শিল্প-সাহিত্য ঐতিহ্যের আলোয় মেহেরপুর
আবদুল্লাহ আল আমিনের জন্ম মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটী গ্রামে, ১ জানুয়ারি ১৯৭৩। আকবর হায়দার ও জাহানারা বেগম তার পিতা-মাতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক-সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি অধ্যাপনায় যুক্ত হন। বর্তমানে মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক ও অনুসন্ধিৎসু গবেষক। তাঁর চর্চা ও অনুসন্ধিৎসার বিষয় সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকধর্ম ও লোকজ সংস্কৃতি। গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটিতে।
প্রকাশিত গ্রন্থ: ব্রাত্যজনের রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১২), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি: মেহেরপুর (২০১৩), ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালির সম্প্রীতি সাধনা (২০১৬), বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি-ভাবনা (২০১৭)।
শিল্প-সাহিত্য ঐতিহ্যের আলোয় মেহেরপুর
সংস্কৃতি কোন স্থির বা অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, বরং নিয়ত পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন ও ভাঙাগড়া সংস্কৃতির ভিতর-বাহির বদলে দেয়।
সত্যযুগে সুরথ রাজা।/ করেছিলেন দেবীর পূজা।/ ত্রেতা যুগে রাম।/ কলিযুগে মথুরানাথে/সদয হলে ভবানী,/হায় কী, পূজার ঘটা/মেহেরপুরে মহিষামর্দ্দিনী।’
দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘সেকালের স্মৃতি’গ্রন্থে বলেছেন,
‘ সেকালে মেহেরপুরে সাধারণ গৃহস্থদের অনেকে দুর্গোৎসব, জগদ্ধীত্রী পূজা করিত; কালী পূজা, কার্তিক পূজা তো ঘরে ঘরে লেগেই থাকতো।সরস্বতী পূজা উপলক্ষে কালী বাজারে সপ্তাহব্যাপী জনসাধারণ দিবারাত্রি সেই উৎসবে মত্ত থাকতো; জমাষ্টমীতে বৌবাজারে কত আমোদ, গ্রাম্য শ্রমজীবীরা ময়ুরপক্ষীতে উঠিয়া সাধুগানে গ্রামের পক্ষ প্রতিধ্বনিত করিয়া প্রদক্ষিণ করতো।’
সারা বছর গ্রামে গ্রামে উৎসব লেগেই থাকতো। মানুষে মানুষে বিরোধ-বিভেদ ছিল না। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আচার–আচরণ, খাওয়া-দাওয়ায় পার্থক্য থাকলেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছিল না। উনিশ শতকের সেই সোহার্দ্য সম্প্রীতি মুখর, আনন্দময় মেহেরপুর আর নেই। কালের প্রবাহে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, আচার আচরণ বদলে যায়, মেহেরপুরও তেমনি বদলেছে। পরিবর্তনের হাওয়ায় তার অন্তর্জীবন, বহির্জীবন দুই ওলট পালট হয়ে গেছে। আর এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে রাজনীতি। একথা জোর দিয়েই বোধ হয় বলা যায়, রাজনীতি সব পারে; সব পেরেছে চির বন্ধুদের মধ্যে এনে দিতে পারে যুদ্ধের তাণ্ডব, শত্রুদের মাঝে সৃষ্টি করতে পারে সখ্য সম্পর্ক। এই রাজনীতিই দীননাথ মুখার্জি, শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক এর উত্তর পুরুষদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করেছে; ভেদ সৃষ্টি করেছে হিন্দু মুসলমানে। আবার এই রাজনীতিই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু মুসলমান–বৌদ্ধ–খ্রিস্টান নির্বিশেষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। রাজনীতি কেবল ভূখণ্ডকে ভাগ করে না, ভাগ করতে পারে ভাষা–সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতাকে। সাতচল্লিশের বিভাজন এবং পরবর্তী রাজনীতির বৈরী প্রতিক্রিয়া মেহেরপুরের কয়েকশত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্যকে করেছে বিধ্বস্ত ও শ্রীহীন। এ অঞ্চলের অসংখ্য গ্রাম দেশভাগের করুণ স্মৃতি বহন করে চলেছে। মনে বারবার প্রশ্ন জাগে, কোন কারণে বল্লভপুরের ভবানন্দ মজুমদার নির্মিত শিবমন্দির, আমদহের রাজা গোয়ালা চৌধুরীর রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ নিশ্চিহ্ন হলো। কার অভিশাপে ঢপগান, অষ্টকগান, পীরকীর্তন, ঘাটু গান হারিয়ে গেল?
আত্মপরিচয়ের সন্ধানে মেহেরপুর
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার এক প্রাচীন জনপদ মেহেরপুর। কবে, কখন এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে, তা জানা যায় না। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমি অঙ্কিত মানচিত্রে নদীয়া তথা মেহেরপুরকে উঁচু চরাঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে ছিল অসংখ্য চর–বিল–হাওড় এবং নদ–নদী।এ থেকে অনুমান করা যায়, এখানে মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবীরা বসবাস করতো। এছাড়াও ডোম, বাগদী, কৈবর্ত, বুনো, বেদেদের বাসও ছিল এ অঞ্চলে। মনে করা হয়, সুন্দরবনের কঠোর নিরাপত্তাহীন, বিপদ সঙ্কুল জীবন ছেড়ে একদল নি¤œবর্গীয় মানুষ মেহেরপুর এসে বসতি স্থাপন করে। ১৮৭২ সালের আদমশুমারী তে নদীয়া জেলার জনবিন্যাসের যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতেও নিম্নবর্গীয় অসপৃশ্যদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়। উল্লিখিত অস্পৃশ্যদের মধ্যে ছিল ধোপা, কলু, মাঝি, বাগদী, ডোম, বুনো, বেদে, নিকিরি নলুয়া, তাঁতি প্রভৃতি ব্রাত্য পেশার মানুষ। এরাই এক সময় মুসলিম সুফি–দরবেশদের উদার মানবিক দর্শন ও আচার–আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে। ফলে ষোড়শ শতকের শেষ ও সতের শতকের প্রারম্ভ থেকে মেহেরপুর অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মেহেরপুর অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন দরবেশ মেহের আলী, শাহ ফরিদ, মেহমান শাহ, মালেকুল গাউস। এই চার আউলিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান দরবেশ মেহের আলীর নামানুসারে মেহেরপুর নামকরণ করা হয়। এ মতের সপক্ষে ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর Bangladesh District Gazetters (1976) লিখেছেন:
‘The town was founded in the 16th century by a darvish named Meher Ali Shah after whom the town was named’
মেহেরপুরের নামকরণ মেহের আলীর নামেই যে হয়েছে তারও কোন ঐতিহাসিক প্রমাণাদি খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, মিহিরের নাম অনুসারে মেহেরপুরের নামকরণ হয়েছে। তবে স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় মেহেরপুরের নামকরণের প্রসঙ্গে মেহের আলী শাহ বা মেহের উল্লাহর নাম উঠে এসেছে বারবার। মেহেরপুর এক সময় কেবলই একটি সাধারণ গ্রাম ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে এর চালচিত্র বদলে যেতে থাকে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, মিউনিসিপ্যালিটি, মহকুমা হাকিমের কার্যালয় প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর বদলে যেতে থাকে শহরের পূর্বতন রূপ। উকিল, মোক্তার, সরকারি চাকুরে, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী মিলে গড়ে ওঠে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব জন্ম নেয় আধুনিক মেহেরপুর। ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ মেহেরপুর মহকুমা ও তার কয়েকশত বছরের গৌরবময় স্রােতকে দুভাগে ভাগ করে দেয়। স্রোতদ্বয়ের মৃদু ক্ষীণ স্রোতটি প্রবেশ করে পূর্ব বাঙলায় আর পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশকরে ব্যাপক বিস্তৃত উত্তাল, তরঙ্গ ক্ষুব্ধ স্রোতটি। রচিত হয় মেহেরপুরের নতুন ইতিহাস, তৈরি হয় পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন ভূগোল।
মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যানে মেহেরপুরের গ্রাম-জনপদ
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মেহেরপুর বাগোয়ান পরগণার রাম সমাদ্দারের পুত্র দুর্গাদাস ওরফে ভবানন্দ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেন ‘নদীয়া রাজবংশ’ নামে এক বিশাল রাজবংশ। তিনি কৃষ্ণনগরে রাজধানী স্থানান্তরের পূর্বে ভৈরবের উত্তর কোণে ভবানন্দপুর গ্রামে রাজবাড়ি স্থাপন করেন। এখন বাড়িটি ভবানন্দপুর কাছারী নামে পরিচিত।বাগোয়ানের সন্তান ভবানন্দ মজুন্দারের জীবনালেখ্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি ভারতচন্দ্র (১৭১২–১৭৬০) রচনা করেন ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। এ কাব্যের তৃতীয় খ– অন্নপূর্ণা মঙ্গল বা ‘মানসিংহ, ভবানন্দ উপাখ্যান। এই কাব্যে ভারতচন্দ্র একটি ঘাটের বর্ণনা করেছেন:
‘অন্নপূর্ণা উত্তবিলা গাঙ্গিনীর তীরে।/পার কর বলিয়া ডাকিলা, পাটনীরে\/সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটুনী।/ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি।’(আব্দুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত ‘ভবানন্দ মানসিংহ উপাখ্যান’ ২০০৫, পৃ: ১৪)
এই ঘাটটি আসলে রসিকপুরের ঘাট। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ থেকে ৩/৪ কিলোমিটার পূর্ব–উত্তর কোণে ঘাটটি অবস্থিত। এই ঘাটেই খেয়া পারাপার করতো ঈশ্বরী পাটুনী। মাঝি দেবীকে পার করার পর বর প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। তখন দেবী মাঝিকে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান।’ ঘাটের দক্ষিণ দিকে বল্লভপুর–রতনপুর পাকা সড়ক। এই ঘাটের রাস্তা ছোট এখন ঝোপ ঝাড়ে ভরা, তেমন লোকজন চলাচল করে না। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আর নৌকা পারাপার নেই। বাঁশের ফরাশ পাতা আছে। নৌকা থেকে দেবী যেখানে নামেন সেখানে একটি বটপাকুড় গাছ ছিল। গাছের নিচে একটি বেদী নির্মিত হয়েছিল। সেকালে চৈত্র–বৈশাখ মাস ব্যাপী পূজা অর্চনার আয়োজন করা হতো, বটতলা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠতো। ১৯৪৭ সালে হিন্দুরা দেশত্যাগ করলে সেই বেদীটি আর সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে বেদীতে রক্ষিত দেবীর আসনটি ঈশ্বরী পাটুনীর উত্তরপুরুষ রসিকপুরের মাঝি বাসুদেব বিশ্বাসের বাড়ীতে রক্ষিত আছে। বাসুদেব বিশ্বাসের পিতার নাম কালীপদ বিশ্বাস, তার পিতার নাম সীতারাম মাঝি, তার পিতার নাম দীনু পাটুনী। বাসুদেব বিশ্বাস আজও বেঁচে আছেন। ভবানন্দ মজুন্দার এখন ইতিহাসের অংশ। কিন্তু ১৬০৬-১৬০৭ খ্রি: প্রতিষ্ঠিত বল্লভপুরের শিবমন্দির ও তার রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, ভবানন্দপুরের মন্দির ও কাছারি বাড়ি তার স্মারক বহন করে চলেছে। ভারতচন্দ্র কল্পনা করেছিলেন দেবী অন্নদা ভবানন্দ গৃহে যাত্রা করে ভবানন্দপুরের এই মন্দিরের ঝাঁপি রেখেছিলেন। কবির ভাষায়
‘আপন মন্দিরে গেলা প্রেমভরে ঝাঁপি,/দেখেন মেঝায় এখন একমনোহর ঝাঁপি /গন্ধে আমোদিত ঘর নৃত্য বাদ্য গান।/ কে বাজায় নাচে গায় দেখিতে না পায়’ (পৃ:১৭)।
ভবানন্দপুরের মন্দিরের শিখর ও স্থাপত্য শৈলী দেখে মনে হয় যে, সতের শতকের জমিদার, আমাত্যবর্গ, কানুনগোরা শিবের উপাসক ছিলেন। আর সাধারণ মানুষ ছিলেন লৌকিক দেব–দেবীর অনুসারী। রৌপ্য মুদ্রাভিত্তিক যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়, তাতে একদিকে ছিলেন সুবিধাপ্রাপ্ত ভবানন্দ মজুন্দাররা, অন্যদিকে ছিলেন নিঃশেষিত ঈশ্বরী পাটুনী, হরিহোড়েরা। অর্থনৈতিক বৈষম্য ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে টেনে দেয় গাঢ় বিভাজন রেখা। সাধারণ হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্য আচার ছেড়ে লোকায়ত ধর্ম ও আচারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ধর্ম ও অধ্যাত্ম চর্চার ইতিহাস
পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এই নদীয়াতে নববৈষ্ণব ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬–১৫৩৩) আবির্ভাব। তিনি মানুষ দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ, বাঁচার পথ। বলেছিলেন মানুষে মানুষে ভেদ নেই। মানুষ অমৃতের সন্তান। চৈতন্যের প্রেমভক্তিবাদ ষোড়শ শতকে নদীয়া জেলার মেহেরপুরে এনেছিল প্রাণের জোয়ার। সেই প্রাণের জোয়ারে ভাসে বাংলাদেশ, ভাসে মেহেরপুর।সেই ভাবরসে সিক্ত হয়ে মেহেরপুর নিবাসী কবি জগদীশ গুপ্ত, রমণীমোহন মল্লিকসহ অসংখ্য বৈষ্ণব পদকর্তা রচনা করেন
অজস্র বৈষ্ণব পদাবলী। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবীয় ভাবরসের ধারাটি আজও মেহেরপুরে বহমান রয়েছে।আবার বৈষ্ণবধর্মের অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে আঠার শতকের শেষে বলরামী সম্প্রদায় নামে একটি দ্রোহী লৌকিক গৌণধর্মের আবিভাব হয় এই মেহেরপুরেই। এই ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন বলরাম হাড়ি। যিনি হিন্দু ভক্তের কাছে হাড়িরাম আর মুসলমান ভক্তের হাড়িআল্লা। এ সম্প্রদায়ের অনুসারীরা অধিকাংশই হাড়ি, ডোম, বাগদী, মুচি এবং নিম্নশ্রেণির মুসলমান।
রবীন্দ্রনাথের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানে ‘কোন বলরামের আমি চেলা’ শব্দের লক্ষ্য বলরাম হাড়ি ও তার সম্প্রদায়। বলরাম সারা জীবন মানুষ ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন এবং তার অনুসারীরা বৈদিকমন্ত্র, পূজা অর্চনা, দেব দেবতা, গুরুবাদ মানেন না। প্রথাগত ধর্ম, ধর্মীয় বিধি বিধান, দেব দেউল, শাস্ত্র, মূর্তি অস্বীকার করে গানে গানে তারা তাদের তত্ত্ব–দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। দীনুমুচি, তনুমণ্ডল, বৃন্দাবন হালদার, সদানন্দ, বলাই গেঁড়ো, রাজু ফকির প্রমুখ ছিলেন হাড়ি সম্প্রদায়ের তাত্ত্বিক ও প্রধান গীতিকার। কালের পরিক্রমায় বলরামী সম্প্রদায়ের ধারাটি ক্ষীয়মান, তবু এ অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে হাড়িরামের প্রভাব উল্লেখ করার মতো।
বিশ শতকের সূচনালগ্নে মেহেরপুরের রাধাকান্তপুরে জন্মগ্রহণ করেন নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিগমানন্দ (১৮৮০–১৯৩৭) নামে এক মহান সাধক ও সংস্কারক। তিনি গৃহী হয়েও ছিলেন সন্ন্যাসী, আশ্রমিক হয়েও মানবপ্রেমী সাত্ত্বিক পুরুষ। সংসারকে তিনি আশ্রম’, মানবমুক্তির সোপান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার ধর্মচিন্তায় একই সাথে চৈতন্যদেব ও শঙ্করের দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নিগমানন্দের ধর্ম, দর্শন ও অধ্যাত্মভাবনা তার ‘জ্ঞানীগুরু’ (১৩১৫), ‘প্রেমিক গুরু’, ‘তান্ত্রিক গুরু’ (১৩১৮), ‘যোগীগুরু’ (১৩১২) প্রভৃতি গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। হিন্দুধর্ম ও বিভিন্ন লোকধর্মের পাশাপাশি ইসলামের একটি শক্তিশালী ধারা চতুর্দশ শতক থেকে মেহেরপুর অঞ্চলে বহমান রয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে দরবেশ খান জাহান আলীর নৌবহর ভৈরব নদীপার হয় এবং নদীর দুপাশে বিজিত অববাহিকায় ধর্মপ্রচারের জন্য বাগোয়ানের নামিয়ে দেন দরবেশ শাহ ফরিদকে। শাহ ফরিদের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে এবং বাগোয়ান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পরগণায় পরিণত হয়। শাহ ফরিদ ছাড়াও দরবেশ মেহের আলী শাহ, মেহমান শাহ, মালেকুল গাউস ষোড়শ শতকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে গেছেন। ভেড়ামারার ঘোড়াশাহ, জীবননগরের রেজা শাহ চিশতি, কুষ্টিয়ার একদিল শাহ প্রমুখ ইসলাম ধর্মের প্রসারে নিয়োজিত ছিলেন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। এই সুফি দরবেশরা বিভিন্ন গ্রামে দরগা, আস্তানা, খানকাহ গড়ে তোলেন। এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসে মানুষ দলে দলে ইসলামধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মুরিদদের কাছে পীর দরবেশরা দেবগুরুতে রূপান্তরিত হন। এদের নিয়ে রচিত হয় নানাসব ছড়া, পালাগান, লোকগান, কিংবদন্তি, ব্রত কথা। সেই ধারাবাহিকতায় আজও বাগোয়ানের শাহ ফরিদের দরগা, কালাচাঁদপুরের শাহ ভালাই এর দরগা, সুবিদপুরের শাহ দরগায় শিরনি মানত করা হয়। আয়োজন করা হয় ওরসের মতো বিভিন্ন লোকাচারের।
উনিশ শতকের শেষের দিকে খ্রিস্টান মিশনারীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে গাড়াডোবের
মুনসী জমিরুদ্দিন (১৮৭০–১৯৩৭) অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মপ্রচারক, বাগ্মি ও সুসাহিত্যিক এবং মেহেরুল্লাহর ভাবশিষ্য। তিনি বাংলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজকে ধর্মান্তকরণের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। আবার মেহেরপুর একমাত্র জেলা যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।১৮৪০ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবরপাড়া, বল্লভপুর, রতনপুর, নিত্যানন্দপুর, জুগিন্দা, পাকুড়িয়ার মানুষ দলে দলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। সারা বিশ্বের মত মেহেরপুরের খ্রিস্টানরাও অর্থডক্স ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ে বিভক্ত। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কৃত্যাচার, উৎসব চার্চের স্থাপত্যশৈলী এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
দীনেন্দ্র কুমার রায়
শিল্প সাহিত্য চর্চায় মেহেরপুর
অবিভক্ত নদীয়ার মহকুমা হিসেবে মেহেরপুরের রয়েছে শিল্প সাহিত্যের গৌরবময় ইতিহাস। মোঘল ও নবাবী আমল থেকে এখানে শিল্প সাহিত্য চর্চার প্রসার ঘটে। কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী (১৭৯১–১৮৪৪), বৈষ্ণব পদকর্তা জগদীশ্বর গুপ্ত (১৮৪৫–১৯৮২), রমণীমোহন মল্লিক, দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯–১৯৪৩), মুন্সি জমিরুদ্দীন (১৮৭০–১৯৩৭), আব্দুল হামিদ কাব্যবিনোদ প্রমুখ সাহিত্যিকের জন্ম মেহেরপুরে । বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান অতুলনীয়। এদের মধ্যে খ্যাতিমান ছিলেন জগদীশ্বর গুপ্ত, দীনেন্দ্রকুমার রায়, মুন্সী জমিরুদ্দীন। দীনেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন একাধারে লেখক, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, সংবাদ সাময়িকপত্র সম্পাদক এবং ডিটেকটিভ উপন্যাসের রচয়িতা ও অনুবাদক। তাঁর রচনা পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং দীনেন্দ্রকুমার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছ।’তাঁর রচিত ‘পল্লীচিত্র’ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শেখার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়।আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত রচনাসমগ্র (২০০৪) গ্রন্থের ভূমিকায় কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, ‘এই রচনাগুলির ধমনীতে যে রক্তস্রোত বয়ে চলেছে তা এই এক শতাব্দী পরেও জীবন্ত করেছে। ‘রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ উপন্যাসের লেখক; সাহিত্যিক ও গবেষক কেতকী কুশারী ডায়সনের শৈশব– কৈশোর কেটেছে মেহেরপুরে। অক্সফোর্ডে পড়াশুনা শেষে ব্রিটেনের কিডলিংটনে থিতু এই লেখিকার বাবা অবণীমোহন কুশারী ১৯৪৫–৪৬ সাল পর্যন্ত মেহেরপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড থেকে ইংরেজি সাহিত্যে গ্যাজুয়েট (১৯৬০) ড. কেতকী কুশারী ডায়সন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন মেহেরপুর থেকে।
শিল্প সাহিত্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গর্ব করার মতো ইতিহাস রয়েছে মেহেরপুরের। ১৯১২ খ্রি. নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনী নামে একটি সাহিত্য সংগঠন গঠিত হয় এবং এর মুখপাত্র ‘সাধক’ সাহিাত্য সাময়িকপত্র হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা ছিল উল্লেখ করার মতো। ‘সাধক’ পত্রিকা বন্ধের দু’যুগ পর অমরেন্দ্রনাথ বসুর সম্পাদনায় বের হয় পল্লীশ্রী (১৩৪২)। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর মেহেরপুর শিল্প–সাহিত্য অঙ্গনে নেমে আসে এক ধরনের শূন্যতা।মুক্তিযুদ্ধেরপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষিতে শিল্প সাহিত্য চর্চার ধারা বেগবান হয়।
