কোরবানি মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে চলে আসা একটি ইবাদত; যা মূলত স্রষ্টার উদ্দেশে সৃষ্টির নজরানা। কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, আত্মোত্সর্গ; নৈকট্য লাভ।
ছবি: উপরে পিলারটি হচ্ছে ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র কোরবানির স্থান মিনায়
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার, আয়াত: ২)। এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কোরবানি একটি ওয়াজিব (আবশ্যিক) বিধান।
পরিভাষায় কোরবানি হলো, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট জন্তু জবাই করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবন উপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)।
কুরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।
কুরবানির প্রচলন হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু হলেও মুসলিম উম্মাহ কুরবানি মূলতঃ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় হজরত ইসমাইল আলাইহি সালামকে কুরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা।
আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় ফেলেছিলেন এ কুরবানির নির্দেশ প্রদান করে। যা তিনি হাসিমুখে পালন করে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৪)
কেন কুরবানি প্রচলন!হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম যখন চলাফেরা করার বয়সে উপণীত হলেন; তখন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কুবানির জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হন। আর নবিদের স্বপ্নও কোনো কল্পনা প্রসূত ঘটনা নয় বরং তা ‘ওহি’ বা আল্লাহর প্রত্যাদেশ।
তখন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমাইলকে বললেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি?
সে (হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)
৯৯ বছরের বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিম তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে আত্মনিবেদনে আল্লাহ তাআলা যে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন। আর তিনিও মিনা প্রান্তরে প্রাণাধিক সন্তানকে কুরবানির যে নির্দেশ পালন করেছিলেন।
আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তাঁর মানসিকতা আল্লাহর নিকট কবুল হয়েগিয়েছিল। যা আজও মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ এ তিন দিনের যে কোনো একদিন পালন করে থাকেন।
কোরবানির ইতিহাস
মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল (রা.) ও কাবিল। বাবা আদম (আ.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর নামে কোরবানি করো, যার কোরবানি কবুল হবে, তার দাবি গ্রহণযোগ্য হবে।’ অতঃপর তাঁরা উভয়ে কোরবানি দিলেন। হাবিল (রা.)-এর কোরবানি কবুল হলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না।…অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)। এতে প্রতীয়মান হয়, কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোকদেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
কোরবানি
কোরবানির ইতিহাস পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে:
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম, অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, “হে বত্স! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী?” সে বলল, “হে আমার পিতা!
আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে শোয়াল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম: “হে ইবরাহিম! আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন!” এভাবেই আমি সত্কর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখে দিলাম। ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)।
আমাদের কোরবানি
আজকের মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রথা চলমান আছে, এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? এটা কোথা থেকে এসেছে? প্রিয় নবী (সা.) উত্তরে বললেন, ‘এটা হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত বা আদর্শ। এই আদর্শকে অনুসরণের জন্যই আল্লাহ পাক তোমাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? উত্তরে মহানবী (সা.) বললেন: ‘কোরবানি জন্তুর প্রতিটি পশমে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।’