আলাপচারিতা
বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহা-সংকলন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও তিনটি গ্রন্থের সঙ্গে চর্যাগানগুলো নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থের নাম দেন ” হাজার বছরের পুরনো বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহা “।
চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। চর্যাপদের ২৪ জন পদকর্তা হচ্ছেন লুই পা, কুক্কুরীপা, বিরুআপা, গুণ্ডরীপা, চাটিলপা, ভুসুক পা, কাহ্নপাদ, কাম্বলাম্বরপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা ,মহিত্তাপা, বীণাপা, সরহপা, শবর পা, আজদেবপা, ঢেণ্ঢণপা, দারিকপা, ভাদেপা, তাড়কপা, কঙ্কণপা , জঅনন্দিপা, ধামপা, তান্তীপা, লাড়ীডোম্বীপা।
বাংলা কবিতা এর উৎপত্তি হয়েছিলো মূলত পালি এবং প্রাকৃত সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতি থেকে।
বাংলা ১৪১৫ সাল নাগাদ থেকে বাংলা সাহিত্য জগতে এক ভিন্ন স্বাদের কবিতাশ্রয়ী ঘরানার উদ্ভব হতে দেখা যায়-দশকোষী কাব্য ঘরানা, পঞ্চবান কাব্য ঘরানা ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যের ১২০০-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ” হিসেবে চিহ্নিত। এই সময় রচিত হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যার রচয়িতা বডুচন্ডিদাশ এছাড়া বৈষ্ণব পদাবালী সাহিত্যের কবিগণ হলেন বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, যশোরাজ খান , চাঁদকাজী, রামচন্দ বসু, বলরাম দাস, নরহরি দাস, বৃন্দাবন দাস, বংশীবদন, বাসুদেব, অনন্ত দাস, লোচন দাস, শেখ কবির, সৈয়দ সুলতান, হরহরি সরকার, ফতেহ পরমানন্দ, ঘনশ্যাম দাশ, গয়াস খান, আলাওল, দীন চন্ডীদাস, চন্দ্রশেখর, হরিদাস, শিবরাম, করম আলী, পীর মুহম্মদ, হীরামনি, ভবানন্দ প্রমুখ কবি।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। ইসলামি ধর্মসাহিত্য,পীরসাহিত্য,বাউল পদাবলি,পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ,মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, নাথসাহিত্য ইত্যাদি ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
মধ্যযুগের কাব্যধারা মনসামঙ্গলের কবিগণ, চন্ডীমঙ্গলের কবিগণ, ধর্মমঙ্গলের কবিগণ, কালিকামঙ্গলের কবিগণ নানাভাবে বাংলা কবিতায় অবদান রেখেছেন। মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কবিগণ হচ্ছেন কানাহরি দত্ত, নারায়ন দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর, ক্ষেমানন্দ, কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব, আদি রূপরাম, মানিক রাম, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম, রূপরাম, সীতারাম দাস, শ্যামপণ্ডিত, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম। বৈষ্ণবপদাবলি ধারার কবি : বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস, দীন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস মহাকাব্য: অনুবাদ কবিতার খ্যাতিমার কবিরা হলো: সংস্কৃত রামায়ণ ও মহাভারত, মহাকাব্যদুটির শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি হচ্ছেন যথাক্রমে কৃত্তিবাস ওঝা ও কাশীরাম দাস। অন্যান্য অনুবাদক হচ্ছেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, চন্দ্রাবতী , অদ্ভুতাচার্য, ভবানীদাস প্রমুখ। রোমান্টিক কাব্য: (অনুবাদ) বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে মুসলমান রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্যধারা হচ্ছে রোমান্সমূলক কাব্য। ইউসুফ-জুলেখা – শাহ মুহম্মদ সগীর, পদ্মাবতী – আলাওলের, মধুমালতী- মুহাম্মদ কবীর সতীময়না-লোরচন্দ্রানী- দৌলত কাজীর লায়লী-মজনু : দৌলত উজির বাহরাম খা । জীবনীকাব্য,শাক্তপদাবলি, দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উল্লেখ যোগ্য কবিরা হলো: বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ , রামপ্রসাদ, দাশু রায়, সৈয়দ হামজা , ফকির গরীবুল্লাহ প্রমুখ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্যও দুটি ধারায় বিভক্ত হয়: ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্য ও কলকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি অন্যতম, সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
আধুনিক যুগে ১৮০০- বর্তমান, চলমান। মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগ সন্ধি ক্ষণের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে কবি প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে। রচনা করেন সনেট। লাভ করেন, আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। ভোরের পাখি : ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। মহিরুহ বৃক্ষের ন্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। মহাকাব্য ব্যতীত সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি খ্যাতির স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেননি। রবীন্দ্রানুসারী ভাবধারার অন্যান্য কবিরা হলো: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বিশ শতকের শুরুতে কবিতায় পঞ্চপুরুষ রবীন্দ্রবিরোধিতা করেন, তারা হলো : মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত । আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ: রবীন্দ্র ভাবধারার বাইরে এসে দশক প্রথার চালু করেন তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবি: অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া