স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ও ভবিষ্যতের দায়
মো.জাকির হোসেন
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক ক্রমশই বয়সী ও জোরালো হয়ে ওঠছে । আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ, ইতিহাস, পররাষ্ট্রনীতি অনেক কিছুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এ বিতর্কের। এ বিতর্ককে ঘিরে আমাদের মাঝে বিভক্তিও স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ জড়িয়ে রয়েছে এ বিতর্কের সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে। ফলে দণ্ডিত ও বিচারাধীন স্বাধীনতাবিরোধী ১১ হাজার ব্যক্তি জেল থেকে বেরিয়ে আসে। এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের যারা হত্যা করেছে, কন্যা-জায়া-জননীদের ধর্ষণ করেছে, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করেছে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ যারা রুদ্ধ করে দিয়েছিল তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আমাদের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ নং অনুচ্ছেদে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ সংগ্রাম ও বিশাল আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালির এ অর্জন। এক লহমায় এটি হয়নি। দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ ও দুরূহ এ চ্যালেঞ্জের সফল সমাপ্তি হয়েছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন-
“মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের একদিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তার লক্ষ্য ছিল।”
বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের নাম লেখাতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি একাট্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। বাঙালিকে এককাতারে নিয়ে আসা সহজ কাজ ছিল না। শারীরিক গঠন-ভাষা, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মিল সত্ত্বেও বাঙালির ধমনিতে রয়েছে অস্ট্রিক, মোঙ্গলীয়, দ্রাবিড়, আর্য, পাঠান, মোগল, ইরানি তথা বিচিত্র রক্তের স্রোতধারা। বাঙালি সমাজে ধর্মীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সামাজিক কুসংস্কার, সংকট-লোভ, দাসত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা বার বার আঘাত করেছে।
বাঙালির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঠিকানা ও পরম আত্মীয় বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, তারা বিশ্বাসঘাতক বাঙালি। বাংলার নবাব সিরাজের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্লাইভের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ ও ঘসেটি বেগমরা।
বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা একত্রিত হলেও মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাই কেবল করেনি, বরং স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বাঙালি নিধন করেছে, লাখ-লাখ কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রম হানিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ বলতে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ও ‘বাংলাদেশবিরোধী শক্তি’, ‘পাকিস্তানের দোসর’, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি’ এ শব্দগুলো উচ্চারিত হলে আমাদের মানসপটে যেসব রাজনৈতিক দলের নাম ভেসে ওঠে, সেগুলো হলো- জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। এসব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি যেসব সহযোগী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত তারা হলো- শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনী। সংগঠনের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আমাদের কাছে অতি পরিচিত। এরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মুক্তিকামী মানুষের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রয়াত গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, চৌধুরী মঈনুউদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান প্রমুখ।
প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতাকারী এসব দল ও মানুষগুলোই কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ, না আরও রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি রয়েছে? কী মানদণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারিত হবে? স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতাকারী এসব দল ও মানুষদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ? স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ, লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত ছিল ১৯৭২ সালে দালাল আইনে তাদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ওই বছর ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ জারি করা হয়। দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের জন্য সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর তাদেরকে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এতে ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজার ছাড়া পান। ১১ হাজারের বেশি আটক ছিলেন। বিচারে মৃত্যুদণ্ডসহ অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে। ফলে দণ্ডিত ও বিচারাধীন স্বাধীনতাবিরোধী ১১ হাজার ব্যক্তি জেল থেকে বেরিয়ে আসে। এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের যারা হত্যা করেছে, কন্যা-জায়া-জননীদের ধর্ষণ করেছে, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করেছে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ যারা রুদ্ধ করে দিয়েছিল তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আমাদের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ নং অনুচ্ছেদে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়।
সংবিধান সংশোধন করে যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলকে এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী, মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনা জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীরা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? আর ঘাতকদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের? বঙ্গবন্ধুর ঘাতক হিসেবে প্রধানত খুনি ফারুক রহমান, রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ, একেএম মহিউদ্দিন, আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আবদুল মাজেদ সমধিক পরিচিত।
অপরদিকে, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রী হিসেবে অন্যদের পাশাপশি খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন মোশতাক যতই ষড়যন্ত্র করুক তার ষড়যন্ত্র সফল হতো না যদি না সেনাবাহিনীর মধ্যমসারির কিছু কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। আর মোশতাক ও মধ্যমসারির সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র এগিয়ে নিতে ও বাস্তবায়ন করতে পারত না যদি জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করতেন।
১৯৭৬ সনের ২১ এপ্রিল ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় খুনি আব্দুর রশিদের বয়ান, ওই বছরেরই ৩০ মে ‘দ্যা সান ডে টাইমস’-এ প্রকাশিত খুনি ফারুক রহমানের বিবৃতি, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে আইটিভি টেলিভিশনে World in Action প্রোগ্রামে রশিদ ও ফারুকের সাক্ষাৎকার, মাসকারেনহাসের বই ‘Bangladesh- A Legacy of Blood’, মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজের ‘Anatomy of A Coup’, অশোক রায়নার বই ‘Inside RAW: The Story of India’s Secret Service’, ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির বই ‘India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan (A Political Treatise)’, সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্তর বই ‘মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক উপ-চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম লিখিত গ্রন্থ ‘Making of a Nation Bangladesh- An Economist’s Tale’ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি ও সাক্ষীদের প্রদত্ত জবানবন্দিতে জিয়ার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সকল তথ্য-প্রমাণই অসত্য, তাহলে প্রশ্ন হলো, জিয়া কেন খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, অন্য কেউ যাতে ব্যবস্থা নিতে না পারে সেজন্য তাদের দায়মুক্তিকে পাকাপোক্ত করতে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত কেন করলেন? খুনিদের বাঁচাতে হত্যার বিচার চাওয়ার পথ সাংবিধানিকভাবে রুদ্ধ করতে কী স্বার্থ ছিল জিয়ার? কী দায়বদ্ধতার কারণে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জিয়া খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিলেন? কী কারণে খুনিদের প্রতি জিয়ার এ ভালোবাসা, সহানুভূতি? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণভোমরাকে হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা, তাদের লালন-পালন কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না বিপক্ষের কাজ?
আমাদের শ্রেষ্ঠতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মাইলফলক ছেষট্টির ৬-দফা, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তথা যুদ্ধকালীন সংবিধান ও মুজিবনগর সরকার। যারা মুক্তিযুদ্ধের এসব মাইলফলক স্মরণ ও স্বীকার করে না তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে?
প্রথমবারের মতো ৭ মার্চ পালনের নামে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে যারা ৭ মার্চের মাহাত্ম্যকে খাটো করে ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার হীন অপচেষ্টা করে তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? বিএনপি নেতারা বলছেন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় হতাশ হয়েছেন। এই বক্তৃতায় তেমন কিছু খুঁজে পাননি তারা। অথচ সত্যিটা হলো, ৭ মার্চের ভাষণের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে নিউজউইক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ আখ্যা দিয়ে তাদের নিবন্ধ ‘দ্যা পয়েট অব পলিটিক্স-এ লিখেছিলো-
“৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা”।
৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেরণাদায়ী ভাষণসমূহের একটি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ Jacob F. Field বিশ্বের সবচেয়ে উদ্দীপক ও অনুপ্রেরণীয় বক্তব্যগুলো একত্রিত করে ‘We Shall Fight on the Beaches : The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে যে সংকলন প্রকাশ করেছেন সেখানে সিসেরো থেকে উইনস্টন চার্চিল এবং আব্রাহাম লিংকন থেকে মাও সে তুং এর ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন-
“৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল”।
ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন-
‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা”।
১৯৭১ সালে রয়টার্স তার প্রতিবেদনে বলেছে-
“বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে”।
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন-
“শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল”। অপরদিকে, টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়-
‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল”।
এএফপি তার বিশ্লেষণে বলেছে-
“৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে”।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়-
“শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে”।
মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অবমাননা, অবমূল্যয়ন যারা করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে?
২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ফলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২৭ মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও তাকে আটকের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মধ্যে অন্যতম হলো, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান, ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, নিউইয়র্ক টাইমস, আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ড, ব্যাংকক পোস্ট, বার্তা সংস্থা এপি। এছাড়াও ভারত, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের বহু সংবাদপত্রের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। উদাহরণস্বরূপ সে সময়ের দু’য়েকটি সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করছি- নিউইয়র্ক টাইমস-এ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপিয়ে পাশেই লেখা হয় “স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক”, ব্যাংকক পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে”, ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: “…ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।”
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ০৩ মিনিটে ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন্স গ্রুপ’-এর একটি সভা ডাকেন। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সিআইএ, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সূত্রে সভায় এই মর্মে অবহিত করেন, পাকিস্তান সামরিক শাসক কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র সময় ২৫ মার্চ দুপুর ১টায় মুজিবুর রহমানকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার সময় তার দু’জন সমর্থক নিহত হন। গ্রেপ্তারের আগে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে একটি গোপন রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠার আইনগত দলিল হলো ৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তী সংবিধান। এরই ভিত্তিতে পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ ও গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও এই ঘোষণাপত্র সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন দেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংবিধান হিসেবে এর কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে। এই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান ও সে ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ঘোষণায় উল্লেখ রয়েছে-
…“বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান”।
ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে-
“বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্ণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; … আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে”।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করা বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্ত্বাকে অস্বীকার করার শামিল। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার সপক্ষে দেশ-বিদেশে অসংখ্য দলিল থাকলেও বিএনপি তা মানতে নারাজ। আদালতের রায়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃত হলেও বিএনপি সে রায়কেও অবজ্ঞা করে জিয়াকেই ঘোষক বলে দাবি করছে। সাবেক বিএনপি নেতা বর্তমান এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ তার রচিত ‘Revolution, Military Personnel and The War of Liberation in Bangladesh’ গ্রন্থে তার চাকরিকালীন বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন সংযোজন করেছেন। গোপনীয় প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রয়াত বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী। তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার মীর শওকত আলী, অলি আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন-
“He in fact was the first officer who took risk and on his own initiatives informed Gen. Ziaur Rahman regarding declaration of Independence on night 25/26 March 71”.
যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বস্তুত তিনিই প্রথম কর্মকর্তা যিনি ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগে একাত্তরের ২৫/২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অবহিত করেন’।
মীর শওকতের এই প্রতিবেদনটি পরবর্তী সিনিয়র অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেই সত্যায়িত করেছেন। তারপরও সত্যকে অস্বীকার, জিয়াকে ঘোষক দাবি বিএনপির। স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত ও তাকে সপরিবারে হত্যায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার নানা প্রমাণ মেলে। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে পাকিস্তান জিয়ার মিত্র হলো কেন? জিয়ার সরকার উৎখাত করতে ষড়যন্ত্র দূরে থাক, জিয়া বাংলার মসনদে গদিনশীন হওয়ার পর পাকিস্তান বিশাল সাহায্য নিয়ে জিয়ার সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলো। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে তার প্রতি পাকিস্তানের এত দরদ কেন?
২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার কারণে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে কার ঘোষণার কারণে বিএনপি ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন করে? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীরা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের?
যারা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চালু করেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ চালু করেছে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিরুদ্ধে জিয়াকে ঘোষক দাবি করছে, মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিরুদ্ধে বিকৃত ইতিহাস দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক ৭ মার্চের ভাষণকে অবমূল্যায়ন করছে, যারা লাখো শহিদের রক্তমূল্য ও কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রমের চড়া মূল্যে পাওয়া পতাকাকে স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে অবমাননা করেছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম-নির্যাতনের ইতিহাস আড়াল করতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে যারা সংবিধানের প্রস্তাবনার ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’-এর পরিবর্তে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ শব্দাবলি যুক্ত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তন করেছে, প্রজ্ঞাপন জারি করে যারা বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করেছিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীসহ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তির বদলে যারা সুরক্ষা দিয়েছে, পুরস্কৃত করেছে, যারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির আইনগত দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করে, যারা বাঙালি জাতির অবসিংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রাণভোমরা বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান-অস্বীকার করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, না বিপক্ষে সে সিদ্ধান্ত এ দেশের জনগণকেই নিতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশাতেই যদি স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক, রাষ্ট্রের স্থপতিকে অস্বীকার আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নামে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়, যখন একজন মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে থাকবেন না, তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সংগ্রাম কতটা কঠিন হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।নিউজ বাংলা ২৪.কম থেকে সংগৃহীত