রক্তের আল্পনা
রফিকুর রশীদের ছোট গল্প
অফিসে বেরোনোর সময় হাতের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক না পেলে কার মেজাজ খারাপ না হয়! আলনায় জামা-পাজামা ঠিকই সাজানো আছে, কিন্তু গেঞ্জিটা কোথায়? দেয়ালঘড়িতে দশটার ঘণ্টা বাজে ঢং-ঢং। শফিউর রহমানের কপালের দুপাশের শিরা দাপায় দপ্দপ্ করে। দ্রুত হাতে পাজামার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে গজগজ করে ওঠেন – উহ্, আজো সেই দশটা! কোথায় একটু আগে বেরোবো কিনা… সহসা ঘরে ঢোকেন শফিউরের মা। ছেলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, আজ আর অফিসে না গেলে হয় না খোকা?
এই ‘খোকা’ ডাকটুকু শুধু মায়ের। বাবা মাহবুবুর রহমান পূর্ণনামেই ডাকেন ছেলেদের। প্রায়শ তিনি স্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেন – খোকা শব্দটির গায়ে কেমন যেন হিঁদুয়ানি গন্ধ আছে। মুসলমানের ছেলেমেয়েকে ডাকতে হয় ইসলামি নামে। এ-পরামর্শ মনে থাকে না শফিউরের মায়ের। উলটো তিনিই মনে করিয়ে দেন, আমরা তো ছিলাম হিন্দুস্তানেরই মানুষ, খোকা বলার অভ্যেস যে!
মায়ের কথা কানে ঢুকুক আর না-ই ঢুকুক, মাকে সামনে পেয়ে শফিউর রহমান জিজ্ঞেস করেন – গেঞ্জিটা কোথায় গেল, বলো তো মা?
গেঞ্জির হদিস মা কেমন করে দেবেন! কাপড়-চোপড় নিপাট ভাঁজ করে তাঁর বউমা কোনোটা ন্যাপথালিন দিয়ে তুলে রাখে বাক্সে, কোনোটা সাজিয়ে রাখে আলনায়। থরে-থরে সাজানো সেই আলনার কাপড় ছেলেকে এলোমেলো করতে দেখে তিনি ডেকে ওঠেন বউমাকে,
অ বউমা! খোকার গেঞ্জিটা…
রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয় আকিলা খাতুন,
এই যে মা, আসছি।
শাড়ির আঁচলে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে স্ত্রীকে আসতে দেখেই শফিউর রহমানের মেজাজ চড়ে যায় সপ্তমে। মায়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর ওপর রোষ ঝাড়েন। কটা বাজে সেহুঁশ আছে!
আকিলা খাতুন আলনার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, কতদিন বলেছি তোমার ওই ঘড়ি ঠিক চলে না।
এ্যাঁ, দশটা বাজেনি তাহলে!
রঘুনাথ লেনের পুরনো বাড়ির স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির ভুলটুকু আর নতুন করে ধরিয়ে না দিয়ে আকিলা খাতুন এক টানে আলনা থেকে গেঞ্জি এনে স্বামীর সামনে বাড়িয়ে ধরে – এই নাও তোমার গেঞ্জি। আলনাতেই ছিল! শফিউর রহমান বিস্মিত হন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হেসেও ওঠেন। আকিলা খাতুন কপট কটাক্ষ করে,
হ্যাঙ্গারে কোট ঝুলছে, চোখে পড়েছে তো!
শফিউর রহমান নরম স্বরে বলেন, আমার চোখে না পড়লেও তুমি তো আছো!
পুত্র এবং পুত্রবধূর এই মধুর খুনসুটির মধ্যেও শফিউরের মা আকুল কণ্ঠে ডেকে ওঠেন, অ খোকা! আমি বলছিলাম কী – আজ আর অফিসে না গেলে…
না মা, হয় না।
গেঞ্জির ওপরে শার্ট চাপিয়ে শফিউর রহমান বোতাম লাগাতে লাগাতে ব্যাখ্যা দেন, হাইকোর্টের চাকরি খোদ সরকারি চাকরি। দেশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। এ-সময় একবার অফিসে না গেলে চলে!
এ-ব্যাখ্যা শুনে অন্তর ভরে না মায়ের। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, গতকাল যে তুই বললি এদেশ আর চলবে না, এ সরকার টিকবে না; তাহলে আর… এই ফাঁকে আকিলা খাতুন স্বামীর বিরুদ্ধে অনুযোগ জানায়, তবু উনাকে যেতে হবে মা। হাইকোর্টের কেরানি। উনি না গেলে আইন-আদালত সব বন্ধ হয়ে যাবে না!
মুখে অনুযোগ, তবু আকিলা খাতুন কোটের বুক আলগা করে স্বামীর পিঠের কাছে বাড়িয়ে ধরে। শফিউর রহমান কোটের হাতার মধ্যে দু-হাত গলিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, অফিস-আদালত তো গতকাল থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবু একবার যেতে হবে। সামান্য কেরানি যে!
শফিউরের মা দুপা এগিয়ে এসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে ডুকরে ওঠেন, ভয় করে বাবা, শহরে আজো যদি গোলাগুলি হয়!
গুলি করে আর কত মানুষ মারবে মা, গতকাল তো নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে মানুষ। মাতৃভাষার জন্যে এদেশের ছাত্রজনতা এখন মরতে প্রস্ত্তত।
স্বামীর কথার ধরন শুনে চমকে ওঠে আকিলা খাতুন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন করে, তুমি যে প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দেবে সেটা আমরা জানি, তাই বলে কি ছাত্ররাজনীতি শুরু করেছো নাকি?
কী মুশকিল! তোমার মেয়ে তোমাকে মা বলে ডাকবে না? আমার মাকে আমি মা বলে ডাকব না? এর মধ্যে আবার রাজনীতি-ফাজনীতি কী বলো দেখি!
আকিলা খাতুনের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে, কী জানি!
স্ত্রীর দীর্ঘশ্বাস শফিউর রহমানের কানের দুয়ারে পৌঁছানোর আগেই ঘরের দরজায় দৃষ্টি চলে যায়। তিন বছরের কন্যা শাহনাজ টলোমলো পায়ে ঠিক সময়মতো হাজির। বাবা অফিস যাওয়ার আগে তার গালে চুমু এঁকে দেবে। এ তার নিত্যদিনের রুটিন। আজ দেরি হচ্ছে দেখে বুঝি সে নিজেই এগিয়ে আসে, দু-হাত বাড়িয়ে ডাকে।
বাবা, আমি…
শফিউর রহমান হঠাৎ অন্য মানুষ হয়ে যান। মেয়েকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে আদর করেন। এ-গাল ও-গাল চুমু খেয়ে ভিজিয়ে দেন। মুখে শুধু উচ্চারণ করেন, এই আমার বুড়িমা। এই যে আমার বুড়িমা।
শফিউরের মা বহুবার ছেলের ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন, নিজেকে দেখিয়ে বলেছেন – ওই ছুড়ি আবার বুড়ি মা হলো কী করে বাবা? বুড়িমা তো হলাম আমি। ছেলে সেটা মানতে নারাজ। তার যুক্তি খুবই সহজ-সরল, তুমি তো আমার মা। বুড়ি হচ্ছে এইটা। এই যে আমার বুড়ি। শফিউরের মা এবার নতুন পথে পা বাড়ান, ছেলেকে জব্দ করার জন্যে বলেন, আমরা তাহলে কবে বুড়ো হবো বাবা!
ঝটপট জবাব শফিউরের – বুড়ি তো আছেই মা, তোমরা কেন বুড়ো হবে!
আকিলা খাতুন কথাবার্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, হাত বাড়িয়ে মেয়েকে আহবান জানায়, খুব হয়েছে শানু, নেমে আয়। বাবা অফিসে যাবে।
গাছ বেয়ে নামার মতো করে বাবার কোল থেকে সুড়ুৎ করে নেমে পড়ে শাহনাজ।
এতক্ষণে শফিউর রহমান জানতে চান, বাবাকে দেখছি না কেন মা?
শফিউরের মা ছেলের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শাড়ির অাঁচল মুখে চেপে ফ্যাঁচ করে ফুঁপিয়ে ওঠেন। শফিউর হতভম্ব। অফিসে যাওয়ার ব্যাপারে বাবার নিয়মনিষ্ঠার কথা তাঁর খুব জানা আছে। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের চাকরি। সময়ের নড়চড় কাকে বলে সে-কথা তাঁর অভিধানে লেখা নেই। তাই বলে গোলযোগপূর্ণ এই বেসামাল দিনেও কি এত সকালে বেরোতে হবে! শফিউর রহমান জিজ্ঞেস করেন –
কী হলো মা, কাঁদছ কেন?
মায়ের মুখে কথা নেই। বরং এবার তাঁর চাপাকান্না রীতিমতো স্ফুট হয়ে ওঠে। শফিউর মোটেই বুঝতে পারে না তাঁর মায়ের এই কান্নার কী ব্যাখ্যা হতে পারে! হয়তো তিনি বাবাকেও বারণ করেছেন অফিসে যেতে, কিন্তু নিবৃত্ত করতে পারেননি। মাত্র আর বছরখানেক চাকরি আছে তাঁর, এ-সময় স্ত্রীর কথায় কান দিয়ে অফিস কামাই করার পাত্র তিনি! মাথা খারাপ! শফিউর রহমান নিঃসংশয় হওয়ার জন্যে মাকে শুধান –
বাবা তাহলে অফিসে চলে গেছে মা?
এতক্ষণে মুখ খোলেন শফিউরের মা। তিনি বলেন, অফিস কোথায়! তিনি তো বেরিয়েছেন সেই সাতসকালে!
কী বলছো মা! সাতসকালে…
হ্যাঁ। সারারাত ছটফট করে সকালে উঠে বেরিয়ে গেল।
শফিউর রহমান এইবার ভীষণ উদ্বেগ বোধ করেন। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অপরাধীও মনে হয় নিজেকে। গতরাতে বাড়ি ফেরার পর কথায় কথায় পিতা-পুত্র জড়িয়ে পড়ে তুমুল তর্কে। মাহবুবুর রহমান মেজাজি মানুষ। তিনি সাফ জানিয়ে দেন – সামান্য ভাষার জন্যে আমরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করিনি। বাবার সঙ্গে শফিউরের মতান্তরের জায়গাটা এইখানে, এই ভাষার প্রশ্নে। শফিউর রহমান ভাষার প্রশ্নটিকে সামান্য বলে মানতে পারেন না। কথার পিঠে কথা বাড়ে। রফিকউদ্দীনের কথা ওঠে। আবুল বরকতের কথা ওঠে। উত্তেজিত শফিউরের মুখ থেকে মন্তব্য বেরিয়ে পড়ে – কোনো সভ্য দেশে এরকম সরাসরি গুলি চালায় বাবা? এই দেশটা আর চলবে না। দেখো।
সহসা এসব কথা মনে পড়তেই শফিউর রহমানের গায়ে কাঁটা দেয়। নিজেই ক্ষতবিক্ষত হন – সারারাত ঘুমোতে পারেননি বাবা! আবার সকালে উঠেই হাওয়া!
এসবের মানে কী! এবার মাকে চেপে ধরেন – এসব আগে বলোনি কেন মা? বাবা তাহলে অফিসে যায়নি!
শফিউরের মা চিরকেলে বাঙালি নারী। অাঁচলে চোখ মুছে বলেন, চা-নাস্তা নেই, নাওয়া-খাওয়া নেই, কিসের অফিস!
শফিউর রহমান আর মোটেই বিলম্ব করেন না। ‘আচ্ছা আমি দেখছি’ – বলে সবাইকে আশ্বস্ত করে উঠোনে নেমে আসেন। প্রতিদিনের সঙ্গী র্যালি সাইকেল নিয়ে সদর দরজা ঠেলে বেরোতেই হঠাৎ বাবার সঙ্গে দেখা। চোখ দুটো রক্তজবা। মাথার চুল উসকো-খুসকো। নিজের ছেলেকে চিনতেও যেন খানিক সময় লাগে তাঁর। চিনতে যখন পারেন, তখন সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে তিনি বলেন, তুমি যাচ্ছো কোথায় শফিউর রহমান? হসপিটালের মর্গ থেকে লাশ সরিয়ে ফেলেছে আর্মি। মরা মানুষকেও এতো ভয় ওদের!
