১৯৭১ ঢাকার কয়েকটি দুর্গ
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় গেরিলা অপারেশন চালানো কঠিন ব্যাপার ছিল। অস্ত্র বিস্ফোরক রাখার জায়গা দরকার ছিল। মেলাঘরে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিবাহিনীর আরবান গেরিলাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে কয়েকটি পরিবার। গড়ে ওঠে কয়েকটি দুর্গ… লিখেছেন হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক
১নং টেনামেন্ট হাউস
মুক্তিবাহিনী যখন ঢাকায় প্রথম অ্যাকশন শুরু করে তখন আশ্রয় ছিল কয়েকটা মাত্র। ১নং টেনামেন্ট হাউস একটি। সেখানে যে থাকতো তার পুরো নাম এএসএইচকে সাদেক। সাদেক সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কিছুদিন আগে বিলাত থেকে ফিরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NIPA)-এর মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন। এই বাড়িটির স্থাপনা বেশ অদ্ভুত ছিল। বাইরে থেকে দেখলে ভেতরের কোনো কিছু সম্পর্কেই তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যেতো না। আদমজী গেস্ট হাউসের পেছনেই (স্বাধীনতার পর পদ্মা গেস্ট হাউস হয়েছে) অবস্থিত ছিল বাড়িটি। ১ নম্বর টেনামেন্ট হাউস-এ তিনটা বেডরুম, একটা ড্রয়িংরুম, ডাইনিং রুম, রান্নাঘর তো ছিলই। গ্যারেজ ও কাজের লোকদের জন্যে আলাদা থাকার জায়গা। বাড়ির পেছনদিকটায় বিশাল বাগানটার কোনো অংশই সামনে থেকে দেখা যেতো না। দক্ষিণ দিকের বাউন্ডারি ওয়াল থেকে এলিফেন্ট রোডে যাবার একটা পথও ছিল। বাউন্ডারি ওয়ালের কারণে বিল্ডিংটাকে আলাদা করার কোনো কারণ ছিল না। পিডব্লিউডি’র হলুদ সরকারি কলোনির মত আরেকটি দালান। একেবারে সাদামাটা, স্বাভাবিক।
ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের একজন এ মাসুদ সাদেক (চুদু ভাই) তার ভাই এএসএইচকে সাদেকের সাথে থাকতেন। তিনি বাড়িটিতে তার স্ত্রী, দুই সন্তান, মা আর দু’জন কাজের লোক নিয়ে থাকতেন।
সাদেক সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সেজো ভাইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। এই নিপাট ভদ্রলোকটির প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব ছিল। পাশাপাশি তিনি আশপাশের কোনো ব্যাপারে
তেমন একটা নাক গলাতেন না। এই ফর্সা। সুদর্শন লোকটি ক্রমশ বড় ভাই সুলভঅভিভাবকের মত হয়ে উঠলেন। তার সন্তান দু’জন তানভীর (৬/৭) আর নোরীন (২/৩ বছর) আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলো। চাচ্চু ভাইয়ার (চুন্নু ভাই) ভাইপো ভাইঝি যেন আমাদেরও ভাই।
অনেক সময়েই তাড়াহুড়ার মধ্যে কোনো কাজে যাচ্ছি বা কোনো খবর দরকার। এর মধ্যে খাবার দরকার হলো বা বিশ্রাম নিতে হবে- নির্দ্বিধায় ভাবিকে জ্বালাতন করতে চলে যেতাম (মিসেস সাদেক)। আমাদের উপস্থিতিতে তিনি যেন কখনোই অস্বস্তিবোধ করতেন না বা বিরক্তও হতেন না। বাড়ির সামনে পেছনের বাগানটা ভাবি নিজে পরিচর্যা করতেন। আমাদের হাত থেকে সেই বাগানটুকুও রক্ষা পায়নি। অস্ত্র-গোলাবারুদ রাখার জন্যে ব্যবহার করতাম আমরা জায়গাটিকে।
সেজো ভাইয়া আমাদের অ্যাকশন নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন কিন্তু খুঁটিনাটি কিছু জানতে চাইতেন না। মাঝে মাঝে সরকারি উচ্চমহলের বিভিন্ন খবরাখবর জানাতেন। আমাদের খুব সতর্ক থাকতে বলতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা তার বাড়িতে কি নিয়ে যাচ্ছি বা রাখছি তা কখনো জানতে চাননি। অবশ্য ‘আরবান গেরিলা’দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন তা তিনি ভালই বুঝতেন।
