মুসলিম শাসনামলে মেহেরপুর
আলাপচারিতা
১২০২খৃ. তুর্কি সেনানায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার এক ঝটিকা আক্রমনের মাধ্যমে বিনা রক্তপাতে লক্ষণসেনের রাজধানি নদীয়া দখল করে নিলে লক্ষণ সেন গোপন পথে নদীয়া ত্যাগ করে বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। মুসলিম শাসনামলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের দ্রুত পালা বদল ঘটতে থাকে।
১২০২ খৃ. থেকে ১৫৭৪ খৃ. পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস ক্ষমতা দখল ও পাল্টা দখলের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়। অবশেষে ১৫৭৪ খৃ. মোগল সেনাপতি মুনিম খান বাংলার সিংহাসনে আসীন দাউদ কররানিকে পদচ্যুত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলায় মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সন্নিকটবর্তী হওয়া সত্তেও রাজনৈতিক পালাবদলের এই চক্রাবর্তে মেহেরপুর কখনই পাদপ্রদীপের আলোতে আলোকিত হয়নি। ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলির মধ্যে মির্জা নাথানের বাহারস্তান-ই-গায়বিতে সেই সময়কার ঐতিহাসিক ঘটনাবলী প্রসঙ্গে মেহেরপুরের সন্নিকটবর্তী বাগোয়ানের উলেখ পাওয়া যায়। ডক্টর ইরফান হাবিবের An Atlas of Mughal Empire গ্রন্থেও বাগোয়ানের উল্লেখ আছে।
১৫৭৪ খৃ.-এর পরবর্তী সময়ে বর্তমান মেহেরপুর জেলা নিয়ে গঠিত সমগ্র অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি মাসুম মোগল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন । তার এই বিদ্রোহের সাথে ফতেহাবাদের মজলিশ কুতুব এবং মসনদ-এ-আলা ঈসা খানও যোগ দেন।
১৬০৮ খৃ.-এ ইসলাম খান বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন এবং ইহতিমাম খান ( @ মালিক আলী, মির্জা নাথান @ আলাউদ্দিন ইসফাহানি @ সিতাব খাঁর পিতা) কে মোগল নৌবহরের প্রধান (আমির-উল-বহর )করে পাঠান হয়। ঐ সময়ে সন্নিহিত অন্যান্য অঞ্চলসহ মেহেরপুর জেলা বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলির পুত্র সেনাপতি মির্জা মুমিনের জায়গীরভুক্ত ছিল। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁর নির্দেশে নৌ-বাহিনী প্রধান ইহতিমাম খান বিদ্রোহ দমন করেন এবং অবশেষে শেখ হাবিবুল্লাহ নামক একজন মোঘল সেনাপতি কর্তৃক মজলিশ কুতুবকে পরাজিত করার মাধ্যমে এই জেলার কর্তৃত্ব মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের ওপর অর্পিত হয়।
সুবেদার ইসলাম খান মোগল শাসন নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যকে দমনের জন্য সেনাপতি গিয়াস খানকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। নৌ-অধিপতি ইহতিমাম খান এবং সেনাপতি মির্জা নাথান এই অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতাপাদ্যিতের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রতাপাদিত্য চরিত গ্রন্থানুসারে জানা যায়, রামানন্দ গুহ (রামচন্দ্র) এবং তার তিন পুত্র ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দ সুলাইমান কররানির আমলে (১৫৬৫-১৫৭২ খৃ.) উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিবানন্দ কালক্রমে সুলাইমান কররানীর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে আসীন হন। ভবানন্দের পুত্র জানকী বলভ তথা বসন্ত রায়কে রাজস্ব বিভাগের প্রধান করা হয়। ভবানন্দের আরেক পুত্র শ্রীহরি সুলাইমান কররানীর পুত্র ও উত্তরাধিকারী দাউদ কররানীর (১৫৭২-১৫৭৪ খৃ.) পরামর্শক পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু দাউদ কররানীর পতন আসন্ন দেখে তারা তার পক্ষ ত্যাগ করেন এবং মেহেরপুর অঞ্চল সহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া যশোহর ও খুলনা জেলা নিয়ে গঠিত বিশাল এলাকা জুড়ে নিজস্ব জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন দাউদ কররানীর পরামর্শক শ্রীহরির পুত্র । এ অঞ্চলে মোগল অভিযানের সময়কালে রাজা প্রতাপাদিত্য তার পৈত্রিক জায়গীরকে