“মা” আছেন সাহিত্যে “মা” আছেন কবিতায় গল্পে, উপন্যাস, সিনেমায়
রুহুল কুদ্দুস টিটো
“মা” পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বন্ধু । পৃথিবীতে “মা” শব্দটির চেয়ে অধিক শ্রুতিমধুর ও প্রিয় শব্দ আর নেই।সাহিত্যে মা’কে নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি বই দাগ কেটেছে পাঠক মনে। বাংলা ভাষাতেও মা’কে নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাস। মা’কে নিয়ে ‘লা মাদ্রে’ নামে ইতালিয় লেখক গ্রেজিয়া দেলেদ্দার উপন্যাস লিখে ১৯২৬ সালে নোবেল পেয়েছেন।
কবিতায় “মা”
কবিগুরু শুধু কবিতায় নয় মাকে নিয়ে লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাসও। তিনি ‘মাতৃবৎসল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে/তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে/বলে, আমরা কেবল করি খেলা/ সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা।’
‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি একটি ছোট ছেলের তার মাকে বিপদ থেকে কিভাবে সাহসের সাথে লড়াই করে রক্ষা করে সেই কাহিনি যা সকলের মুখে মুখে।‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে/ আমি যাচ্ছি/রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।’ সেই বীরপুরুষ আসলে প্রতিটি সন্তানের হওয়া উচিত। আবার তিনিই তার ‘অন্য মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার মা না হয়ে তুমি/আর কারো মা হলে/ভাবছ তোমায় চিনতেম না/যেতেম না ঐ কোলে?/মজা আরো হত ভারি/দুই জায়গায় থাকত বাড়ি/আমি থাকতাম এই গাঁয়েতে/তুমি পারের গাঁয়ে।’
রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনে মাকে খুব একটা বেশি কাছে পাওয়া হয়নি। অকালপ্রয়াত বুধেন্দ্রনাথসহ মোট পনের সন্তানের মা সারদা দেবীর পক্ষে তার চতুর্দশতম সন্তানকে তত বেশি সময় দেওয়া হয়নি। ‘আমার ছেলেবেলা’ হতে জানা যায়, তিনি থাকতেন ওপর তলায় আর রবি থাকতেন নিচতলায় ভৃত্যসর্দার ব্রজেশ্বরের তত্ত্বাবধানে। রবি কী খাবে না খাবে, কিংবা কী তার বায়না, সে বিষয়ে সারদা দেবীর কোনো মাথাব্যথা ছিল না।কেবল মাস্টার মশায়কে পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওপরতলায় মায়ের কাছে ধরনা দিতেন বালক রবি। মাও হাতে তাসের সজ্জা নিয়ে ব্রজেশ্বরকে বা মাস্টার মশায়কে বলে পাঠাতেন, আজ আর পড়াতে হবে না। এটুকুই ছিল রবির সঙ্গে মায়ের বলার মতো স্মৃতি।
শৈশবে মাকে অন্যসব ছেলেদের মতো কাছে না পেলেও মাকে নিয়ে অন্যদের মতো এক কল্পজগৎ রবির ছিল, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমরা ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় কল্পজগতে বিচরণকারী সেই কিশোরটাকেই দেখি, যে মাকে নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক ভ্রমণযাত্রায়। সব কিশোরের কাছেই জগৎ সম্পর্কে যেমন মা কম জানে তার চেয়ে, রবীন্দ্রনাথের কল্পজগতের কিশোরের মাও তেমনি। তিনি হেঁশেল আর সংসারের বাইরে একটি কদম পা রাখেননি কোথাও। এই বোকাসোকা আদরিণী মাকে নিয়ে খোকা যে ভ্রমণে বের হলো, সে ভ্রমণযাত্রায় মাকে দেখভাল করার দায়িত্ব যেন বীরপুরুষ খোকার। ডাকাতদের সঙ্গে লড়াইয়ে মা তাই ভয়ে ভয়ে পালকিতে এককোণে জড়সড় হয়ে কেঁপে কেঁপে ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করলেও তারই ছোট্ট খোকা হঠাৎ যেন বড় হয়ে যায়। তার বীরত্বে মা বেঁচে যাওয়ার যে কল্পকাহিনি বালক রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ে ধারণ করেছেন, তা তার বয়সি ছেলেদের এক কাঙ্ক্ষিত কল্পলোকের ফিকশন।
পৃথিবীতে “মা” এই শব্দটির চেয়ে অধিক শ্রুতিমধুর ও প্রিয় শব্দ আর নেই। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই মাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে। অতীতে মাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে। “মা” আছেন কবিতায় গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায়।
‘‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’-তে রবীন্দ্রনাথ মাতৃস্মৃতি উদ্ধৃতি করতে গিয়ে কথাটি বলেছিলেন।