এএসএইচকে সাদিক এক অদ্ভুত লোক ছিলেন। কখনো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতেন না। আমাদের হুটহাট করে হাজির হওয়ায় তিনি এতোটুকুও বিরক্ত হতেন না। আমাদের জন্যে কিন্তু সেটা একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। কারণ ধানমন্ডির বহু উচ্চবিত্ত বাঙালিরই ওরকম পরিস্থিতিতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হতো। আমরা কোনো কারণে উত্তেজিত বা অস্থির থাকলে আমাদের সাথে
কথা বলতেন। চা-কফি খাইয়ে মাথা ঠান্ডা করাতেন। উপদেশের সুরে বলতেন, ‘এখনো অনেকটা পথ বাকি, সাবধানে থেকো, আর মাথা গরম করে কিছু করে বসো না। মনে রাখবে, তোমরা এই তরুণরা কিন্তু একটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছো। ১ নং টেনামেন্ট হাউস। চুলু তাই, সাদেক সাহেব আর তার পরিবারের প্রত্যেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র রাখতে রাজি হন। এক মুহূর্তের জন্যেও কেউ দ্বিধা করেনি। তাদের উচ্চতা সবাইকে স্বচ্ছন্দে রাখতো। আমাদের পক্ষের শক্তির নির্বাক সমর্থন ছিল যেন সেটা। এমনকি ১৭ডিসেম্বরেও আমরা সেখানে আর্মির পেট্রোল ভরা ১৪০টি চার গ্যালনী জেরিক্যান রেখেছিলাম। মুক্তিবাহিনীর গাড়ির জ্বালানি হিসাবে খুব দরকার ছিল।
এএসএইচকে সাদেক তার সমসাময়িকদের কাছে বা সহকর্মীদের সাথে হয়তো বন্ধুর মত ছিলেন। আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) কাছে সেজো ভাইয়া শুধু একজন বন্ধুই ছিলেন না, বড় ভাই ও অভিভাবকও ছিলেন। ১ নং টেনামেন্ট ঢাকা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো ভুলতে পারবে না।
ধানমন্ডি, ২৮ নম্বর
থ্রি এম-রিকার, সিনেস্টোর একটি ওষুধ কোম্পানি। আমেরিকান কোম্পানির অফিস ছিল ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোড, ১২ নম্বর বাড়িতে। অফিসটি এ মাসুদ সাদিকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনিই পূর্ব পাকিস্তানে কোম্পানিটির প্রধান ছিলেন। কোম্পানির ম্যানেজার আতিকুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার কারণে চলে গিয়েছিলেন। মাসুদ সাদিক আসলে আর কেউ না আমাদের চুন্নু ভাই। সেই ঐ কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন।
চুললু ভাই ছাড়া আরো দুজন আমাদেরকাজের সাথে জড়িত ছিল। পিওন জামান। আর মালি মতিন। এই দু’জন দারুণ কাজের ছিল। পুরো অফিসে কোথায় কি হচ্ছে আর চুলু ভাইয়ের কখন কি দরকার দু’জন ঠিক বুঝতো আমাদের এটা খুবই অবাক করে দিতো। এই দুজনের অবদান অনস্বীকার্য বলা যায়। কারণ ওদের সাহায্য ছাড়া ঐ অফিসে আমাদের থাকাও অসম্ভব হতো। এরা আস্তে আস্তে আমাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে লাগলো। এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অংশই হয়ে গেল বলা যায়। ২৮ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির মালিক ছিল দিলারা হাশেম। তিনি সংবাদ পাঠিকা হিসেবে বহুল পরিচিত ছিলেন। আবার ‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর’-এ তিনি কণ্ঠও দিতেন। আইয়ুব খানের আমল থেকে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। নিয়ন্ত্রণ করতো কেন্দ্রীয় পাকিস্তানি সরকার। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত চলেছিল অনুষ্ঠানটি। বাইরে সদর দরজায় টাঙানো কাল সাইনবোর্ডটা কোম্পানির নামতো ঘোষণা করতোই, পাশাপাশি একটি আমেরিকান কোম্পানির অফিস-কাম বাড়ি হিসাবে এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নজর থেকেও বাঁচতো।
