রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির কয়েকটি শব্দ বদল প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ।।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের শব্দ বদল করতে চাওয়ার ফলে শুরু হয়েছে বিতর্ক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির কয়েকটি শব্দ বদল করে সেটিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা যায় কী না, তা নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী।
আলাপচারিতা
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জন্য পহেলা বৈশাখ দিনটিকে ‘বাংলা দিবস’ আর রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি গ্রহণ করার জন্য মঙ্গলবার এক সর্বদলীয় বৈঠকে মিজ ব্যানার্জী ওই প্রস্তাব দিয়েছেন।
পহেলা বৈশাখকে বাংলা দিবস হিসাবে গ্রহণ করা হলেও বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের শব্দ পরিবর্তন করা নিয়ে মতান্তর হয়। মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে সবার মতামত জানতে চেয়েছেন, তার পরে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্য বিধানসভায় আনা হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের শব্দ বদল করতে চাওয়ার ফলে শুরু হয়েছে বিতর্ক।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবিপশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সঙ্গীত বেছে নেওয়ার জন্য সর্বদলীয় বৈঠকে ওই প্রস্তাব দেন মমতা ব্যানার্জী – ফাইল চিত্র
‘বাঙালির’ পরিবর্তে ‘বাংলার’ চান মমতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যেদিন রাখি বন্ধন উৎসব করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের হাতে রাখি পড়িয়ে দিয়ে, সেই উপলক্ষ্যেই তিনি লিখেছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু, বাংলার ফল – পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’ গানটি।
গানটিতে ‘বাঙালির পণ বাঙালির আশা’ এবং ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ যে লাইনগুলিতে আছে, সেখানে বাঙালি শব্দটি বদলিয়ে ‘বাংলার পণ বাংলার আশা’ ইত্যাদি করা যায় কী না, তা ভেবে দেখার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৈঠকে মিজ ব্যানার্জী বলেন, “রাখি বন্ধনের জন্য রবীন্দ্রনাথ যখন গানটি লিখেছিলেন, তখন তিনি সব সমাজকে নিয়ে কথা বলেছিলেন, যারা বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু এখন বাংলায় বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়, ধর্মের মানুষ বাস করেন। তিনি বেঁচে থাকলে বলতেন ‘বাংলার’।
“তাই বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন-এর জায়গায় বাংলার প্রাণ বাংলার মন বাংলার ঘরে যত ভাইবোন – এটা ব্যবহার করতে পারি কি না, মতামত চাইব,” মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর।
মঙ্গলবারের সর্বদলীয় বৈঠকে মতান্তর হওয়ার ফলে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটিকেও রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সর্বদলীয় বৈঠকে মতৈক্য হওয়ায় সব পক্ষের মতামত জানতে চেয়েছেন মমতা ব্যানার্জী।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি,১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেন টানাটানি’?
মুখ্যমন্ত্রীর শব্দ বদলের প্রস্তাব সামনে আসতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে এ নিয়ে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ বদল করা উচিত নয়, সেটা অন্যায়। কেউ একধাপ এগিয়ে বলেছেন শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, যে কোনও স্রষ্টার সৃষ্টিকেই পরিবর্তন করা অনুচিত, এটা ভাবাও অন্যায়।
আবার ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলের ভেতরেও কেউ কেউ বলছেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে কাটাছেড়া না করাই উচিত।
শিল্পীদের বেশ কয়েকজন এই রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াতে চান নি, তাই মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন।
তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, যে কোনও স্রষ্টার সৃষ্টিকে কেউ পাল্টাতে পারেন না। সেটা তার নিজের রচনা। প্রয়োজনে নতুন একটা রচনা করা যেতে পারে। সেই নতুন রচনায় হয়ত অনুপ্রেরণা থাকতে পারে, যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের অনুপ্রেরণা দেখতে পাই সলিল চৌধুরীর গানে, আবার লালনের কোনও গানের অনুপ্রেরণা হয়ত কবীর সুমনের গানে পাব।
“সেগুলো এটা নতুন সৃষ্টি। কিন্তু অন্য কারও সৃষ্টির ওপরে কলম চালানোর অধিকার কারও নেই। সেটা রাজনীতিবিদ হোন বা সরকারি কর্তাব্যক্তি,” বলছিলেন মি. নন্দী মজুমদার।
তিনি আরও বলছিলেন, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তো নিজে গান লেখেন, সুর করেন, গানও করেন। তিনি নিজেই তো একটা গান লিখতে পারেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেন টানাটানি? এটা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত, অন্যায়।”

