দেশে দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া নানা ব্র্যান্ডের পোশাক। চ্যালেন্জের মুখে পড়ল বাংলাদেশ। ‘স্বাস্থ্যঝুঁকির’ অজুহাতে এসব পোশাক বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে বিক্রেতাদের। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
কানাডা সরকার বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া জর্জ ব্র্যান্ডের ২ লাখ ১৬ হাজারের বেশি পোশাক ক্রেতাদের কাছ থেকে ফেরত নিতে বলেছে বৈশ্বিক চেইনশপ ওয়ালমার্টকে।
এসব পোশাকের ব্যাপারে কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, জর্জ ব্র্যান্ডের রাতে পরার পোশাকের জিপারের বর্ধিতাংশ ভেঙে যেতে পারে এবং পায়ের ও গলার গ্রিপ বারবার ধোয়ার ফলে চেপে যেতে পারে, যা ওই পোশাক পরা ব্যক্তির দম বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
গত ৩ অক্টোবর কানাডা সরকার সে দেশের সরকারি ওয়েবসাইটে এ ব্যাপারে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়া জর্জ ব্র্যান্ডের এসব পোশাক ওয়ালমার্টে ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রাহকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ওয়ালমার্টে বিক্রির জন্য জর্জ ব্র্যান্ডের এই পোশাকগুলো তৈরি হয়েছে গাজীপুরের ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেড নামের একটি কারখানায়।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুন মাসের দিকে পোশাকগুলো সরবরাহ দেওয়া হয়।
পোশাকগুলোর ত্রুটি নিয়ে ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কানাডায় ওয়ালমার্টকে সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়িং হাউস পিডিএস-ফারইস্ট লিমিটেড আমাদের কাছে যে মান ও গুণের পণ্য চেয়েছিল, আমরা তাদের সেই মানের পণ্য সরবরাহ করেছি। এখানে যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, সেটি পিডিএস থাকতে পারে, এখানে আমাদের কোনো দায় নেই।’
এ বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে এবং গ্রাহকদের ফেরত দিতে বলা হয়েছে-এমন দেশগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাস।
প্রায় একই ধরনের অভিযোগ তুলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯টি দেশ তাদের বাজার থেকে বাংলাদেশি বিভিন্ন পোশাক তুলে নিয়েছে।
পোশাকগুলোর ত্রুটি নিয়ে ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে গণমাধ্যম। প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কানাডায় ওয়ালমার্টকে সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়িং হাউস পিডিএস-ফারইস্ট লিমিটেড আমাদের কাছে যে মান ও গুণের পণ্য চেয়েছিল, আমরা তাদের সেই মানের পণ্য সরবরাহ করেছি। এখানে যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, সেটি পিডিএস থাকতে পারে, এখানে আমাদের কোনো দায় নেই।’
বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক নীতি সহায়তা প্রদান করা সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্যমতে, কানাডা ছাড়াও চলতি ২০২৩ সালে ১১টি দেশের বাজার থেকে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। এর কারণ হিসেবে একেক দেশে একের ধরনের অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে। আবার অনেক দেশে বিক্রীত পোশাক গ্রাহকদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে তাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওইসিডির তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পোশাক পরার কারণে শ্বাসরোধ ও আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা, ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে আগুনের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি, পোশাকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ থাকা, আগুন প্রতিরোধী মান নিশ্চিত না হওয়া প্রভৃতি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি এই ব্যাপারে জানি না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যেসব অভিযোগ করেছে, সেগুলো আমাদের দিক থেকে হয়নি।’
শহীদউল্লাহ আজিম আরও বলেন, ‘পোশাক জাহাজে ওঠার আগে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে ল্যাব টেস্ট করা হয়। যদি কোনো ক্ষতিকর পদার্থ থাকে, তাহলে সেটা বায়াররা নিত না। পোশাকের সাইজসহ কাপড়ের বিষয়গুলো ক্রেতার দেওয়া বিবরণ অনুসারে করা হয়।’
ওইসিডির তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক জনস্বার্থে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ২০২২ সালে এই রকম ঘটনা ঘটেছে চারবার এবং ২০২১ সালে পাঁচবার। আর চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১২টি ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশ দিয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো বিস্মিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে একটা ঘাপলা আছে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির আগে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়।
পোশাকে কোনো রাসায়নিক পদার্থ ও জীবনের জন্য হুমকি আছে-এমন কোনো কিছুর উপস্থিতি পাওয়া গেলে ক্রেতারা নিশ্চয়ই জাহাজীকরণের আদেশ দিত না। এখন পণ্য বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর ফেরত দিতে বলাটা খুবই সন্দেহজনক। এর পেছনে অন্য কিছু থাকতে পারে।