মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণের নেপথ্যে ।। ইতিহাসের পাতা থেকে
আকাশবাণী কলকাতার দপ্তরে ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল সন্ধ্যায় ডিউটি ছিল সংবাদ প্রযোজক উপেন তরফদারের। ডিউটি শেষে বেরনোর মুখেই তাকে বলা হল থেকে যেতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
মি. তরফদার কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু তার পুত্রবধূ দেবযানী আইচ ১৯৭১ সালের ১৬-১৭ই এপ্রিলের ঘটনাটা এতবার শুনেছেন যে পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে সবটা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। রাত প্রায় বারোটা বাজে। অফিস থেকে বেরনোর ঠিক আগেই বাবাইদের (উপেন তরফদার) বলা হল আজ রাতে বাড়ি যাওয়া যাবে না! কিন্তু কেন, সেসবরে কোনও উত্তর কারও জানা নেই,” বলছিলেন দেবযানী আইচ।
মি. তরফদার আকাশবাণী কলকাতার প্রযোজক ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত ও মি. তরফদারের প্রযোজিত সংবাদ বিচিত্রা আর সংবাদ পরিক্রমা অনুষ্ঠান দুটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
গাড়ি বহর তৈরি, কিন্তু গন্তব্য অজানা
সবটা তদারকি করছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ড আর বিএসএফের জনসংযোগ অফিসারেরা।
একে একে অনেক গাড়ি এসে হাজির হয়েছিল কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে।
ওইসব গাড়ি যোগাড় করে এনেছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
মি. চক্রবর্তী পড়াশোনা করতেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে, কিন্তু সমসাময়িক হওয়ার কারণে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধু ছিলেন গোলক মজুমদার।
গোলক মজুমদার সেই সময়ে ছিলেন বিএসএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল।
মি. চক্রবর্তীর বয়স একশো বছর, কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি প্রখর। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের সময়ে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে আমি তার একটা সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম, সেই কথা সাড়ে তিন বছর পরেও ২০২৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বরে মনে আছে তার।
মাত্র দু সপ্তাহের প্রস্তুতি
যেদিন উপেন তরফদারেরা কলকাতা প্রেস ক্লাবে হাজির হয়েছিলেন মাঝ রাতে, তার সপ্তাহ দুয়েক আগে মি. মজুমদার নিজে গিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে নিয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব তাজউদ্দীন আহমেদ আর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে।
তারা দুজনেই ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকা থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। তিন দিন পরে তারা কুষ্টিয়া সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে এক স্থানীয় বাঙালি সরকারি অফিসারের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছিলেন বিএসএফকে যাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করা যায়।
সদ্য প্রকাশিত “ইন্ডিয়াস সিক্রেট ওয়ার – বিএসএফ অ্যান্ড নাইন মান্থস টু দ্য বার্থ অফ বাংলাদেশ’ বইতে ঊষীনর মজুমদার লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বানপুর-গেদে সীমান্তে তখন মোতায়েন ছিলে বিএসএফের ৭৬ নম্বর ব্যাটালিয়ন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা জানতে পেরেই কলকাতায় বাহিনীর আইজি গোলক মজুমদারের কাছে মেসেজ পৌঁছিয়ে যায়।
তাজউদ্দীন আহমেদরা একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছলেন ৩০ শে মার্চ। সেদিনই দিল্লি থেকে বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তমজি বিশেষ বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন আর কলকাতা থেকে নদীয়ার দিকে জীপ নিয়ে দৌড়লেন আইজি গোলক মজুমদার।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কলকাতায় নিয়ে পৌঁছন সে রাতেই। পরের দিন কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে পাজামা পাঞ্জাবি কিনে আনা হয় নেতাদের পরার জন্য।
