মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি—একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় (মুসলিম)।’ আল্লাহ তাআলার নির্দেশ, ‘তোমরা সন্ধ্যা (সূর্যাস্ত) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।’
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে দীর্ঘ এক মাস সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা।
রমজানের অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত হলো ইফতার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬০, পৃষ্ঠা: ১৩১)।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন রাত সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে ও দিন এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোজাদার ইফতার করবে (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮৩০)।’ ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সে পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে, যে পর্যন্ত মানুষ শিগগির ইফতার করবে। কেননা, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বিলম্বে ইফতার করত (মুসনাদে আহমাদ)।’ হজরত সাহল ইবনে সাআদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যত দিন লোকেরা ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮৩৩)।’
- রোজা রাখার পর প্রথম খাবার হলো ইফতার। শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে সঠিক ও স্বাস্থ্যকর ইফতারের কোনো বিকল্প নেই।
- সুষম ও স্বাস্থ্যকর ইফতার যথাযথ পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শরীরকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
- ইফতারে ভাজা-পোড়া খাবার গ্রহণ অনুচিত।
সারাদিন খালিপেটে থাকার পর ইফতারিতে ভাজা-পোড়া খাবার এসিডিটি বাড়ায়। এ কারণে ভাজাপোড়া ইফতার গ্রহণের ফলে অনেক রোজাদার ইফতারের পর পেট ফাপা, বদহজম, বমি বমি ভাব ইত্যাদি শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। তাই ইফতারিতে যতদূর সম্ভব ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে- ইফতারিতে খেজুর, মৌসুমি ফল বেশি থাকা উচিত। নুডুলস, আদা কুচি দিয়ে সামান্য ছোলা আর মুড়ি, দইবড়া, দই চিড়ার মতো খাবারগুলো খেতে পারেন। আর শরীরে সারাদিনের পানির ঘাটতি পূরণ করতে টকদই, ফলের রস, ডাবের পানি, লেবুর শরবত পান করুন। তবে এসিডিটির সমস্যা বেশি থাকলে লেবুর শরবত না খাওয়াই ভালো। অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
ইফতারে প্রতিদিন একই মেনু না রেখে দু-এক দিন পরপর মেনু পরিবর্তন করা উচিত। ইফতারে ডিম ও দুধের তৈরি খাবার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দিয়ে; নিশ্চয় পানি পবিত্র (তিরমিজি ও আবু দাউদ, আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬২, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২)।’ পানিমিশ্রিত দুধ দিয়ে ইফতার করার কথাও বর্ণিত আছে। মাগরিবের নামাজের আগে ইফতার করা মুস্তাহাব বা উত্তম।
ইফতারে খুবই সফট, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার খেজুর খেয়ে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) রোজা ইফতারি করতেন ।
দুই থেকে তিনটা খেজুর নিন এবং এক থেকে দুই গ্লাস পানি নিন। পান করুন। ব্যস, ফাইন। ফার্স্ট ক্লাস একটা ইফতার হয়ে গেল। এটিই হচ্ছে ইফতার। খেজুর আপনাকে পূর্ণ এনার্জি সাপ্লাই দেবে। কীভাবে?