শফিউর রহমান আপন জন্মদাতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অবাক বিস্ময়ে। এ কী ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে যাওয়া কলাগাছ, ছিন্নভিন্ন পত্ররাজি! শফিউর ধীরে ধীরে সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে বাবার হাতটা নামিয়ে দেন। আর তখনই নিজের শরীরের রক্ত চনমন করে ওঠে। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে চড়িয়ে বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করেন, তারপর বলেন,
বাইরে অনেক কাজ বাবা, আমি আসি।
শফিউর রহমান সত্যিই সাইকেল ঠেলে বেরিয়ে যান। বাবা মাহবুবুর রহমান কী যেন বলতে যান, কিন্তু গলার স্বর স্ফুট হয় না। এমন কি ছেলের নাম ধরেও ডাকা হয় না আর।
দুই
সেদিন শুক্রবার।
মাহবুবুর রহমান কলতলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে অজু-গোসল সেরে মাথায় টুপি চাপিয়ে মসজিদের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। না, অন্যান্য দিনের মতো জিন্নাহ টুপি সেদিন পরেননি। লালবাগের অবাঙালি দর্জির তৈরি হালকা নকশাদার টুপি পরে তিনি জুমার নামাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বাড়িতে দুঃসংবাদটি এসে পৌঁছে। প্রকৃত সংবাদটি আড়াল করার জন্যে বলা হয়, পুলিশের গুলি লেগেছে শফিউর রহমানের হাতে, যেনবা ব্যাপারটা খুব সামান্যই।
ছোটভাই তৈয়বুর এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে আসে। তখন এক বিরাট মিছিল যাচ্ছিল নবাবপুর রোড দিয়ে। সাংঘাতিক তেজি আর সাহসী মিছিল। রাষ্ট্রভাষার স্লোগান তো আছেই, মিছিল থেকে আগের দিনের ছাত্রহত্যারও বিচার চাইছে। শফিউর রহমানের সাইকেল রথখোলায় মরণচাঁদের দোকান পর্যন্ত আসতেই পেছন থেকে গুলি লাগে তাঁর পিঠে। কেঁপে ওঠে সারা শরীর। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। শফিউর রহমানের সাইকেল আরো একটু এগিয়ে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তারপরই অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিক্যাল।
তৈয়বুরের মুখের এই বিস্তারিত বিবরণ শেষ হতে না হতেই আকিলা খাতুন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। ছোট্ট শাহনাজ এতো কিছু না বুঝেই মা বলে আর্তনাদ করে ওঠে। শফিউরের মা দ্রুত হাতে বউমার চোখে-মুখে পানির ছিটা দেন, বউমার কপালে হাত দিয়ে বুকভাঙা বিলাপ শুরু করেন – আমার এ কী সবেবানাশ হলো রে মা। এখন আমি কী করি, কোথায় যাই…। আবেগ সম্বরণ করে তৈয়বুর চোখ মুছে শক্ত হয়, শাহনাজকে দুহাতে টেনে বুকে তুলে নেয়, শাসনের স্বরে মাকে বলে,
কান্না থামাও তো মা! চলো মেডিক্যালে যাই।
এ প্রস্তাবে মা খুব রাজি। কিন্তু তাঁর দুশ্চিন্তা বউমাকে নিয়ে। সে-কথা তিনি বলেই ফেলেন, বউমার শরীর খারাপ। এ-অবস্থায় ওকে রেখে… সহসা আকিলা খাতুন চোখ মেলে তাকায় এবং জোর দাবি জানায়, না না, আমি মেডিক্যালে যাবো মা। আমি যাবো।
এক গ্লাস পানি সামনে বাড়িয়ে ধরে শাশুড়ি বলেন, পানিটুকু খাও মা।
না মা, আমি যাব মেডিক্যালে।
কান্নার হ্রদে নেমে আসে আকিলা খাতুনের কণ্ঠ। অবুঝ শিশুর মতো বায়না ধরে। শাশুড়ি বোঝাতে চেষ্টা করেন – তোমার পেটের মধ্যে যে আরেকজন আসছে মা, তার কথা তো ভাবতে হবে! বউমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে প্রস্তাব রাখেন – আমরা ঘুরে আসি মা, তুমি না হয় পরে যেও।
না, আকিলা খাতুন কোনো কথা শুনবে না, কোনো যুক্তি মানবে না, গুলিবিদ্ধ স্বামীর শয্যাপাশে সে যাবেই। পেটে যে আসছে তার এদিকে সাত মাস হয়ে আসছে, তারই কথা ভেবে মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর মুখ দেখবে না সে! তার খুব মন বলছে – শফিউরের চোখ এতক্ষণ তাকেই খুঁজছে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে চিৎকার করে ওঠে –
আমি ওর কাছে যাবো।
অবশেষে আকিলা খাতুনের শক্ত দাবির কাছে পরাস্ত হয় সবাই। বেলা দ্বিপ্রহরে তারা ছুটে আসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তুমুল উত্তেজনা। আহত অসুস্থ মানুষের আহাজারি তো আছেই, সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের আবেগ আর উৎকণ্ঠা – মেডিক্যালের মর্গ থেকে লাশ উধাও! এ কী মগের মুল্লুক! যা খুশি তাই করবে? অবশ্য এরই মাঝে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা শহীদদের মরদেহ ছাড়াই গায়েবি জানাজা সম্পন্ন করেছে। একুশের মতো বাইশ তারিখেও তারা রাজপথে বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে, মানুষ মেরেছে নির্বিচারে। আর কত সহ্য হয় মানুষের! তাই তারা টগবগ করে ফুটছে।
শফিউর রহমানের চোখে-মুখে ভয়ানক ক্লান্তির ছাপ। অধিক রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে শরীর। তবু এই মুমূর্ষু অবস্থায় আপনজনদের কাছে পেয়ে কে যেন ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলে তাকে। সে হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরে মাকে। রক্ত মেখে যায় মায়ের শাড়িতে। শফিউরের কপাল থেকে নুয়ে থাকা চুলের গুচ্ছ সরিয়ে মা সেখানে চুম্বন এঁকে দেন পরম মমতায়। তখন ছেলের দুচোখের কোনা বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মানুষের ভিড় ঠেলে শফিউরের মাথার কাছে চলে আসে ছোটভাই তৈয়বুর। খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সে খবর নিয়ে এসেছে – তার ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ শরীর অপারেশন করবেন ডা. এলিনসন। বিদেশি সার্জন। হাত খুব ভালো। মায়ের কাঁধে হাত রেখে সে সান্ত্বনা দেয়, কাঁদছো কেন মা! অপারেশন হলেই ভাইয়া ভালো হয়ে যাবে তো!
শাড়ির অাঁচলে মুখে ঢেকে মা ফুঁপিয়ে ওঠেন।
শফিউর রহমান হাত বাড়াতেই সে হাত অাঁকড়ে ধরে ছোটভাই তৈয়বুর। ছোটভাইয়ের হাতের মুঠোয় বড়ভাইয়ের হাত। মাথাটা একপাশে হেলানো। হাত ধরেই শফিউর বলেন, শাহনাজকে দেখিস ভাই। এই যে আমার বুড়ি। দেখিস ওকে।
এবার তৈয়বুরের চোখ ভিজে আসে, গলা ধরে আসে, সামনে থেকে সরে যায়। এতক্ষণে সামনে এগিয়ে আসে আকিলা খাতুন। তার কণ্ঠে বুকফাটা হাহাকার। স্বামীর গায়ের রক্তেভেজা গেঞ্জিটা খামচে ধরতে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে যায় বুলেটবিদ্ধ ক্ষতস্থানে। আর তখনই তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। মুখে কোনো কথা সরে না। শফিউর রহমান হাত বাড়িয়ে দেন স্ত্রীর দিকে।
আকিলা খাতুন তখন কী করে! তার খুব ইচ্ছে করে ওই দুটি হাতের বন্ধনে নিজেকে সমর্পণ করতে। ইচ্ছে করে ওই রক্তেভেজা গেঞ্জি থেকে সবটুকু রক্ত নিজের বুকে শুষে নিতে। ইচ্ছে করে ওই ঘোলাটে চোখ দুটো মমতার চুম্বনে মুছিয়ে দিতে। কিন্তু এই জনারণ্যে কীইবা করতে পারে সে!
এরই মাঝে সার্জন এলিনসনের প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়। হাসপাতালে সিস্টার-ব্রাদার ব্যস্তসমস্ত পায়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। স্ট্রেচারে রোগী তুলে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। আকিলা খাতুন তখন প্রাণপণে অাঁকড়ে ধরে স্বামীর হাত, আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে – না।
এই জটিল সংকটাপন্ন মুহূর্তে এভাবে না বলার মানে কী! আকিলা খাতুন কি স্বামীর শরীরের গুলিবিদ্ধ স্থানে এই অপারেশন চায় না। সার্জন এলিনসন অনেক বড় ডাক্তার অনেক খ্যাতি তাঁর; তবুও না? আকিলা খাতুন কী করে বোঝাবে – মুমূর্ষু ওই মানুষটিকে এক পলকের জন্যেও চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করছে না। তাই তো সে স্ট্রেচারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, স্বামীর রক্তাক্ত বুকে হাত রাখে। ডুকরে-ওঠা তার কান্নার ভাঁজে আবারো গুমরে ওঠে – না।
মানুষ বাঁচানোর মহান ব্রত নিয়ে যে চিকিৎসক কর্তব্যকর্মে আত্মনিয়োগ করেছেন, রোগীর স্বজনদের আর্তবিলাপে কান দিতে গেলে তাঁর চলে! মানুষের বাঁচার আকুতিই তার কানের দুয়ারে দম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তাই অন্য কোনো মানবিক আহাজারি কানের ভেতর দিয়ে তাঁর মর্মমূল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। শুধু ডাক্তার বলে তো কথা নয়, মহৎ এই কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষেত্রেই এ-কথা প্রযোজ্য। কাজেই শফিউর রহমানের স্ট্রেচার সামনে এগিয়ে চলে। অচেনা শূন্যতার গহবরে প্রবেশের ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্ত্রীর হাত ধরে শফিউর বলেন, আমি যাই আকিলা। এবার আমাদের পুত্রসন্তান হলে তার নাম রেখো শফিক। মানে শফিকুর রহমান। তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব।
এপারে আকিলা খাতুনকে রেখে শফিউর রহমানের স্ট্রেচার চলে যায় ওপারে।
প্রিয় পাঠক, সত্যিই আর এপারে আসা হয়নি শফিউর রহমানের। বিখ্যাত সার্জন ডা. এলিনসনের অপারেশন সেদিন সাফল্যের নাগাল পায়নি। যখন সন্ধ্যায় সব পাখি ঘরে ফেরে, শফিউরের জীবনবাতি তখন নিভে যায়। পুলিশ কিংবা আর্মি যে কোনো সময় ছোঁ মেরে লাশ গুম করে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় কজন ছাত্র যুক্তি করে শফিউরের লাশ লুকিয়ে রাখে ঢাকা মেডিক্যালের স্টেরিলাইজ বিভাগে। টানা তিনদিন পর কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতিতে সে-লাশ আনা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। অতঃপর মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে আকিলা খাতুনের জমানো টাকায় কেনা মাটিতে দাফন করা হয় লাশ। এই পর্যন্ত সর্বজনবিদিত ইতিহাস, গল্প নয়। কেবল আকিলা খাতুনের বিমূঢ় হাতের মুঠোয় ধরে থাকা শফিউরের রক্তমাখা গেঞ্জিটাই আগামীদিনের কল্পগল্পের অনিঃশেষ উপাদান হয়ে যায়।