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি.১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই স্কুল স্থাপনের কিছুকাল পরের ছবি
‘বাঙালি’ – ‘অবাঙালি’ বিতর্ক
বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘বাংলা পক্ষ’ মনে করে ‘বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন’ শব্দগুলি বদলিয়ে ‘বাংলার প্রাণ বাংলার মন’ করার যে প্রস্তাব এসেছে, তাতে অন্য রাজ্য থেকে আসা অবাঙালিদের তোষণ করা হচ্ছে।
সংগঠনটির প্রধান অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জী বলছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ তো ভাষাভিত্তিক রাজ্য। এখানে ৮৬% মানুষ বাংলায় কথা বলা বাঙালি মানুষ। অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষদের কথা ভেবে কেন রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ বদলানোর চেষ্টা হবে? যে ছোট ১৪% মানুষ অন্য রাজ্য থেকে এসেছে, যারা বাঙালি নয়, এটা এক অর্থে তাদের তোষণ করার চেষ্টা।“
“বাংলার মাটি বাংলার জল গানটিতে কাঁচি চালিয়ে সরকার যে সংস্করণটিই করুক না কেন, বাঙালিরা মূল গানটাই গাইবে। রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে বাঙালির প্রতিস্পর্ধিতার একটা নজির হয়ে থাকবে সেটা,” মন্তব্য গর্গ চ্যাটার্জীর।
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিত মণ্ডল বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যেটা ভাবছেন যে বাঙালির জায়গায় যদি বাংলার করা যায় কী না, তাতে গানটির আবেগে খুব বেশি পার্থক্য হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এটাও ঘটনা, মূল গানটাও তো যথেষ্টই আবেগপূর্ণ, সেটা রাখলেও যে খুব বেশি সমস্যা হবে, তা নয়।“
“প্রশ্নটা হল, বাঙালি আপনি কাকে বলবেন? বাংলায় যারা থাকেন তারাই বাঙালি না কি যারা বাংলায় কথা বলেন শুধু তারাই বাঙালি? তাহলে যারা হিন্দিভাষী মানুষ, তারা বাঙলায় কথা বললে কি তাদের বাঙালি বলা হবে না? আমার মনে হয় যেটা ভাবা উচিত ভৌগলিকভাবে যারা বাংলায় থাকে, তাদের সবাইকেই বাঙালি বলে ভাবা উচিত। বিষয়টা যদি আমরা এইভাবে দেখি তাহলে ওই বাঙালি শব্দটা নিয়ে আর কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়,” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি.শান্তিনিকেতনে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে লেখা গান
লর্ড কার্জন যখন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ দেন, তারই প্রতিবাদ হয়েছিল সর্বস্তরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং রাস্তায় নেমেছিলেন সেদিন। হিন্দু – মুসলমানের ঐক্য বজায় রাখতে রাখি বন্ধন উৎসব হয়েছিল কলকাতার রাস্তায়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া’ বইতে লিখেছেন এই গানটি রচনার প্রেক্ষিত।তার লেখায়, “রবিকাকা একদিন বললেন, রাখিবন্ধন উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখি পরাতে হবে। ক্ষেত্রমোহন কথকঠাকুর খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, এই রাখিবন্ধন উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে। ঠিক হল, সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখি পরাবে। রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাত থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে… মেয়েরা খই ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম, যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল…
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
…পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’
এই গানটি সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল।“

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি.অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কলকাতায়। সুস্থ হয়ে তিনি আর ফেরেননি
বাংলা দিবস
রাজ্য সঙ্গীত নিয়ে আলোচনার সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি বিশেষ দিনকে ‘বাংলা দিবস’ হিসাবে পালন করারও উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার।
বিধানসভা একটি কমিটি তৈরি করেছিল এই দুটি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য।
তাদের পরামর্শ অনুযায়ীই পহেলা বৈশাখ তারিখে বাংলা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব এসেছে।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এবং কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য এবছর থেকে জোরেশোরে ২০শে জুন দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করছে।
ওই দিনই ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার আইনসভায় বাংলা ভাগ নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছিল।
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা