয় জায়গায় দিয়ে আসতে পারবো না। আমার এখনও চোখের সামনে ভাসছে সে দিন আমরা সিড়ি দিয়ে নামছি আর তুই বিড়ালটাকে আদর করতে করতে দেরি করে গাড়িতে এলি। তুই কি জানতি এটাই তোর শেষ আদর”। (যে দিন রাজু নিহত হয় সে দিন শ্যামলির বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শহীদ মঈন হোসেন রাজুর বড় ভাই মুনিম হোসেন রানার অভিব্যক্তি)।
সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য তৈরীর ইতি কথা
সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি প্রাঙ্গনে অবস্থিত ঢাকার একটি অন্যতম প্রধান ভাস্কর্য নিদর্শন। এটি ১৯৯৭ এর শেষভাগে তৈরি হয়।
রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত এই ভাস্কর্য ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন।
এই ভাস্কর্য নিমার্ণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল। নির্মাণ ও স্থাপনের অর্থায়নে ছিলেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি, লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। ভাস্কর্যটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
এই ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।
তথ্যসূত্র: দি রিভার্স টাইম, একতা, উইকিপিডিয়া