রাজনীতি ও নির্বাচন ।। বাংলাদেশের রাজনীতির চর্চা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়
রুহুল কুদ্দুস টিটো
রাজনীতির উদ্ভব মানবসভ্যতার বিকাশ এর সাথে সাথে রাজার রাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে ঘটেছে ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, রাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক কলা কৌশল ও পরবর্তীকালের আধুনিক রাজনীতির শ্রেণী বিভাজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানমূলক চিন্তাধারার উত্থান ঘটিয়েছে। মেকিয়াভেলী রচিত “The Prince” গ্রন্থটি রাজতন্ত্রের চরিত্র ও স্থায়ীত্ব নিয়ে বলিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছে । রাজনীতি হলো এককথায় এক বিশেষ রাজত্ব কেন্দ্রিক নীতি বা রাজার নীতি এটি একটা বিশেষ চেতনা বা আদর্শ।
রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বা রাজগতি বা রাজবুদ্ধি হলো দলীয় বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি, উদাহরণস্বরুপ সম্পদের বণ্টন হল এমন একটি কর্মকাণ্ড। রাজনীতি এ্যাকাডেমিক অধ্যয়নকে রাজনীতিবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ হলো রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করা।
রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। এটি আপোষের ও অহিংস রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে ইতিবাচক অর্থে,অথবা সরকার বিষয়ক বিজ্ঞান বা কলা হিসেবে বিশদভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু পাশাপাশি এটি প্রায়শই একটি নেতিবাচক অর্থও বহন করে। উদাহরণস্বরুপ, উচ্ছেদবাদী উইনডেল ফিলিপস ঘোষণা দেন “আমরা রাজনৈতিক চাল চালি না, দাসপ্রথার বিরোধিতা নিয়ে হাসি তামাশা করা আমাদের স্বভাবে নেই।
“রাজনীতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, এবং বিভিন্ন পরিসরে মৌলিকভাবে এবিষয় নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে, যেমন এটি কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, বিস্তৃতভাবে নাকি সীমিতভাবে, রাজকীয়ভাবে নাকি সাধারণভাবে, এবং কোনটি এক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবীঃ সংঘাত নাকি সমবায়।
রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে আছে কারও নিজস্ব রাজনৈতিক অভিমত মানুষের মাঝে প্রচার করা, অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময়, আইন প্রনয়ন, এবং বলপ্রয়োগের চর্চা করা, যার মধ্যে আছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা লড়াই।সামাজিক বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত পরিসরে রাজনীতির চর্চা করা হয়, ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থাসমূহের গোত্র ও গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আধুনিক স্থানীয় সরকার, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্বভৌম রাষ্ট্র, এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত।
আধুনিক জাতি রাষ্ট্রগুলোতে, মানুষ প্রায়ই নিজস্ব মতবাদ তুলে ধরতে রাজনৈতিক দল গঠন করে। কোন দলের সদস্যগণ প্রায়শই বিভিন্ন বিষয়ে সহাবস্থানের ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষণ করে এবং আইনের একই পরিবর্তন ও একই নেতার প্রতি সমর্থনে সহমত হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন হল সাধারণত বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল কোন কাঠামো যা কোন সমাজের মধ্যকার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পদ্ধতিসমূহকে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় প্রাথমিক প্রাচীন যুগে, যেখানে প্লেটোর রিপাবলিক, এরিস্টটলের রাজনীতি, চাণক্যর অর্থশাস্ত্র ও চাণক্য নীতি (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী), এবং কনফুসিয়াসের লেখার ন্যায় দিগন্ত উন্মোচনকারী কাজগুলো পাওয়া যায়।
নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া
‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মন্টেসকিউই বলেছেন যে প্রজাতন্ত্র অথবা গণতন্ত্র যে কোনো ক্ষেত্রের ভোটেই হয় দেশের প্রশাসক হও অথবা প্রশাসনের অধীনে থাকো —এই দুটি অবস্থার মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ভোটারদের থাকতে হয়। নিজেদের দেশে কোন সরকার আসবে তা বাছাই করার ‘মালিক’বা ‘মাস্টার’ হিসেবে কাজ করে ভোটাররাই, ভোট দিয়ে একটি সার্বভৌম (অথবা শাসক) ব্যবস্থাকে চালু রাখে জনসাধারণই।
নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়।সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভার পদগুলি পূরণ করা হতে পারে, কখনও আবার কার্যনির্বাহী ও বিচারব্যবস্থা ছাড়াও আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি বাছাইও নির্বাচনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া আবার প্রয়োগ হয় বহু বেসরকারী সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। ক্লাব বা সমিতি থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কর্পোরেশন বা নিগমেও এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়।
আধুনিক গণতন্ত্রে প্রতিনিধি বাছাইয়ের উপায় হিসেবে নির্বাচনের সার্বজনীন ব্যবহার করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের আদি চেহারা এথেন্সে নির্বাচনকে যেভাবে ব্যবহার হতো তার তুলনায় এটি অনেকটাই বিপরীত। নির্বাচনকে শাসকগোষ্ঠীর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বেশিরভাগ দপ্তরই পূরণ করা হতো বাছাইয়ের মাধ্যমে। এই নির্বাচন দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া বা অ্যালটমেন্ট নামেও পরিচিত ছিল, এর মাধ্যমেই পদাধিকারীদেরও বেছে নেওয়া হতো। যেখানে নির্বাচনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই সেখানে সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু করা অথবা বর্তমান ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতাকে আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়াকেই নির্বাচনী সংস্কার বলে বর্ণনা করা হয়।
নির্বাচনের ফলাফল ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণাকে (বিশেষ করে আগাম ফলাফল আন্দাজ করার বিষয়টি) সেফোলজি বলে। নির্বাচিত করা-র মানে হলো “বাছাই করা অথবা একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া”এবং কোনো কোনো সময় অন্য ধরনের ব্যালট ব্যবহার হলেও যেমন গণভোটে হয়ে থাকে, তাকেও নির্বাচন হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গণভোট ব্যবস্থা রয়েছে। গণতান্ত্রিক দিক থেকে এটি সম্ভাব্যরূপে ঢুকে গেল। তাই বলা যায় যে নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়
“সবচেয়ে দু:খজনক হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো – যারা ক্ষমতায় আছে কিংবা যারা ক্ষমতায় যেতে চায় – তাদের প্রবণতা হচ্ছে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর আনুকূল্য পাওয়া।”-অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের জের ধরে কোন দেশের নির্বাচনে জাতিসংঘের এগিয়ে আসার উদাহরণ কি রয়েছে?
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করতে প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে মার্কিন কংগ্রেসের ১৪ জন একটি চিঠি পাঠানোর পর এই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা এই চিঠি পাঠালেন এমন সময় যখন বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ এবং ‘জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিতে’ উদ্যোগ নেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়েছিলেন কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য।-বিবিসি নিউজ বাংলা
বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশ্য বিরোধে ঢাকায় রুশ এবং মার্কিন দূতাবাস? আমেরিকার অবস্থান ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে সরকার- বিরোধী দলের রাজনীতি?-বিবিসি নিউজ বাংলা
সম্প্রতি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে ঢাকার রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়েছে, যাতে পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার’ অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিককে ইঙ্গিত করে রাশিয়ার মতো আরেকটি দেশের দূতাবাস থেকে এধরণের বিবৃতি এক নজিরবিহীন ঘটনা।
রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, “কিছু দেশ, যারা নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে দাবি করে, তারা অন্য সাবভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করেনা, এমনকি ব্ল্যাকমেইলও করে।”
রুশ দূতাবাস থেকে এই বিবৃতিটি মঙ্গলবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, তারা কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
বাংলাদেশকে নিয়ে দুটি দূতাবাসের মধ্যে এরকম কূটনৈতিক বচসার ঘটনার অতীতে দেখা যায়নি।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, সে সময় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস এই বিবৃতি দিল।
রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে আমেরিকার নাম উল্লেখ না করলেও সেখানে যে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা বেশ স্পষ্ট। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ““যেসব দেশ নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র হিসেবে পরিচয় দেয় এসব ঘটনা তাদের আধিপত্য বাদের আকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুটে উঠে। জাতিসংঘের সদস্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা শুধু হস্তক্ষেপ-ই করেনা, তারা নির্লজ্জভাবে ব্ল্যাক-মেইল করছে।”
এর ফলে অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
“যেসব দেশে নিজেদের বিশ্বের শাসক মনে করে তারা যদি কোন দেশকে পছন্দ না করে তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ছলে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।”
রুশ দূতাবাস বলেছে, “অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য রাশিয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
আগামী সংসদ নির্বাচন
বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় দলে উদ্বেগের কথা স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ ‘বিচলিত নয়’ বলে দাবী করেছেন দলটির একজন সিনিয়র নেতা। অন্যদিকে মার্কিন ভূমিকা তাদের দলের কর্মীদের ‘উজ্জীবিত করছে’ বলে মনে করছে বিএনপি।
রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন আমেরিকা সক্রিয় হওয়ার পর ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে সার্বিক রাজনীতিতেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি দুই দলের কৌশল এখন নির্ধারিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে ঘিরেই?
নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে দুই প্রধান দলের মধ্যে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আমেরিকাকে ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন তারা তাকে ‘ক্ষমতায় দেখতে চায় না’।
চলতি বছরের মে মাসে শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারেই বলেছিলেন ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে’।
সর্বশেষ এই সপ্তাহেই শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নাম করে তারা চায় যাতে করে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালানো যায় এবং, তার ভাষায়, “এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ধ্বংস করাই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য।”
অনেকেই মনে করেন সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে এবং যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে। সেটিকে সামাল দিতেই শক্ত ভাষায় কথা বলতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।
দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বিবিসিকে বলছেন, “দলের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এটি সত্যি কিন্তু এ নিয়ে আমরা বিচলিত নই। এ নিয়ে আমরাও কাজ করছি”।
অন্যদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার গত কিছুদিনের পদক্ষেপে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন তার দল যেসব বিষয়ে আন্দোলন করছিলো সেসব বিষয়ে আমেরিকাসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলো অবস্থান নেয়ার বিষয়টি ‘দলের সবাইকে উজ্জীবিত করেছে’।
আর আমেরিকার অবস্থানকে ঘিরে দু দলের এমন বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়াকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হিসেবে হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার।
আওয়ামী লীগে উদ্বেগ কতটা
ছবি:কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের অন্যতম মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যা করছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দলে এবং সেটি নিয়ে তারাও সচেতন আছেন।
“দলের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানতে চান যে কি চায় আমেরিকা। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন যে কে কি চায় বা তাদের উদ্দেশ্য কি। আমরা যেটি বলতে চাইছি সেটি হলো ইচ্ছে করলেই কেউ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না। এটা ইরাক নয়, এটা বাংলাদেশ। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও কেউ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কোনো হিসেব করতে পারবে না,” মি. রাজ্জাক বলছিলেন।
মিস্টার রাজ্জাক দলের মধ্যে আমেরিকাকে ঘিরে কি ধরণের আলোচনা হচ্ছে তা পরিষ্কার না করলেও দলটির একাধিক নেতা ধারণা দিয়েছেন যে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র- সব স্তরেই প্রশ্ন উঠছে যে – আমেরিকা আসলে কী চাইছে এবং তারা কতদূর যাবে অর্থাৎ তাদের আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী নীতি কতদূর অগ্রসর হবে।
এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এবং সংসদের বাইরে দলীয় অনুষ্ঠানে আমেরিকা বিষয়ে শক্ত ভাষায় কথা বলেছেন বলে মনে করেন অনেকে।
আবার কেন আমেরিকার সাথে হঠাৎ বিরোধ তৈরি হলো সে প্রশ্নও আছে দলের অনেকের মধ্যে।
দলের নেতারা বলছেন চীনের সঙ্গে ‘অতিরিক্ত মাখামাখি’ আর কিছু বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য রুখতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির মাধ্যমে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে তার সাথে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গত কয়েক বছরের সম্পর্ক ‘সাযুজ্যপূর্ণ’ নয় বলেই মনে করে দেশটি।
মূলত এসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণেই আমেরিকা নির্বাচন নিয়ে এতটা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
“বাংলাদেশ এখন নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেছে। যেটা ভারতও করে। কিন্তু ভারত বড় দেশ তাই তাদের কিছু বলা যায় না। বাংলাদেশ ছোটো বলে অনেকে মনে করে বাংলাদেশকে নিয়ে খেলা যায়,” বলছিলেন মি. রাজ্জাক।
তবে মি. রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাথে আলাপ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাহলো আমেরিকাকে ঘিরে দলের মধ্যকার উদ্বেগ মাঠ পর্যায়ে জনমনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের জায়গাগুলো প্রশমিত করতে।
“তবে একটি সংগঠনের বিষয়ে আমেরিকার প্রতিনিধিরা জোর করতে চাইছে। যদিও ওই সংগঠনটিই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সূতিকাগার,” বলছিলেন দলটির সিনিয়র পর্যায়ের একজন নেতা।
বিএনপি উজ্জীবিত, স্বস্তি দলের প্রতিটি স্তরে
ঢাকায় বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মী মিজানুর রহমান বশির। কথা প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেন, “আমেরিকা এবার আর সরকারকে ছাড়বে না। নির্বাচন ঠিক মতো না করে যাবে কই সরকার”।
অর্থাৎ আমেরিকার চাপেই সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যাবে এবং দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের যে দাবি বিএনপির শেষ পর্যন্ত সেটি অর্জিত হতে যাচ্ছে- এমনটাই বিশ্বাস করেন এখন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী।
এমন চিন্তার কারণ হলো তারা মনে করেন র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও পরে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই মূলত নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন তারা ভোটাধিকারসহ যেসব দাবিতে আন্দোলন করছেন তার সাথে আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো মিলে গেছে।
“এটা তো স্বাভাবিক যে বিষয়টি সবাইকে চাঙ্গা করবে। আমরা আন্দোলন করে জনমত তৈরি করেছি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একই দাবিগুলো তুলছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি আমাদের নেতাকর্মীদের সাহস যুগিয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. চৌধুরী বলেন বিএনপি বা আন্দোলনরত দলগুলো ছাড়াও সিভিল সোসাইটিও একই ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলছে। “তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও যখন একই ইস্যুতে যৌক্তিক অবস্থান নেয় সেটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাইকে উজ্জীবিত করে”।
দলের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন র্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আসায় দলের মাঠ পর্যায়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ‘কোনো কারণে আমেরিকা আর বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দিতে রাজী নয়”।
তাদের বিশ্বাস এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কোনো শক্ত অবস্থান না নিলেও এবার নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই নির্বাচন কেন্দ্রিক শক্ত অবস্থান নেয়ার মূল কারণ এটিই।
আবার দলটির প্রায় সব পর্যায়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী করে- এমন একটি উদ্বেগ আছে। তবে তারা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র শক্ত অবস্থান নিলে কোনো সরকারের পক্ষেই সেটিকে ‘ইগনোর’ করার অসম্ভব’, বলছিলেন দলের মধ্যম সারির একজন নেতা।
একদিকে উদ্বেগ, অন্যদিকে স্বস্তি
অনেকেই মনে করেন মূলত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকেই বাংলাদেশর রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন আমেরিকা গত বেশ কিছুদিন ধরে দৃশ্যমান যে অবস্থান প্রদর্শন করেছে সেটা সরকারি দলের মধ্যে বেশ অস্বস্তি তৈরি করেছে আর বিএনপির মধ্যে এক ধরণের আনন্দ তৈরি করেছে।
“এখন দেখার বিষয় হবে এ পরিস্থিতি নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে গিয়ে কোন দিকে গড়ায়। তবে সরকারের মধ্যেও সামাল দেয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আবার বিরোধীরাও চাইছেন সরকার আরও চাপে পড়ুক। অর্থাৎ আমেরিকাকে ঘিরে হঠাৎ করেই পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
যদিও শুধু রাজনৈতিক দল নয় সিভিল সোসাইটির যে অংশটি ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময় পশ্চিমাদের অবস্থানকে সমর্থন করেছিলো তাদের অনেকেও এখন সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন।
মি.মজুমদার বলছেন আমেরিকা যখন কোথাও একটা অবস্থান নেয় তখন রাজনৈতিক শক্তির বাইরে আরও অনেক গোষ্ঠীই একই সুরে কথা বলে যার মূল উদ্দেশ্যই থাকে আমেরিকা যার বিপক্ষে থাকে -তাকে আরও চাপে ফেলা।
“মূলত এসব কারণেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। আবার এটিই বিরোধী দলগুলোকে স্বস্তি দিচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র কি করছে- সেটা সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও প্রভাবিত করে বা বার্তা দিয়ে থাকে। এখানেও তাই হচ্ছে। এভাবেই রাজনীতির মূল প্রভাবক হয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বা অবস্থান,” বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ করতে চায় না: রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের কোনো আগ্রহ চীনের নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের এক বছর আগে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নানা বক্তব্যের মধ্যে শনিবার এক অনুষ্ঠানে একথা জানান তিনি, যার দেশের নানা বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে।
শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা ভারতের
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একাধিক মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে সহমত নয় ভারত। জি-২০ বৈঠকের আগে এক কূটনৈতিক বার্তায় বাংলাদেশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি।
কূটনৈতিক নোটে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না। কারণ, শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু ভারত মনে করে, জামায়াত একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। ভারতের বার্তায় এ কথা স্পষ্ট করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্ত আছে। বাংলাদেশে জামায়াতের মতো সংগঠন শক্তিশালী হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা সমস্যার মুখে পড়বে। জামায়াতের মতো সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিবিড় যোগ আছে বলেই মনে করে ভারত।
ভারত জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে মন্তব্যগুলো করেছে, তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল দিল্লি ঘুরে যাওয়ার পরই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ভারতীয় প্রশাসনের।
আগামী সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে জি-২০-এর বৈঠক শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেখানে আসবেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং উপমহাদেশের ভূরাজনীতি নিয়ে সমান্তরাল বৈঠক হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভারত জি-২০-এর মঞ্চকে এ বিষয়ে আলোচনার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
আফগানিস্তানের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে, যেভাবে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঘাঁটি সরিয়ে নিয়েছে, ভারত তাতে সন্তুষ্ট নয়। এর ফলে উপমহাদেশ অঞ্চলে অস্থিরতার আশঙ্কা বেড়েছে। তালেবান উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে একটি বড় ‘হুমকি’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছে ভারত। বস্তুত ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক ভিসা নীতির সমালোচনা করেছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। ভারত মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো। ভারত এই নীতিকে ভালো চোখে দেখছে না।
জি-২০ বৈঠকে এই সব কটি বিষয়ই বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় উঠে আসতে পারে বলে মনে করছে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বস্তুত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও আড়ালে এ কথা স্বীকার করছেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মসৃণ থেকেছে। যখনই সে দেশে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এসেছে, দুই দেশের সম্পর্ক ততটা মসৃণ থাকেনি। তাই ভারত সব সময়ই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকারকে গুরুত্ব দেয়।’ উৎপল মনে করেন, ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার দেখতে চায় ভারত। কারণ, ভারত মনে করে, আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে দুই দেশের সীমান্ত আপাতদৃষ্টিতে সুরক্ষিত থাকে।
মার্কিন চাপের মুখে বাংলাদেশের পাশে চীন-রাশিয়া?
‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কি বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়ামুখী করছে? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে চীনের সমর্থন এবং বাংলাদেশের ব্রিকস-এ যোগদানের ঘোষণার পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশ কোনো একটি দিকে না ঝুঁকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের যে লড়াই চলছে তাতে কোনো দিকে এককভাবে অবস্থান নিতে চাইছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি চলছে। আর বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নীতি নিয়ে যে কাজ করছে তারই অংশ হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন ‘চাপের’ মুখে আছে বাংলাদেশ। চীন এর বিপরীতে যে কথা বলছে, তা আসলে দুই দেশের অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে বলছে।
এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইইউতে চিঠি পাঠানোর পরই মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্য সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা আশা করছেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ছয় কংগ্রেসম্যান তাদের চিঠিতে বলেছেন, ” মার্কিন কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট ও বারবার বিবৃতি ও পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার তার মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা মেনে চলা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে। আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার এবং সহিংসতা হয়েছে, যা নির্বাচনের ফলাফলকে কলঙ্কিত করতে পারে এবং সামাজিক সংঘাতকে আরো গভীর করতে পারে।”
এদিকে বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় চীন সব সময় সমর্থন দেবে বলেও জানিয়েছে। বুধবার বেইজিংয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এ কথা জানান।
আর বাংলাদেশের পরররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জেনেভায় বুধবার জানিয়েছেন বাংলাদেশ আগস্টে ব্রিকস-এর সদস্য হতে পারে। চীন, রশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অর্থনৈতিক জোট এটি। আগস্টের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস-এর পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা। এর সদর দপ্তর চীনের সাংহাইয়ে।
র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি প্রণয়ন করেছে। সেই নীতি অনুযায়ী যারা বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না।
বাংলাদেশ কোন দিকে
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ” যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে তা তো স্পষ্ট। তবে এই চাপ যে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তা আমার মনে হয় না। এর পিছনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে চীনকে বিদায় করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ তাতে সমর্থন দেবে কেন?”
তার কথা,‘‘বিশ্বব্যাপী একটি সংকট চলছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। সেখানে বাংলাদেশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাকে ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। আমরা মনে হয় এখন পর্যন্ত সেটা সঠিকভাবেই করা হচ্ছে৷’’
‘‘কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক সমস্যা আছে। এই সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে। আমাদের সমস্যা আর কেউ মিটাবে বা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে, সেটা হতে দেয়া উচিত নয়,’’ বলে মনে করেন মুন্সি ফয়েজ আহমেদ৷
তার কথা, ‘‘মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা চিঠি দিচ্ছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা চিঠি দিচ্ছেন। তারা সংখ্যায় কম। কিন্তু এটা বাইডেন প্রশাসন বা ইইউ কীভাবে নেয়, সেটা দেখার বিষয়। এগুলোসহ মার্কিন ভিসা নীতি, র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে কাজ করতে হবে। আর কোনো দেশ যদি আমাদের সমর্থন করে, তাহলে তো আমরা তাদের বলতে পারি না যে, তোমরা আমাদের সমর্থন কোরো না’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ব্রিকস-এ বাংলাদেশে যোগ দিলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নারাজ হওয়ার কিছু নেই। চীন ও রাশিয়া যেমন এর সদস্য, তেমনি ভারতও সদস্য। আর এটা কোনো সামরিক জোট নয়, এটা অর্থনৈতিক জোট।’’
তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ‘‘ব্রিকস-এর আগামী শীর্ষ সম্মেলনে ডলারের ‘কাউন্টার’ হিসেবে একটি শক্তিশালী মুদ্রা দাঁড় করানোর এজেন্ডা আছে। সেটা কতটা সফল হবে জানি না, তবে এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কনসার্ন আছে। কারণ, তারা ডলারের অধিপত্য ধরে রাখতে চায়।’’
তার কথা, ‘‘এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছে। চীন যা বলছে সেটা তার দেশের অবস্থান থেকে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার অবস্থান থেকে বলছে। এইসব বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যদি দুই পরাশক্তির ঘুর্ণির মধ্যে পড়ে যাই, তা সামলানোর মতো সক্ষমতা আমাদের আছে বলে মনে করি না।’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাইরে থেকে যা দেখছি, তাতে আমাদের কূটনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান আছে। এই ভারসাম্য থেকে কোনোভাবেই সরা যাবে না। সেটা অর্থনীতিসহ নানা কারণে। বিশ্ব রজনীতির যে টানাপোড়েন চলছে, সেখানে আমাদের কোনো পক্ষে যাওয়ার সুযোগ এবং সক্ষমতা নেই।’’- ডয়চে ভেলে
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া, বিডিনিউজ২৪.কম, প্রথম আলো,ডয়চে ভেলে