রবীন্দ্রসাহিত্যে সারদা সুন্দরী দেবী আসেন নি ঠিকই, তাই বলে কি তিনি মাকে ভালোবাসতেন না? অবশ্যই বাসতেন। মাতৃস্মৃতি তাঁর ভেতরে মাঝে মাঝেই জেগে উঠত। পরিণত মধ্য বয়সেও রবীন্দ্রনাথের মনে মাতৃস্মৃতি পুনরায় ফিরে এসেছিল তারই প্রমাণ মেলে ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে প্রদত্ত এক উপদেশে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেখা এক স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন: ‘‘… আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি। আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন। আমার বড়ো বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগান বাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন। তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার কী হল জানি নে। আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন। তখনই তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’ এইখানে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।’’
পৃথিবীর কোনো সম্পদ, টাকা-পয়সা, গাড়ি, বাড়ি হারানোর সাথে মাকে হারানোর তুলনা হয় না।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তার কবিতায় মাকে উপস্থাপন করেছেন, দুঃখের সায়রে মায়ের এক মুখ/রঙিন ঝিনুকে পোরা মুক্তা এতটটুকু। কবি রজনীকান্ত সেন লিখেছেন, ‘স্নেহ বিহ্বল, করুণা ছলছল/শিয়রে জাগে কার আঁখিরে/মিটিল সব ক্ষুধা, সঞ্জীবনী সুধা/ এনেছে অশরণ লাগিরে।
হুমায়ুন আজাদ মাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি/আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে/কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা/আমাদের বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে/মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি। একটি সম্পর্ক যা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই একইভাবে বহমান তাকে আর কি দিয়েই পরিমাপ করা যায়! মাকে নিয়ে আলাদা একটি দিবসের প্রচলন হলেও বস্তুতপক্ষে কোনো নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে বা উপলক্ষ করে মার প্রতি ভালোবাসা হিসেব করা যায় না। এটি সর্বকালের, সর্বসময়ের।
সন্তানেরা মায়ের সাথে অসদাচরণ করলেও মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। মা ও সন্তান সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচন বাংলায় ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়’ অর্থাৎ মায়ের অবস্থানটি অত্যন্ত সহনশীল ও স্নেহময়ী।
যুগে যুগে মা-কে নিয়ে তেমনি রচিত হয়েছেসাহিত্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে
গোর্কির মা: রুশ সাহিত্যের তো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি। শ্রমিক শ্রেণীর এই লেখক বইটিতে দেখিয়েছেন একজন কারখানা শ্রমিকের দরিদ্র স্ত্রী ‘পেলাগেয়া নিলভনা’ কিভাবে ধীরে ধীরে পরিনত হন বিপ্লবী নারীতে। পুরুষতন্ত্র ও শ্রেণী শোষণের তীব্র প্রতিবাদও এই বই। মা’র ছেলে সাসাও কারখানা শ্রমিক থেকে পরিনত হন বিপ্লবীতে। তারা সকলেই মরনপণ লড়াইয়ে নামেন সমাজ বদলে ।
লা মাদ্রে: এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আবদুল হাফিজ। তিনি বইটি সম্পর্কে নিজেই বলেন, ‘লা মাদ্রের কাহিনী গড়ে উঠেছে এক যাজক ও তার মাকে নিয়ে। অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে মা তার ছেলে পল’কে বড় করেছেন। বড় হয়ে পল যাজকত্ব গ্রহণ করে। এ অতি কঠিন দায়িত্ব। মায়ের মনে সদাই ভয় পল তার কর্তব্যের সীমা পেরিয়ে পাপের পথে যেন পা না বাড়ায়।
কিন্তু সুন্দরী এজনিসের সঙ্গে দেখা হয় পলের। একদিকে কর্তব্য অন্যদিকে প্রেমের আকুতির মধ্য দিয়ে গল্প বেড়ে ওঠে। এবং শেষ হয় একটি করুণ মৃত্যুতে। সে মৃত্যু পলের মায়ের। গ্রেজিয়া দেলেদ্দা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অসাধারণ। গোটা কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে মা। অন্যান্য চরিত্রগুলিকে সমান সহানুভূতির সঙ্গে উপন্যাসিক নির্মাণ করেছেন। জীবনের দ্বিধা সংশয় ও আকাংক্ষাগুলিকে চমৎকারভাবে ধরতে পেরেছেন বলেই এই বই এতোখানি আদৃত।’
বিশ্ব সাহিত্যে মাকে নিয়ে লেখা সেনসিটিভ চরিত্রগুলো
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-এ ইউরিপিডিসের লেখা ট্র্যাজেডি নাটক ‘মিডিয়া’তে দেখা যায় মিডিয়া তার নিজের সন্তানদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে করে তার কাজ হাসিল করে। গ্রিক মিথলজির আরেকজন মা হচ্ছেন হেরা। তার ধারণা সব শিশুর মধ্যে শয়তান বিরাজ করে। শিশুদের তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না। হেফাসটাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক মিথলজিতে ভলকানোর দেবতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখতে খুবই বাজে ছিলেন। শুধু এই কারণে তার নিজের মা হেরা তাকে অলিম্পাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেন।
রাজা ইডিপাসের ঘটনা ছেলে বাবাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করে। ‘রাজা ইডিপাস’ নাটকের মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে থিবসের রাজা লেয়াস ও তার স্ত্রী জোকাস্টাকে ঘিরে। বহুদিন সন্তান না হওয়ার কারণ জানতে রাজা লেয়াস একাকী ডেলফির মন্দিরে যান। দৈববাণী শোনা গেল যে, তার এই সন্তান না হওয়ার দুর্ভাগ্যকে তার আশীর্বাদ মনে করা উচিত। কেননা জোকাস্টার গর্ভজাত এবং তার ঔরসজাত সন্তান কালে তার হত্যাকারী হবে।
সে জোকাস্টাকে কোনো কথা জানাল না, বরং সে জোকাস্টা থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগল। জোকাস্টা তাকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে সন্তানবতী হলো। নয় মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র লেয়াস ধাত্রীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মেষপালকের হাতে দিলো তাকে মারার জন্য। নবজাতকের পা দুটো লোহার শিক দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো যাতে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পারে। কিন্তু বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। নিয়তির নির্দেশে নবজাতকের মৃত্যু হলো না। পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক তাকে কুড়িয়ে পেলো এবং তার নাম দিলো ইডিপাস। কেননা তার পা দুটো পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করায় ফুলে গিয়েছিল।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইডিপাস শব্দের অর্থ ‘পা ফোলা’। মেষপালক তাকে করিনথে নিয়ে এলো। সে সময় রাজা পলিবাস করিনথে শাসন করছিলেন। রাজা পরিবাস ও রানী মেরোপী নিঃসন্তান। তাই তারা ইডিপাসকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করতে লাগলো। এই সন্তানই পরে যুদ্ধ করে লেয়াসকে হত্যা করে এবং জোকাস্টা মানে তার মাকে বিয়ে করে।
সৎ মাকে ঘৃণার করার একটা প্রবণতা রয়েছে অনেকের । যা সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম খুব কম হয়েছে। সিনডেরেলা, হ্যানসেল এবং গ্রেটেল এবং স্নোহোয়াইট গল্পগুলোতে ভিলেন হিসেবে সৎ মাকেই দেখা যায়। এই মায়েদের লাখ লাখ মানুষ এখনো ঘৃণার চোখেই দেখে।
বাংলা সাহিত্যে মাকে নিয়ে লেখা উপন্যাস
গোরা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গোরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসের মা আনন্দময়ী চরিত্রটি সমস্ত সীমার ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, মা যে যেকোন জাতভেদকে মাড়িয়ে জননীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, তাই এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে।
‘জননী’ মানিক বন্দোপাধ্যায়ের যে কয়েকটি লেখা কালজয়ী বলে সমালোচকগণ দাবি করেন, সেগুলোর মধ্যে তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ (২ মার্চ, ১৯৩৫) অন্যতম। অনেকের মতে এটি মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। শ্যামা নামে এক নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের বহুবিধ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে।
‘জননী’ নামে আরেকটা উপন্যাস আছে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের। এই উপন্যাসটির প্রশংসা বেরিয়েছিল ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান-এ। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্য নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদের প্রায় অনেকে পড়েছেন।
চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেন।উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। কালীগঞ্জ গ্রামের এক সাহসী মায়ের গল্প। যে মা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে প্রতিবন্ধী ছেলেকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেন নি। এছাড়াও আছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ ইত্যাদি।
জননী – মানিক বন্দোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যে মা – কে নিয়ে রচিত একটি অসাধারণ উপন্যাস “জননী”। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। ইনি আমার খুবই প্রিয় একজন ঔপন্যাসিক। এই উপন্যাসে তিনি মা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন যুদ্ধে নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় রত এক সংগ্রামী মহিলাকে। সব ধরনের বিপদ মোকাবেলাও করেও, চরম অসহায়ত্বের মাঝেও মা যে কতটা যত্নবতী হতে পারে, “জননী” সেরকমই একটি সাহিত্য। অনেককে বলতে শুনেছি, গোর্কির “মা” থেকে নাকি তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
বিন্দুর ছেলে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস “বিন্দুর ছেলে”। মায়ের স্নেহ যে কতটা বিশাল হতে পারে, মাতৃছায়ার ছায়া যে কতটা বিস্তৃত হতে পারে, তা এই উপন্যাসে লেখক প্রকাশ করেছেন। মায়ের স্নেহ বলতে আমরা যে ধারণা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি তার আক্ষরিক রূপ এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। “রামের সুমতি” নামে লেখকের আরেকটি উপন্যাস রয়েছে, যেটিও মা কে নিয়ে রচিত।
মা – আনিসুল হক : মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে লেখা আনিসুল হকের উপন্যাস ‘মা’ (২০০৪)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী যখন ঢাকা শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, সে সময় অকুতোভয় গেরিলা গ্রুপ ‘অপারেশন ক্রাক প্লাটুন’ পাক-সেনাদের ওপর একের পর এক চালাতে থাকে সাহসী হামলা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ) ছিলেন ক্রাক প্লাটুন গ্রুপের অন্যতম সদস্য। কিন্তু পাক সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পুরনো ঢাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তাকে। আজাদের মা সাফিয়া বেগম ধর্ণাঢ্য পরিবারের স্ত্রী হয়েও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে না পেরে ওই বাড়িতেই আজাদকে নিয়ে থাকতেন। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর চরম নির্যাতনের মুখেও মুক্তিযোদ্ধা আজাদ কওনও তথ্য দেননি। সে সময় কারাগারে মা দেখা করেন আজাদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা আজাদ মাকে জানিয়েছিল, পাক সেনারা তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছে। আর তাকে ভাতও খেতে দেয়নি। এই ছিল মায়ের সঙ্গে শহীদ আজাদের শেষ সাক্ষাৎ। এর পর শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম স্বাধীন দেশে ১৪ বছর ভাত না খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কাটিয়েছেন। এসব সত্যি ঘটনাই উঠে এসেছে আবেগ তাড়িত ‘মা’ উপন্যাসে।
উপন্যাসটি প্রকাশের পর পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় । সাহিত্য সমালোচকেরা এই উপন্যাসটিকে মুক্তিযুদ্ধের পর এবং মাকে নিয়ে যেকোনো সময়ে লেখা একটি প্রধান উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছেন । বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, “আমি বলি দুই মা; ম্যাক্সিম গোর্কির ”মা” আর আনিসুল হকের মা : … এই দুই মা যথার্থ মা হয়ে উঠেছেন আমার কাছে ।”
সরোজিনী সাহু মন্তব্য করেছেন, “One of the best novels of Indian sub-continent.It made my eyes watery. Perhaps the success lies behind the strong theme of humanity.”
শেখর ইমতিয়াজ উপন্যাসের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটের আঙ্গিকে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছেন, “প্রায় ৩০ বছর আগে ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি পড়ে কৈশোরিক দুরন্ত সাহস অর্জন করেছিলাম , আজ আনিসুল হকের মা উপন্যাসটি পড়ে নিজেদের ইতিহাসের বিস্মৃতির লীলায় প্রৌঢ়ত্বের বুকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”