স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তবকাৎ-ই-আকবরী ও প্রত্যাপাদিত্য চরিত সূত্রে রাজা প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গে উলেখ করেছেন , শ্রীধর বা শ্রীহরি নামক একজন বঙ্গবাসীর পরামর্শে দাউদশাহ্ (সোলায়মান কররানীর পুত্র দাউদ কররানী) মিয়াঁ লোদী খাঁকে বন্দী ও হত্যা করিয়াছিলেন। ইঁহার প্রকৃত নাম শ্রীহরি, ইনি বঙ্গজ কায়স্থ বংশজাত এবং দাউদ শাহ ইঁহাকে বিক্রমাদিত্য উপাধি প্রদান করিয়াছেলেন। শ্রীহরি বা বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য রায় পরে দক্ষিণবঙ্গে স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। রামরাম বসু-রচিত প্রতাপাদিত্য চরিতানুসারে শ্রীহরির পিতার নাম ভবানন্দ এবং তাঁহার পিতামহের নাম রামচন্দ্র।”]
মির্জা নাথানের সহযোগিতায় গিয়াস খান প্রতাপাদিত্যের পুত্র তথা যশোহরবাহিনীর প্রধান রাজকুমার উদয়াদিত্যকে যশোরের সালিকা (শালিখা)-য় পরাজিত ও আত্ম সমর্পণে বাধ্য করেন। আর এ ভাবে যশোহর রাজ্যও পরিপূর্ণভাবে মোগল কর্তৃত্বে আসে। সেনাপতি গিয়াস খানকে নববিজিত যশোহর রাজ্যের শাসন ভার অর্পণ করা হয়। মেহেরপুরও তার শাসনাধীনে চলে যায়।
ভবানন্দ মজুমদার ও নদীয়া রাজবংশ
প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের এক পর্যায়ে গিয়াস খান বাগোয়ানে উপনীত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার সহকারীদের সাথে অভিযান বিষয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করেন। এই বাগোয়ানেই মির্জা নাথানের সাথে বালভদ্র দাস নামক স্থানীয় এক হিন্দুর পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা ঘটে। বালভদ্র প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে মির্জা নাথানকে সাহায্য করেন। মির্জা নাথান বালভদ্রের সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তার বকশী পদে আসীন করেন। অভিযান শেষে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পথে মির্জা নাথান তার নৌবহর ও সৈন্য-সামন্ত সহ বাগোয়ানে শিবির স্থাপন করেন। সেখানে তিনি তার বিবাহ উৎসব উদযাপনে ব্যাপৃত হন এবং নৌবহর ও সৈন্য-সামন্তের দায়িত্ব বালভদ্রের ওপর অর্পণ করেন। এই বালভদ্র দাসই পরবর্তীতে নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
ভবানন্দ প্রসঙ্গে অন্য বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হুগলির শাসনকর্তা শাহ ইসমাইলের কানুনগো পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানকে যশোহর-রাজ প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে সহযোগিতার প্রতিদান হিসাবে সম্রাট জাহাঙ্গির তাকে ভবানন্দ মজুমদার উপাধি ও বাগোয়ান পরগণার জায়গীর দান করেন। তার জমিদারিতে মোট চৌদ্দটি পরগণা ছিল, এর আয়তন ছিল তিন হাজার এক শ’ একান্ন বর্গমাইল। এই চৌদ্দটি পরগণার মধ্যে মহৎপুর পরগণাটি ছিল প্রসিদ্ধ অঞ্চল, এই পরগণার কেন্দ্রভূমি ছিল বাগোয়ান। বস্তুত বাগোয়ানই ছিল নদীয়া রাজ-বংশের রাজধানী।
কূলগ্রন্থানুসারে তিন কায়স্থ ভ্রাতা, রামভদ্র মজুমদার, রামনাথ মজুমদার ও বাণীকান্ত রায় হুসেইন শাহ-এর আমলে (১৪৯৩-১৫১৯ খৃ.) রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। তিনজনের মধ্যে বাণীকান্তকে হুসেন শাহ পদোন্নতি দিয়ে পরবর্তীকালে রায় রায়ান পদে অধিষ্ঠিত করেন। এর ফলে বাণীকান্ত মেহেরপুর অঞ্চলে তার নিজ জমিদারি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
সম্ভবতঃ বাগোয়ান কেন্দ্রিক তার এই জমিদারিই ছিল মেহেরপুরের ইতিহাসে মেহেরপুরের ভৌগলিক সীমাবর্তী প্রথম ভুমি-রাজস্ব ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামোছিলো।
বর্তমানে বাগোয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদ। এটি ৪৮.৬৩ কিমি২ (১৮.৭৮ বর্গমাইল) এলাকা জুড়ে অবস্থিত এবং ২০০১ সালের আদমশুমারীর হিসাব অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৯,৯৮৫ জন। বাগোয়ান ইউনিয়নে মোট গ্রামের সংখ্যা ১৪টি ও মৌজার সংখ্যা ৭টি।