আর পয়লা এপ্রিল মি. মজুমদার দিল্লি রওনা হলেন তাজউদ্দীন আহমেদ আর আমিরুল ইসলামকে নিয়ে। তেসরা এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর।
কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক মানস ঘোষকে উদ্ধৃত করে ঊষীনর মজুমদার লিখছেন, সেই বৈঠকেই মিসেস গান্ধী তাজউদ্দীন আহমেদদের পরামর্শ দেন যে একটা সরকার গঠন করে ফেলা দরকার, যাতে মুক্তি যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক স্তরে মান্যতা দেওয়া যায়।
বিএসএফের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক কে এফ রুস্তমজির সঙ্গেও দিল্লিতে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয় তাজউদ্দীন আহমেদের। ওদিকে ইন্দিরা গান্ধী আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যে মুক্তি যোদ্ধাদের সবধরনের সহায়তা দিতে হবে।
ভিআইপি আর সাংবাদিকদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা
নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন, “দুদিন আগে গোলক আমাকে বলে যে অনেকগুলো গাড়ি দরকার – প্রায় ২৫-৩০টা।
কিন্তু কোনও সরকারি গাড়ি দেওয়া যাবে না বলেছিল গোলক। কোনও ভাবেই যাতে খবর না বের হয়, সেদিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছিল।
একদিনের মধ্যে কলকাতার নানা জায়গা থেকে গাড়ি যোগাড় করে এনেছিলাম। চালকরা সবাই অবাঙালি ছিল, যাতে তারা কারও কথা না বুঝতে পারে।
“আমি তখন রাসেল স্ট্রীটে যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে অনেক জায়গা ছিল। সবগুলো গাড়ি আর তাদের চালকদের আগের দিনই সেই বাড়িতে এনে রেখেছিলাম। প্রতিবেশীরা জানতে চেয়েছিল যে ২৫-৩০ টা গাড়ি কেন এনেছি”
“তাদের বলেছিলাম যে আমি বেশ কয়েকটা মারোয়ারি কোম্পানির ডিরেক্টর তো, ওদেরই পরিবারে একটা বিয়ে আছে। সেজন্যই গাড়িগুলো ভাড়ায় নিয়ে এসেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
তার কথায়, “চালকদের প্রত্যেককে তল্লাশি করা হয়েছিল, গাড়িগুলি সব ঠিকঠাক আছে কী না, সেটাও বিএসএফ আর আর্মির লোকেরা দেখে নিয়েছিল। এরপরে ১৬ই এপ্রিল রাতে তাদের প্রেস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে গাড়ীর বহর রওনা হয়।“
এক ঘণ্টায় মঞ্চ তৈরি
আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদারের দেওয়া বর্ণনা মনে করে তার পুত্রবধূ দেবযানী আইচ বলছিলেন, “অন্ধকার রাতে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চলার পরে যখন প্রায় ভোর হচ্ছে, সেই সময়ে তারা একটা বিরাট মাঠে পৌঁছলেন।
প্রচুর মানুষ অস্ত্র হাতে সেখানে হাজির, বাংলাদেশের একটা পতাকা আছে। একটা মঞ্চ গড়া হয়েছে। জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল মুজিবনগর।”
ঊষীনর মজুমদার লিখছেন, “আমবাগানের চারপাশটা সাদা পোষাক পরা বিএসএফ সদস্যরা ঘিরে রেখেছিলেন। বিএসএফ আর ইপিআর সদস্যরা ভারতীয় গ্রাম গেদে থেকে কাঠের তক্তা নিয়ে এসেছিলেন।”
“আনা হয়েছিল ফুল। কয়েকটা চেয়ার ধার করে এনে মঞ্চে রাখা হয়। ব্যাটারি চালিত মাইক আর অ্যালমুনিয়ামের চোঙেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তারা। সবকিছুই একঘণ্টার মধ্যে সেরে ফেলা হয়েছিল।“
সাংবাদিকদের গাড়ির বহর আগে রওনা হয়েছিল, কিন্তু ভিআইপিদের গাড়িগুলি ভোরে বেরয়। দ্বিতীয় ওই বহরেই ছিলেন বিএসএফের মহাপরিচালক কেএফ রুস্তমজি, সঙ্গে গোলক মজুমদার।
কলকাতা থেকে যে গাড়িগুলো আসছিল ভিআইপিদের নিয়ে সেগুলো একটা নির্দিষ্ট চেকপোস্ট পেরনোর পরেই মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। সেই চেকপোস্টটা ছিল অনুষ্ঠান-স্থল থেকে দু ঘণ্টার দূরত্বে, লিখেছেন ঊষীনর মজুমদার।
“বেলা একটা নাগাদ ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমানগুলো সীমান্তের ওপরে টহল দিতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ, ইপিআর এবং বেসামরিক প্রহরীরা পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ সদস্যদের গার্ড অফ অনার দিতে প্রস্তুত হয়,” লিখেছেন মি. মজুমদার।
‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার দল এল নদীয়া থেকে