একতলা বাড়িটির সবচেয়ে বড় সুবিধার একটি ছিল পূর্ব পশ্চিম দুই দিক থেকেই এখানে পৌছানো যেতো। যেকোনো মুক্তিযোদ্ধা ২৭ নম্বর হয়ে ২৮ নম্বর রোডে আসতে পারতো। বিরাট উঠানের কারণে অফিস বাড়িটার চেহারা একটু অন্যরকম লাগতো। মুক্তিযোদ্ধারা অফিসের ‘বাড়ি’ অংশটুকু ব্যবহার করতো। তিন রুম, একটা ডাইনিং রুম আর নেট ঘেরা বারান্দা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অতি পার্থিব মনে হতো। অফিসের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম দালানের সামনের দিকেই চলতো।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি মুক্তিযোদ্ধারা এ জায়গাটি নিয়মিত ব্যবহার করা শুরু করে। এর কথা কোনো মুক্তিযোদ্ধাই ভুলে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। মোখতারের ছোট ভাই মুকলেস বুকে গুলি খাওয়ার পর এখানেই তার চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তার আজিজুর রহমান নিজেই তার চিকিৎসা করেন। দুই-তিন সপ্তাহ চিকিৎসার পর সে আবার শ্যামপুর ফেরত যায়।
জুলাইয়ের পর থেকে এখানে যারা নিয়মিত থাকতাম তাদের মধ্যে ছিল স্বপন, বদি, কামালুদ্দিন, শাহাদত আর আমি। কখনো কখনো আমু আর হ্যারিসও আমাদের সাথে দুয়েক রাত কাটিয়ে যেতো। এ আশ্রয়টিতে থাকাকালীন আমরা কয়েকজন
মুক্তিযোদ্ধা আরো আপন হয়ে গেলাম। শাহাদত চৌধুরীর ছোটবেলা থেকে বই পড়া আর লেখালেখির অভ্যাস ছিল। আমার ইংরেজি উপন্যাসে আগ্রহ ছিল। আমরা ওখানে বইপত্র নিয়ে যেতাম পড়বার জন্যে। কিন্তু আমাদের দু’জনকেই অবাক করে দিলো বদি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর নামডাক ছিল অন্য কারণে। দেখলাম বাংলা ইংরেজি যেই বইই বদির হাতে পড়তো সে পড়ে শেষ করতো আর তারপর সেখান থেকে আবৃত্তিও করতে পারতো। একেবারে বুভুক্ষু পড়ুয়া ছিল বদি। এ বইপড়া অভ্যাসের জন্যে আমাদের তিনজনের বেশ খাতির হয়ে গেল। মে থেকে ২৯ আগস্টের অপারেশনে যারা জড়িত ছিলাম সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের এখানকার দিনগুলো, রাতগুলো চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আলতাফ মাহমুদ, ৩৭০ রাজারবাগ
আলতাফ মাহমুদের পরিবার আর শ্বশুর-শাশুড়ি একসাথে থাকতেন। আউটার
‘সেজো ভাইয়া আমাদের অ্যাকশন নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন কিন্তু খুঁটিনাটি কিছু জানতে চাইতেন না। মাঝে মাঝে সরকারি উচ্চমহলের বিভিন্ন খবরাখবর জানাতেন। আমাদের খুব সতর্ক থাকতে বলতেন’
সার্কুলার রোডের ৩৭০ রাজারবাগের উল্টোদিকে বিখ্যাত টিনশেডের পুলিশ ব্যারাক অবস্থিত ছিল। পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ হয় রাজারবাগের এই পুলিশ লাইন থেকেই। আমাদের পুলিশ বাহিনী সেই রাতে অসম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। নিজেদের অবস্থান ধরে না রাখতে পারলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদের কাছেই প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আলতাফ ভাইদের বাড়িটা রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই। কি হচ্ছিল সবই নাকি দেখা গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। বেশ কয়েকজন পুলিশ ঐ বাড়িটির ছাদে অবস্থান নেয়। আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদেও আরো কিছু পুলিশ ছিল। কিন্তু পুরো পুলিশ লাইনে আগুন জ্বালিয়ে দিলে তারা বুঝতে পারে আর লাভ নেই। ছাদ থেকে নেমে আলতাফ ভাইদের সিভিলিয়ান কাপড়ের জন্যে অনুরোধ করে। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে অস্ত্রগুলো বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলে চলে যায় আর আলতাফ ভাইদের বলে যায় তারা যেন পুলিশের ইউনিফর্মগুলোর কোনো একটা
ব্যবস্থা করে ফেলে। ওরা সবাই তাড়াহুড়া করে চলে যায়। শাহাদত চৌধুরী প্রথম যোগাযোগ করে আলতাফ ভাইয়ের সাথে। সে আলতাফ ভাইকে মেলাঘরে যাবার আগে থেকেই চিনতো। জুনে তার সাথে যোগাযোগ করে। তারপর আরেকজন যায়। গাজী গোলাম দস্তগীর। গাজী দস্তগীর ঢাকায় আসা প্রথম ১৭ জনের একজন। মে মাসে ১৭জনের এই গ্রুপটা ঢাকায় পৌছায়। মেসার্স ঢাকা নিয়ন সাইনের সামাদ সাহেব আলতাফ ভাইকে করাচি থেকে চিনতো। হাফিজ বলে একজন আলতাফ ভাইয়ের অধীনে কাজ করতো। তার অনুরোধে সে মার্চ মাসে ঢাকা চলে আসে।
আলতাফ ভাই ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। গান লেখার সাথে সাথে বাম রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। গোটা শরীরটা লম্বায় পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি ছিল। চোখে চশমা দেয়া আলতাফ ভাইয়ের স্ত্রী মিসেস সারা-আরা (ঝিনু)। তাদের তিন বছরের কন্যাসন্তানটির নাম শাওন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন তার কাছে যারা নিয়মিত যেতো তারা হলো সামাদ সাহেব, হাফিজ সাহেব, গাজী গোলাম দস্তগীর ও অন্যান্য কয়েকজন। বাড়িওয়ালার ছেলে ইকুও তার খুব কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। শাহাদত ভাই বাড়িতে যেতেন আলতাফ ভাইয়ের লেখা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে গাওয়া আলতাফ ভাইয়ের গানের ক্যাসেট আনা-নেয়ার জন্যে।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ের প্রথমদিকে শাহাদত ভাই আমাকে আলতাফ ভাই আর তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বাড়িতে ট্রাঙ্কভর্তি অস্ত্র আর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে তিনি একটুও পিছপা হননি। ওনার গাড়ির বুটে ভরে দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র নিয়ে আসা হয়। আলতাফ ভাই নিজেই গাড়ি চালান। সামাদ ভাই আর ইকু তার সাথে ছিল। রাতে তাদের বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে প্রতিবেশীর বাড়ির পেছনে একটা লেবু গাছের তলায় দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র লুকানো হয়েছিল। সাহায্য করেছিল সামাদও মাওয়া বিল্লাহ।
জুলাইয়ের এক দুপুরে আমাদের তেমন কোনো কাজ ছিল না। শাহাদত ভাই বললো, ‘চলো আলতাফ ভাইয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি। তার সাহায্য দরকার হতে পারে।’ আমরা গাড়ি করে ধানমন্ডি থেকে রওয়ানা হলাম। ফার্মগেট চেকপোস্ট পার হয়ে বাংলা মোটর থেকে সোজা পূর্ব দিকে চলে গেলাম। মগবাজার ক্রসিং ছাড়িয়ে আউটার সার্কুলায় রোড দিয়ে মালিবাগ মৌচাক মার্কেট, তারগা দুটো পেট্রোল পাম্প পেরিয়ে আধ পোড়া পুলিশ ব্যারাকগুলো ডানে পড়লো। মেইন রোড থেকে বাঁয়ে মোড় নিলাম। ডান হাতের প্রথম দোতলা বাড়িটাই গন্তব্য। গাড়ি থামাতে। পাহাগত ভাই নেমে দরজায় টোকা দিল। আমি গাড়ির দরজা লক করে ওনার পেছনে দাঁড়ালাম। জানালা দিয়ে কে যেন উকি মেরে দেশে নিল কে এসেছে। তারপর মুখ ফেরাতে দেখি দরজা খোলা। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে দেয়া একজন দাঁড়িয়ে। পরণে হায্য হাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতার সাথে বললেন, ‘শাহাদত এসেছো। ভেতরে এসো।’ আমরা দু’জনেই ঢুকলাম। শাহাদত তাই আমার সাথে আলতাফ ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কথাবার্তা শুরু হতেই মনে হলো শাহাদত ভাই যেন পরিবারটিকে বহুদিন ধরে চেনেন। মিসেস আলতাফ মাহমুদ এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। জানতে চাইলেন আমরা সবাই কেমন আছি। আমার সাথে আলতাফ ভাইয়ের শ্বাশুড়িরও পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। উনি পাশের ঘরে বসেছিলেন। শাহাদত ভাই মিনু আর শিমুলের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো আমাদের। খুব পিপাসা পেয়েছিল। পানি চাইতে মিনু এক গ্লাস পানি দিয়ে গেল। মিনু, মিসেস আলতাফ (ঝিনু)-এর ছোট বোন। বাড়ির ভেতরে পরিবেশটা খুব স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল।
ঢাকা, মেলাঘরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলাপ হলো। শাহাদত ভাই তাদেরকে সেক্টর-টুতে কি হচ্ছে সব বললেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরাও ওখানে নার্সের কাজ করছে। লুলু, টুকু, ডালিয়া এরা সোনামুড়ায় একটা ছোট হাসপাতালে ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদের অধীনে নার্সের কাজ করছে। এটা শুনতেই মিনু শাহাদত ভাইকে বললো, ‘শাহাদত ভাই আমিও ওদের সাথে কাজ করবো। আমাকে আপনার সাথে নেবেন?’ শাহাদত খুব অবাক হলো কিন্তু খুশিও হলো কথাটা শুনে। খালা আর আলতাফ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই, আলতাফ ভাই বললেন, ‘যাবে না কেন? আমি তোমাকে পরেরবার আগে থেকেই জানিয়ে রাখবো। তৈরি থাকতে পারবে।’ স্বাধীন বংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে আরো ক্যাসেট তৈরির ব্যাপারেও ইঙ্গিত করলেন। আরো কিছু ক্যাসেট তৈরি করতে পারলেই আমাদের সাথে যোগ দেবেন। তার আগে অবশ্য তার পরিবারের নিরাপদ কোনো একটা জায়গা ঠিক করতে হবে। তবে এর মধ্যে যে কোনো সময়ে ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের যেকোনো কাজে তিনি সাহায্য করতে রাজি।
আমাকে অবাক করলো আলতাফ ভাইয়ের কথা বলার ধরন। অসাধারণ সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে সাহায্যের কথা বললেন। যেন প্রতিজ্ঞা করলেন। এমন একজন মানুষ।
যে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরের জন্যে। পরিচিত তার সাথে দেখা করতে পেরে নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে হলো। আত্মনিবেদনের জন্য বোধহয় বাড়িটাকে আদতেই একটি আশ্রয় মনে করতো ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারা।
১/৩ দিলু রোড, নিউ ইস্কাটন
মধ্য পঞ্চাশের এই অদ্রলোক পেশায় প্রকৌশলী ছিলেন। প্রায় দুই দশক ধরে ঐ বাড়িতেই। মোহম্মদ হাফিজুল আলম ইন্দো-পাক পার্টিশানে (১৯৪৭-এ) পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর পিডব্লিউডি থেকে বদলি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা পিডব্লিউডিতে চলে আসেন। চাকরির প্রথম দিকে ঢাকা এরোড্রোমের একেবারে কোলের ওপর একটা টিনশেড বাড়িতে তার ছোট্ট সংসার
‘এমনকি ১৭ ডিসেম্বরেও আমরা সেখানে আর্মির পেট্রোল ভরা ১৪০টি চার গ্যালনী জেরিক্যান রেখেছিলাম। মুক্তিবাহিনীর গাড়ির জ্বালানি হিসাবে খুব দরকার ছিল’
পেতেছিলেন। ১৯৫০-এ হাফিজুল আলম ১৬। কাঠা জমি কিনে দুটো ঘর তুললেন তার পরিবারের জন্য। দুটো রুম ক্রমশ বাড়তে থাকলো। এক সময়ে বাড়িটা ১/৩ দিলু রোডের পরিচয় পেলো।
এই দেড়তলা দালানটি ঢাকার নতুন বর্ধিত আবাসিক এলাকার একেবারে মাঝখানে অবস্থিত ছিল। নিউ ইস্কাটন জায়গাটি ঢাকার মধ্যমণি হয়ে উঠলো। পঞ্চাশের দশকে এই বাড়িটা চেনাতে হলে আত্মীয়-স্বজনরা বলতো কলাগাছের বাউন্ডারি দেয়া বাড়িটা। কলাগাছগুলো লাগানোই হয়েছিল এমনভাবে, মনে হতো ওটা বাউন্ডারি ওয়ালের মত। ‘৬০ সালের পরে ইটের দেয়াল তোলা হয়।
হাফিজুল আলম তার স্ত্রী আর ছয় সন্তান নিয়ে থাকতেন এখানে। দিলু রোড দিয়ে ঢুকে মসজিদটা বাম হাতে ফেলে বাঁয়ের প্রথম গলির একেবারে শেষ মাথায় ছিল বাড়িটা। কানাগলির বাম হাতেই পড়তো। বাড়িতে ঢোকার আরেকটি রাস্তা ছিল। মসজিদের পাশ দিয়ে একটা গলি ধরে গেলে কিছুটা খোলা জায়গা পার হলেই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঢোকা যেতো। এই বাড়িটা বানানো হয়েছিল ৬ কাঠার ওপর। বাকি জায়গায় গাছপালা
লাগানো হতো। আর যেটুকু জায়গা খালি ছিল ওটা গাড়ি রাখার জন্যে ব্যবহার করা হতো। বাড়িতে ঢোকার গেট একটাই। জমির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ঢুকলে বাড়িটা পড়তো বাম হাতে আর ডান দিকে (পশ্চিম দিক) ভিল খোলা জায়গা। গ্যারেজ দুটো পড়তো ঠিক সামনেই।
হাফিজুল আলমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৯৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বড় মেয়ে সাজম আকবর বিয়ে করে খুলনায় থাকতেন, তিন সন্তান নিয়ে। আলম সাহেব ঢাকায় তার স্থলা ছেলে-মেয়ে নিয়েই বসবাস করতেন একমাত্র ছেলে যুদ্ধে যাবার সময়ে পরিবারের খাতিরেই নিজেকে খুব শক্ত রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে গোলাবারু রাখতে চাইলে খুশি মনে রাজি হন। নিজে চাড়েই তিনি সেখানে মাটির নিে
গোলাবারুদ রাখার ব্যবস্থ করেন। রান্নাঘরের তলায় এ পাতাল গুদামটি এমনভাবে তৈাঁ করেন যে, রান্নার চুলা না সরিে ঢোকার জায়গা বের করা যাত না। যুদ্ধ বাড়ার সাথে সাং সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদে আনাগোনাও বাড়তে থাকলে কেউ কেউ রাত্রে থেকে যেতো। এদের মধ্যে জিয় শহীদ, শাহাদত চৌধুর আনোয়ার রহমান (আনু) অ জুয়েল নিয়মিত আসতো। আলম সাহেলে দুই ছোট মেয়ে রেশমা আর শাহনাজ পরিষ্কার করতে শিখে ফেলে খুব তাড়াতালি ব্যারেল পরিষ্কার করা আর ম্যাগাজিনে ৩ ভরা ওদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়ালে সবচেয়ে ছোট মেয়ে শাহনাজ সবচেয়ে পারতো কাজটা। একবার শাহাদত বাড়ি এসে খেয়াল করলো শাহনাজ শুধু ডান দিয়েই বন্দুক পরিষ্কার করছে। পরে অন জানতে পেরেছিল ৫০ দশকের শেষ দি একটা দুর্ঘটনায় শাহনাজ হাতে চোট প কিন্তু ডাক্তার বাম হাতটা ভুলভাবে জে লাগানোয় কব্জি থেকে আঙুলগুলো আর ক করে না। আসমা, রেশমা শাহনাজ অস্ত্র বিস্ফোরক কোনটা কি, দ্রুত শিখে ফেললে কোনো অ্যাকশনের অস্ত্রশস্ত্র গুি রান্নাঘরের তলায় রেখে দেওয়া ওলে দায়িত্ব ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার সৌ অপারেশনে জুয়েল আহত হয়। ওকে বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়েছিল। আসমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ফাই ইয়ারে। আসমাই জুয়েলের দেখাে করতো। ক্ষত পরিষ্কার করে নিয়মিত ব্যা করে দিতো। আসমা আনু আর মায়ায়
চিনতো কারণ তিনজনই সেগুনবাগিচার সঙ্গীত কলেজের ছাত্র ছিল।
মিসেস আলম, অর্থাৎ বাড়ির কর্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছাড়া কোনো প্রশ্ন করতেন না। বাড়ির সবার আন্তরিকতা এমন ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা যখন খুশি আসা-যাওয়া করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করতো না। উমি (বাড়ির কর্মী) সবসময় আশ্রয়ের জন্যে দরজা খোলা রাখতেন। কাউকে যেন ফিরে যেতে না হয় নিশ্চিত করতেন। যুদ্ধে এই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম আশ্রয়স্থল ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায়ই আত্মীয়-স্বজনরা আসতো এই বাড়িতে। কিন্তু কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি এটা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় বা অস্ত্রাগার।
হাফিজুল আলম সাহেবের হেরাল্ড স্ট্রাম্প গাড়িটাও মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেয়ার কাজ করতো। তিনি নিজেই চালাতেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ হিট অ্যান্ড রান অপারেশন চালাবার পর তিনিই সেক্টর-টু’র গেরিলাদের নারায়ণগঞ্জ পৌছে দেন। সেটা ছিল ১৯৭১-এর জুন।
ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকান্ড বেড়ে গেল। আরো বেশি গেরিলা অপারেশন শুরু হলো। এই বাড়িটার গুরুত্বও তখন ক্রমশ বাড়তে থাকলো। হাফিজুল আলম একেবারে প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া আর অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা করে সাহসের পরিচয় দেন। ধরা পড়লে এর ফলাফল তিনি ভালোভাবেই জানতেন। তার পুরো পরিবারের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আস্থা আর সাহসের জন্যেই হয়তো তিনি এতোদূর আগাতে রাজি হস। সেক্টর-টু’র মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই বাড়ি, বাড়ির মানুষগুলোর স্মৃতি চির অম্লান হয়ে থাকবে।
৩০ হাটখোলা রোড
৩০-এর দশকে তৈরি বাড়িটি দেখলেই বোঝা যেতো একেবারে পুরনো আমলের। আব্দুল হক চৌধুরী তার অবসর জীবন বেশ কাটাচ্ছিলেন। তিন জন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত পিতা। হাটখোলার এদিকটায় ৫০-এর দশকে (দেশ বিভাগের পরপর) উচ্চবিত্তরা বাস করা শুরু করে। তিন দিক থেকে ঐ বাড়িতে পৌছানো যেতো। আদতে চারদিক থেকে বাড়িতে পৌছাবার পথ ছিল।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে রাস্তাটি একটু পরেই বাড়িতে এসে ঠেকে। দক্ষিণ দিক থেকে এলে বাড়িটা ডান হাতে পড়তো। এক রক পরেই বাড়িতে পৌঁছানো যেতো। পূর্বের হাটখোলা মেইন রোড থেকেও পৌঁছানো যেতো। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের উল্টোদিকের গলি দিয়ে বাঁয়ে ঢুকলেই বাড়িটা পড়বে। একতলা বাড়িটির ছাদে বারান্দা ছিল পুরো
পরিবারের সময় কাটানোর জন্যে। উঠানের চারদিকে বেশ কিছু গাছপালা ছিল। বিশাল পেয়ারা গাছটায় এতো পেয়ারা হতো যে খেয়ে শেষ করা যেতো না। বাধ্য হয়ে বিলিয়ে দিতে হতো। বাড়িতে যেতে হলে এই উঠানটা পার হয়েই যেতে হতো।বাড়িতে যাবার পথে উঠানটা দারুণ
‘মোখতারের ছোট ভাই মুকলেস। বুকে গুলি খাওয়ার পর এখানেই তার চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তার আজিজুর রহমান নিজেই তার চিকিৎসা করেন। দুই-তিন সপ্তাহ চিকিৎসার পর সে আবার শ্যামপুর ফেরত যায়’লাগতো। ডানের একতলা দালানটি খুব। সম্ভবত ষাটের দশকে তৈরি হয়েছিল চাকর-বাকরদের থাকার জন্যে। বাড়ির সামনে এসে চারটা সিঁড়ি ভাঙলে বারান্দা পড়ে। পাঁচটা আর্চ-এর একটির নিচ দিয়ে যেতে হয়। পাশের দুটো ঘরের চৌকোণা থাম আর দেয়ালগুলো এই পাঁচটি আর্চকে ধরে রাখতো। পাঁচটি দরজার দু’পাশের দুটো দিয়ে পাশের ঘরগুলোতে যাওয়া যায়। মাঝের তিনটি আজকে স্থপতিদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও সে সময়ে তা প্রয়োজনীয়ই ছিল। ডানদিকে দরজাটি সিঁড়ি দিয়ে চিলেকোঠা পেরিয়ে ছাদের বারান্দায় ঠেকতো। সেখানে এদিক-ওদিক বই আর পত্রিকা ছড়ানো থাকতো, একটা বিছানা আর বেতের আর্মচেয়ার থাকতো। পূর্বের দেয়ালের জানালা দুটো ছোট হলেও আলো-বাতাস ভালই আসতো। সিগারেটের ধোঁয়াও বের হতো জানালা দিয়ে। অঘটন ঠেকানোর জন্যে সিঁড়ির দু’দিকে রেলিং দেয়া ছিল। কোথাও বসে আলাপ করার দরকার হলে আমরা এই চিলেকোঠায় গিয়েই বসতাম। শিল্পী ও সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত শাহাদত চৌধুরী চিলেকোঠায় থাকতেন।