খেজুরের মূল উপাদান হচ্ছে সুক্রোজ। এই খেজুর ভালো করে চিবাবেন, সময় নিয়ে চিবাবেন। চিবিয়ে গিলে নেবেন। পাকস্তলিতে গিয়ে এই খেজুর থেকে সুক্রোজ ভেঙে তৈরি হবে গ্লুকোজ এবং ফ্রুকটোজ। ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে এই গ্লুকোজ এবং ফ্রুকটোজ রক্তে প্রবেশ করবে। এর ফলে আপনার যে ব্লাড সুগার কমে গিয়েছিল, আপনার সেই ব্লাড সুগারকে রিপেয়ার করে ফেলবে; মুহূর্তের মধ্যে আপনি চাঙা হয়ে যাবেন; যে চাঙা হওয়ার জন্য আপনারা গুড়ের শরবত, চিনির শরবত, এই শরবত, ওই শরবত কোনো শরবত খাওয়ার কোন প্রয়োজন নাই।
- উত্তম ইফতার দুই থেকে তিনটি খেজুর সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- নামাজে চলে যান। এরপর নামাজ থেকে ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়ে ফেলুন।
- ভাজা-পোড়া ও বাইরের খাবার তাই অবশ্যই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন।
ইফতারে পুষ্টি চাহিদা মেটাবে এমন যেসব খাবার দেহের প্রয়েজনে খাওয়া যেতে পারে
ইফতারের শুরুতে প্রথমে সবাই তরল খাবার খাই। আজানের পর পানি মুখে দিয়ে পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড বিরতি দিয়ে তরল খাবারটি খেতে হয়। এ ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে তরলটি গ্রহণ করতে হয়। খুব তাড়াহুড়া না করে বা গড়গড় করে না খাওয়াই ভালো। তরল হিসেবে লাচ্ছি, তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, তোকমার শরবত, আখের গুড়ের শরবত ও লেবুপানি বেশ উপকারী। শরবত বা তরল তৈরিতে তাল মিছরি, গুড়, মধু ও ব্রাউন সুগার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইফতারে ফল
ইফতারে ফল হতে পারে বেশ ভালো সংযোজন। তাই যেকোনো মৌসুমি ফল অবশ্যই ইফতারে রাখতে হবে। মিক্সড ফ্রুটস বা ফল দিয়ে তৈরি ডেজার্ট খাওয়া যেতে পারে। যা ফলের ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা পূরণ করে থাকে এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য-আঁশ জোগায়।
ইফতারে সবজি
বিভিন্ন সবজি দিয়ে স্বাস্থ্যকর রেসিপি তৈরি করলে তা অনেক উপকারী। সবজি স্যান্ডউইচ, সবজি নুডলস, সবজি রোল, সবজি মম, সবজি পাকোড়া ইত্যাদি। তেল বিহিন সবজি স্যুপ বয়স্কদের জন্য সবজি স্যুপ উপকারি।
ইফতারে ছোলা
রোজায় ছোলার ব্যবহার বহুলাংশে বেড়ে যায়। ছোলায় রয়েছে প্রোটিনের উৎস।
তেল ও মশলা দিয়ে ভুনা করা ছোলা খেয়ে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়।
ছোলা সারা রাত ভিজিয়ে রাখলে ভালো এবং সিদ্ধ ছোলার সঙ্গে পেঁয়াজ, মরিচ, শশা, টমেটো ইত্যাদি মিশিয়ে অথবা সামান্য তেলে ছোলার খাবার তৈরি করে খেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কাঁচা ছোলা খেলেও অনেক খাদ্য-আঁশ ও প্রোটিন পাওয়া যায়।
ইফতারে মিষ্টিঃ জিলাপি বা বুন্দিয়া নয়, ইফতারে স্বাস্থ্যকর মিষ্টান্ন পরিমাণে কম খাওয়া উচিৎ। জিলাপি বা বুন্দিয়া তেলে ভেজে সিরায় ফেলা হয়, যা বেশি খেলে ক্ষতিকর।
দুধের তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন ফালুদা, কাস্টার্ড, পুডিং, ফিরনি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
চিড়া-দই ইফতারের জন্য খুব ভালো
চিড়া-দই ইফতারের জন্য খুব ভালো, যা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম জোগায়। এ ছাড়া দইবড়া, নুডলস, স্যান্ডউইচ, রুটি-কাবাব, মোমো ইত্যাদি ইফতারের মেন্যুতে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া শশা থাকলে ভালো।
পরিমিত খাবার ও সহজে হজমযোগ্য খাবার ইফতারে খেলে শারীরিকভাবে ভালো থাকা যায়। তবে ঘরে তৈরি করা হলে ইফতারকে অনেক স্বাস্থ্যকর করে তোলে।