মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং গণহত্যা
আবদুল্লাহ আল আমিন
গোভীপুর—বাংলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতই একটি সাধারণ গ্রাম, তারপরও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের অন্তর্গত গ্রামটিতে রয়েছে নানা ধর্মবর্ণ ও পেশার মানুষের বসবাস। যুগ যুগ ধরে তারা মিলেমিশে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে বসবাস করছে। ইংরেজ আমলে এখানেপাইকারি বাজার, ফড়ের বাজার, মিষ্টির দোকান, মুদিখানা, ধোপাখানা ও স্কুল গড়ে ওঠে। গ্রামের অধিবাসীরা আমোদপ্রিয়, খেলাধূলা-গানবাজনা ভালবাসে। হাবভাব, আচার-আচরণে শহুরে মানসিকতাসম্পন্ন।এক সময় মেহেরপুর শহরের ছেলেমেয়েরাও নদী পার হয়ে গোভীপুর স্কুলে পড়তে যেত।
গোভীপুরের নিকটবর্তী বাড়িবাঁকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নদীয়ারাজ গিরীশচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ি। গত শতকের ত্রিশের দশকে গোভীপুর গ্রামের মাধব মোহান্তের (পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী সংগঠন। গোভীপুরের সন্নিকটবর্তী রাজাপুর গ্রামে তিনি একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৩৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে রাধাকান্তপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মেহেরপুর মহকুমা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন। গোভীপুর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায়, এলাকায় মুসলিম লীগেরও প্রভাব ছিল। ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য মহসিন উকিল, সাবদার আলী বিশ্বাস ও আব্দুল কাদের মিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে বুড়িপোতায় অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, বক্তৃতা করেন কবি বন্দে আলী মিয়া।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শিক্ষাবিদ সরোজ মুখার্জি, আইনজীবী তারকনাথ কুণ্ডুদের মতো সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিবান হিন্দুরা দেশত্যাগ করে। তারপরও আবুল কাশেম, সফেদ আলী মোল্লা ও কায়েম চৌধুরীদের নেতৃত্বে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার ধারাটি অব্যাহত থাকে। এদের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে গোভীপুর ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিকামী জনতার দুর্ভেদ্য দুর্গ। নানা কারণে পাকসেনারা সর্বাধিক মনোযোগ দেয় মেহেরপুরের পশ্চিমে ভৈরবের তীরবর্তী গ্রামগুলির দিকে। গ্রামগুলির অবস্থান ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় ইপিআর ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেমুক্তিবাহিনী। বেতাই ও হৃদয়পুর ক্যাম্প থেকে অগ্রসর হয়ে এরা প্রতিদিন পাকসেনাদের ওপর হামলা চালাত। এমনকি পাকসেনাদের দোসর গোভীপুরের জলিল মাস্টারকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেতাই ক্যাম্পে আটকে রাখে। তার কাছে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের মুসলিম লীগ নেতা গোলাম মোস্তফা ও ইজ্জত মিস্ত্রিকে বেতাই ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে গোভীপুর, যাদবপুর, কামদেবপুর হয়ে ওঠে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের প্রধান টার্গেট।
২৯ এপ্রিল পাকসেনাদের এক বিশাল বহর ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাদবপুর ঘাট পার হয়ে শহরের পশ্চিমে ভৈরব তীরবর্তী গ্রামগুলি আক্রমণ করে। অগ্নিসংযোগ করা হয় বসতবাড়ি, দোকানপাট, গোয়ালঘর ও হিন্দু মন্দিরে। আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্মীভূত হয় গ্রামের প্রতিটি খেড়োঘর ও টিনের চালা। সেদিন লুটতরাজে অংশ নেয় গোভীপুরের বাদল, ইউসুফসহ মেহেরপুর শেখপাড়ার রাজাকারা। এই তাণ্ডবলীলায় নেতৃত্ব দেন মেহেরপুরের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা মাহাতাব খাঁ। ওই দিন গ্রামে মাত্র ১৫০/২০০ জন নিরীহ মানুষ অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে ৯ জন সাধারণ মানুষকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। থানায় এনে চালানো হয় অমানুষিক অত্যাচার।বন্দিদের দু-একজন ‘পানি পানি’ বলে কাতরালে মিলিটারিরা প্যান্টের বোতাম খুলে হাসতে হাসতে ওদের মুখে প্রস্রাব করে দেয়। মেছের আলী নামক এক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়া হলেও অপর ৮ জনকে পেটাতে পেটাতে কোর্ট বিল্ডিং-এর সামনে আমগাছের কাছে নিয়ে আসা হয়। তারপর কাউকে উলঙ্গ, কাউকে অর্ধউলঙ্গ করেপাশাপাশি বেঁধে রাখে। সে এক অবমাননাকর দৃশ্য! একই গ্রামের অধিবাসী, পরস্পর আত্মীয় ও পরিচিতজন। লজ্জায়-অপমানে সবাই তখন মাথা নিচু করে থাকে। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারে না। এরপর মেশিনগান দিয়ে গুলি করেহত্যা করা হয় একে একে। সেদিন যাদের হত্যা করা হয় তারা সবাই ছিলেন কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান ও সাধারণ মানুষ। সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমান। এরা কেউ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতেন না, তবে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করতেন। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, লাশগুলো কোর্ট বিল্ডিং-এর সামনের আমগাছে কয়েকদিন ঝুলিয়ে রাখা হয় জনমনে ভীতি সঞ্চারের জন্য। পরে কাফন ও জানাজা ছাড়াই মাটিচাপা দিয়ে পুঁতে ফেলা হয়।কোর্ট বিল্ডিং প্রাঙ্গণে যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন তারা হলেন: ১. তাহেরউদ্দিন, পিতা: এলাহী বকসো, ২. আবদুল জলিল, পিতা : হারান শেখ, ৩. নুর ইসলাম, পিতা : আবদুল জলিল, ৪. শুকুর উদ্দিন শুকলাল, পিতা: ভূতনাথ মন্ডল, ৫. গিরিশ শেখ, পিতা: জাদু শেখ, ৬. আবদুর রহমান, পিতা: জোহর মিয়া, ৭. খোদা বকসো, পিতা: এলাহী বকসো, ৮. দুলাল, পিতা: ফকির মোহাম্মদ।
২৯ এপ্রিলের তাণ্ডবলীলার প্রত্যক্ষদর্শী গোভীপুর গ্রামের শাহনেওয়াজ হোসেন (৭০), মুক্তিনাথ বিশ্বাস (৭২), জিল্লুর রহমান (৭০),বিশ্বনাথ কর্মকার (৭০), আফসোস আলী (৭২), সমীর কুমার বিশ্বাস (৬৫), রঞ্জিত কুমার দাস (৬৬) প্রমুখ আজও বেঁচে আছেন।
অবসরপ্রাপ্ত তহসিলদার শাহনেওয়াজ হোসেন তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭১ সালে সে নজরুল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা গোভীপুর আক্রমণ করে আনুমানিক বেলা ১১ টার দিকে। গুলির শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা পালাতে থাকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঘরবাড়ি, দোকানঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিছুদিন পর জানতে পারি, পাকসেনারা গ্রামের ৮ জনকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে আব্দুর রহমান ছিল ছাত্র আর নূর ইসলাম প্রতিবন্ধী। অনেকদিন পর্যন্ত ওদের বিকৃত, রক্তাক্ত ও থেঁতলানো লাশ পড়ে থাকে কোর্ট বিল্ডিং চত্বরে। মুসলিম লীগ নেতা মাহাতাব খাঁ, কাবাতুল্লাহরা গোভীপুর, যাদবপুর ও কামদেবপুরের তাণ্ডবলীলা এবং এই হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন জোগায়।
মুক্তিনাথ বিশ্বাস (৭২) বলেন, ১৯৭১-এ হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায়। আমরাও তেহট্টে মামাবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। বিনয়কৃষ্ণ মোক্তার সপরিবার ঘরবাড়ি ফেলে কৃষ্ণনগরে চলে যান। তিনি রাজনীতি করতেন, পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তিনি।
সমীর কুমার বিশ্বাস তার সাক্ষ্যে বলেন, ওই দিন পাকসেনারা আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম, সফর আলী মোল্লার বাড়ি আক্রমণ করে। ২৫ টি হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। হিন্দুরা গ্রামে ছিল না, তবে তাদের গরু-বাছুর গোয়ালেই ছিল। পাকসেনাদের সহায়তা করে বাদল নামের এক কুখ্যাত রাজাকার। আওলাদ নামের যাদবপুর খেয়া ঘাটের মাঝিও ছিল পাকবাহিনীর সহায়তাকারী। তার হাতে সব সময় রাইফেল থাকতো। বিজয়ের প্রাক্কালে আওলাদ মাঝি জনরোষের শিকার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সে প্রাণ হারায়।
বিশ্বনাথ কর্মকার তার সাক্ষ্যে জানায়, ২৯ এপ্রিলের তাণ্ডবলীলায় আমাদের ঘরবাড়ি, কামারশালা পুড়ে ভস্মীভূত হয়। যুদ্ধের সময় আমরা আর গাঁয়ে ফিরতে পারিনি। আমাদের ভিটেতে স্থানীয় রাজাকাররা সর্ষের আবাদ করে। যাদের মেরে ফেলা হয়, তাদের সবাইকে আমি চিনতাম।
রঞ্জিত কুমার দাস তার ভাষ্যে জানায়, আমি মুক্তিযোদ্ধা নই,কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করেছি। মিলিটারি আর রাজাকাররা আমাদের দাসপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দিলে আমি পালিয়ে যায়। মেয়েদের সাথে অশোভন আচরণ করা হয়। কয়েকজন মিলিটারি এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছিল। পাকসেনারা যাকে যেমন ইচ্ছা গালি-গালাজ করছিল।‘ ইয়ে শালালোগ মুক্তি হ্যায়। শালা শুয়ারকা বাচ্চা, হিন্দুকা লাড়কা, মালাউন হ্যায়। হামলোগ আদমি নেহি মাংতা, যামিন মাংতা। শালালোগ, ইন্ডিয়াকা এজেন্ট হ্যায়। ইয়ে শালে, আভি কাঁহা হ্যায় তুমহারা মুজিব বাপ?
নিহত দুলাল শেখের শ্যালক আফসোস আলী সাক্ষ্যে বলেন, দুলাল শেখ ছিলেন আমার গার্ডিয়ান। তার বাড়িতেই আমি থাকতাম। ১৯৭১ সালে গ্রামের মানুষ তেমন রাজনীতি বুঝতো না। দুলাল ভাইও রাজনীতি বুঝতো না, চাষাবাদ করতো। সে ছিল খুবই পরহেজগার ব্যক্তি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, প্রতিদিন কোরান তেলওয়াত করতো। মরার আগেও তার বুকপকেটে একটি কোরান শরিফ ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবার সাপ্লাই করতো, শেল্টার দিত। মুক্তিযোদ্ধা কায়েম চৌধুরী, আক্কাস আলি, আকবত, হাফেজ মাহাতাব আলি আনসার, সবুজ, আমিন, ওজুতের সঙ্গে দুলাল শেখের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত গোভীপুরের মানুষের বীরোচিত অবদান আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে। ২৯ এপ্রিল যারা গণহত্যার শিকার হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে জেলাপ্রশাসন কার্যালয় প্রাঙ্গণে। কিন্তু শহীদদের স্মরণে কোন নামফলক স্থাপন করা হয়নি। গণহত্যার মূল হোতারা প্রায় সবাই মারা গেছে। এ ব্যাপারে কোন মামলাও হয়নি।
লেখক:আবদুল্লাহ আল আমিন: সহযোগী অধ্যাপক,মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।