আব্দুল হক চৌধুরীর ছয় ছেলে ছয় মেয়ে ছিল। জাহান আলী চৌধুরী তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন। তিনি ইউসিস-এ কাজ করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ তো করতেনই, পাশাপাশি বিশ্বের গণমাধ্যমের কাছে পাকিস্তানি অত্যাচার তুলে ধরেছিলেন। গ্র্যান্ট পার বলে একজন সে সময়ে ইউসিসে ২ নম্বর লোক ছিলেন। তার সাথে আমেরিকান সাংবাদিকদের সুসম্পর্ক ছিল। জাহান আলি চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা আবু
বারাক আলভীকে সেখানে নিয়ে গেলেন। আলভী তখন ঢাকার একমাত্র আর্ট কলেজে পড়তেন। তাকে পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে গিয়ে আঙুলের নখ উপড়ে দিয়েছিল। আলভীর সাথে গ্র্যান্ট পার কায়দা করে সাংবাদিকদের পরিচয় করিয়ে দেন। সাংবাদিকরা অবশ্য আলভীকে স্কুলছাত্রের বেশি কিছু মনে করেনি। তবু হেরাল্ড ট্রিবিউন আর নিউইংক টাইমস-এ বিশাল হেডলাইনসহ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। আমেরিকান জনগণ বাংলাদেশের ঘটনা এবং অবস্থা কিছুটা জানতে পারে।
৩০ হাটখোলা রোডের বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অস্ত্রাগার, আশ্রয় এবং ঢাকার বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপগুলোর মধ্যে সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। কত্রীর ব্যক্তিত্ব আর স্নেহের জন্যেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এই বাড়িটি কাছে টানতো। আমাদের খালা, তিন মুক্তিযোদ্ধার মা স্বভাবগতভাবে যতটা সম্ভব কম কথা বলতেন। তার তিন পুত্র শাহাদত চৌধুরী, ফতেহ আলী চৌধুরী ও মোর্শেদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গেলেই দেখা যেতো তিনি বাড়ির দুই সদর দরজার মাঝে সসম্ভমে একটি পুরনো চেয়ারে বসে আছেন। পাশে একটা বোউলে পেয়ারা থাকতো। আমরা গেলে সেখান থেকে ভাগ পাওয়া যেতো। ওটুকুই না, আসার সময় কয়েকটা সাথে। নেবার জন্যে পীড়াপীড়ি করতেন। তার তিন মেয়ে মেরিয়াম, ঝিমলী আর ডানা সেখানেই থাকতো। কিছুদিনের মধ্যে শুরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা শুরু করলো। ও বাড়িতে সময়ের কোনো বাধাধরা ব্যাপার ছিল না। যে কোনো সময়েই হা পাওয়া যেতো। প্রচন্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে ঐ বাড়িটিতে ঢুকলে মনটা শান্ত হতো।
বাড়ির কর্তা, তিন মুক্তিযোদ্ধার বাবা, খালুই আমাদের সঙ্গে বেশির ভাগ কথাবার্তা বলতেন। কেমন আছি, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিনা একরম। ও বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলেই দেখা যেতো খালু পা গুটিয়ে ভায় আরাম কেদারায় বসে থাকতেন। পাশে ছক্কায় গুড়গুড় শব্দ করে টান দিতেন আর ময়ে হুক্কার কয়লায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। অনাবিল শান্তিময় মনে হতো দৃশ্যটিকে। বাড়িটা সবার জন্যে অবারিত যায় হয়েও আলাদা জগতের মত ছিল। দূরের মান হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ের বড় কাছে ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের শান্তিময় নিশ্চিত আশ্রয়।
তথ্যসূত্র: সাপ্তাহিক ২০০০