গোলক মজুমদার মেহেরপুর থেকে ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন একটা হারমোনিয়াম আর তবলা, নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে একদল গায়ককে আনা হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য।
কলকাতার নিউ মার্কেটের দর্জিদের দিয়ে তৈরি করে আনা হয় ‘বাংলাদেশের পতাকা’।
“এতগুলো গাড়ির ব্যবস্থা করে আমি নিজেই আটকিয়ে গেলাম নদীয়ার কৃষ্ণনগর শহরে। আমার গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে,” বলছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
তার কথায়, “সেখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে আমি পৌঁছই বৈদ্যনাথতলায়, যার নাম দেওয়া হয়েছিল মুজিবনগর। পরে দেখা গেল আমার নতুন কেনা যে গাড়িটা নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, সেটার মোবিল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে কী আমি এতবড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা দেখতে পাব না?
“ওখানে পৌঁছিয়ে দেখলাম বিরাট আমবাগানের মধ্যে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছে। জায়গাটা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের একটু ভেতরে। গোলক সাদা পোশাকে ভারতীয় সীমান্তে দাঁড়িয়ে ছিল,”জানাচ্ছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
সেদিন ভারতীয় সীমান্তের প্রান্তে গোলক মজুমদারের সঙ্গেই ছিলেন বিএসএফ প্রধান কেএফ রুস্তমজিও। সবাই সাদা পোশাকে। আরও ছিলেন ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সি আর অ্যান্ড এ ডব্লিউ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অফিসারেরা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের সীমান্তের ভেতরে, কিন্তু বৈদ্যনাথতলার কাছাকাছি এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা পুরো ব্রিগেড।
ভারতীয় বাহিনী মোতায়েনের পুরোটাই করা হয়েছিল শপথ গ্রহণের দিন, ১৭ই এপ্রিল ভোরে, লিখেছেন ঊষীনর মজুমদার।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান
ঊষীনর মজুমদার লিখেছেন, “দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত ন্যাশানাল অ্যাসেম্বলির সদস্য ইউসুফ আলি প্রথমে মাইকটা নেন। তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণা-পত্র পড়ে শোনান, যেটি বাংলাদেশের (অস্থায়ী সরকারের) সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করা হয়।“
ওই ঘোষণাপত্রেই মুজিবনগর নামটি প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে উচ্চারিত হয়।
নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে আর ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গেয়ে।
“এরপরে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। মুজিবের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক নিয়মেই নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। অন্যান্য সদস্যদের শপথ-বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলি,” লিখেছেন ঊষীনর মজুমদার।
সকলের শপথ হয়ে যাওয়ার পরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মি. ইসলাম তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী আর যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে মনসুর আলি, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, আব্দুল মান্নান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, নুরুল ইসলাম আর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এ এ জি ওসমানীকে নিয়োগ করেন সেদিনই।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কর্নেল ওসমানীই মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হন।
শপথ নিয়ে কলকাতাতেই ফিরে এসেছিলেন সবাই। অস্থায়ী সরকার কাজ শুরু করে কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িতে।
ওই বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধের শেষে ১৮ই ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা ফিরে গিয়েছিলেন তাদের সদ্য স্বাধীন দেশে।
তথ্যসূত্র:মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণের নেপথ্যে যা ঘটেছিলএ শিরোনামে বিবিসি নিউজ বাংলায় অমিতাভ ভট্টশালীর লেখা থেকে