মেহেরপুর: লালনের ‘আরশিনগরের পড়শি’
লালনশিষ্য দুদ্দু শাহেরর সূত্র ধরে বলা যায়: ‘দয়াল দরজি সাঁই’ ‘আলমডাঙ্গা গ্রামে শুকুর শা’র আশ্রমে’ এসেছিলেন, মেহেরপুরে এসেছিলেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তারপরও মেহেরপুর যেন লালনের ‘আরশিনগরের পড়শি’। ক্ষেত্র সমীক্ষায় জানা যায়, কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহচুয়াডাঙ্গার পরই মেহেরপুরে লালন ভক্ত ও অনুরাগীদের সংখ্যা উল্লেখ করার মত। জেলার প্রায় গ্রামেই রয়েছে বাউল ধারার আখড়া, আশ্রম এবং অনুসারী। এসব আখড়া আশ্রমে কেবল সাধু, ভক্ত অনুরাগীরা আসে না। সাধারণ মানুষও আসে আনন্দের সন্ধানে। জেলায় লালন ভাবদর্শন ও মরমি ভাবুকতাকে জনপ্রিয় করে তুলতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন: আরজান শাহ (ইছাখালি), আজাদ শাহ (সাহারবাটী) মাতু ফকির (আকুবপুর), দবিরউদ্দীন শাহ (কাজীপুর), কলিমুদ্দীন শাহ (যাদবপুর), গোলাম ঝড়–শাহ (যাদবপুর), আজমত শাহ (ঝাঁঝাঁ–হরিরামপুর), আতাহার শাহ (টেঙ্গারমাঠ), দৌলত শাহ (ফতেহপুর), গরীবুল্লাহ শাহ (কাথুলী), রব্বানী শাহ ( গোয়ালগ্রাম), জামাল শাহ ( মেহেরপুর) প্রমুখ। এরা কেউ দীক্ষা নিয়েছেন সতীমার ঘরানায়, কেউ আবার লালনিক ধারায়। কিন্তু এরা সকলেই প্রথাগত ধর্মের বাইরে বেরিয়ে আসা ‘মানুষ সত্যর উপাসক। ধর্ম বা শাস্ত্র নয়, মানুষই এদের আরাধ্য। এদের দেখলে কেমন যেন বিস্ময় ও আনন্দ জাগে। স্ব সমাজ কোন দিন এদের সমাদর করেনি, তবু স্ব সমাজ ও মানুষের প্রতি এদের প্রগাঢ় ভালবাসা। সকল ধরনের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে আনন্দ কল্যাণের সমন্বয়ে এরা জীবনকে দিতে চেয়েছেন এক ভিন্নমাত্রিক তাৎপর্য। কিন্তু সমাজ সংসারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাদের সেই স্বপ্নকে পূরণ হতে দেয়নি। তবু তারা মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখেন দৃঢ়ভাবে। দিন যায়, রাত যায়, কালের রথ এগিয়ে চলে , কিন্তু তাদের পথ চাওয়ার অবসান হয় না। ফুরায় না জীবনের স্বপ্ন। গভীর আশায় বুক বেঁধে তারা গেয়ে যান– প্রেমের গান, মানুষের গান।
বাংলাদেশের বাউল ও মরমি সাধকদের জীবন, কর্ম সাধনা ও গান নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। কিন্তু মেহেরপুরের বাউল, বৈষ্ণব সাধকদের নিয়ে উল্লেখ করার কোন কাজ হয়নি।
‘অথচ মেহেরপুর বাউল ও সুফি প্রভাবিত অঞ্চল।এ জেলার এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে বাউল, বৈষ্ণব বা মরমি সাধকদের সন্ধান পাওয়া যাবে না। মেহেরপুরের গ্রামে গ্রামে রয়েছে বাউল ও মরমি সাধকদের অসংখ্য আখড়া ও আশ্রম।’ (আবদুল্লাহ আল আমিন: আজাদ শাহের পদাবলী’। ফেব্রুয়ারি ২০০৮, ঢাকা। পৃ: ১১৩) আর বাউলদের কর্ম সাধনা ও গানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মেহেরপুরের লোক সংস্কৃতির মূলধারা।
কবিগান : বারোয়ারিতলা থেকে লোকজীবনে
দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘ সেকালের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘ সেকালে বারোয়ারিতলায় যেমন যাত্রাগান হইত। তেমনি কবিগানও হইত। কবিদলের লড়াই সাহিত্য হিসেবে ও উপভোগ্য ছিল। (পৃ: ৩৬৫–৩৬৬)। তিনি লিখেছেন, এন্টনি ফিরিঙ্গি, রাসুনৃসিংহ, দাশরথি রায়ের কবিগান মেহেরপুরের লোক সমাজে জনপ্রিয় ছিল। মেহেরপুরের কবিগানের ধারাকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তারা হলেন: রামেশ্বর দাস (১৭৯৮–১৮৯৩), আকালি বিশ্বাস (১৮৬০–১৯৩০), গোফুর মুন্সি (১৮৮১–১৯৪০), ওলিদাদ মুন্সি (১৯০৪–১৯৮৬), দায়েম বিশ্বাস (১৮৯৭–১৯৮৭), হাবিল বিশ্বাস, মন্মথ রায়, রমজান আলী বিশ্বাস প্রমুখ। রামশ্বর দাস আকালি বিশ্বাস, দায়েম, বিশ্বাস, হাবিল বিশ্বাস, মন্মথ রায়ের কবিয়াল হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। এরা দু’বাংলার বিভিন্ন গ্রামে কবিগান পরিবেশন করতেন। রামেশ্বর দাস, আকালি বিশ্বাস, হাবিল বিশ্বাস আসরে দাড়িয়ে শ্রুতিময়, রসময় গান বাঁধতে পারতেন। কালের প্রবহমানতায় লোকসংস্কৃতির এই বলবান ধারাটি বিলীন হতে চলেছে, তবে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আজও মেহেরপুরের গ্রামে গঞ্জে কবিগানের বড় আসর বসে। ‘কবির লড়াই’ দেখে পুলকিত হয় শিক্ষিত–অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলেই। বলতে দ্বিধা নেই, নিরক্ষরের এই দেশে কবিয়ালরাই আমাদের সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। তারা আজো আমাদের লোকশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
কালের খেয়ায় জারিগান
১৮৮১ সালের আদমশুমারি রিপোর্টে দেখা গেছে যে, মেহেরপুরে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি ছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ায় এখানে নবাবি আমল থেকে জারিগানের প্রচলন রয়েছে। জারিগান সাধারণত মহরম উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় গীত হয়। জারিগানের বিষয়বস্তু কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ এবং ইমাম হাসান–হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যু। এ গানের সুর করুণ ও মর্মস্পর্শী এবং এতে শোর্য–বীর্য কিংবা পৌরুষের স্পর্শ নেই। জারিগানের রচয়িতাদের নাম জানা যায় না। রচয়িতারা আসবে যে গান বাঁধেন তা লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষণ করা হয় না। লোক সংস্কৃতির এ ধারাটি সমৃদ্ধ করেছেন আমদহের আকালি বিশ্বাস, বাগোয়ানের গোফুর মুন্সি, ওলিদাদ মুন্সি, মসলেম মিয়া; খোকসার মসলেম মীর হিতিমপাড়ার দায়েম বিশ্বাস, পাকুড়িয়ার ছাকেন উদ্দীন জুগিন্দার কোকিল বিশ্বাস, আমঝুপির নিজাম মিয়া প্রমুখ। সময়ের বিরুপ প্রতিক্রিয়ায় লোক সংস্কৃতির অনেক উপাদান বিলুপ্তির পথে। কিন্তু জারিগান মেহেরপুর থেকে বিলুপ্ত হয়নি বরং কালের অভিঘাত সহ্য করে বহাল তবিয়তে টিকে আছে।
নদীয়া–কুষ্টিয়া–যশোর নিকটবর্তী ভৌগোলিক অবস্থান, ১৯৪৭’র দেশভাগ, হিন্দুদের দেশত্যাগ, একাত্তরে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ, রাজনৈতিক ভাঙাগড়া মেহেরপুরের শিল্প সংস্কৃতিকে ভিন্নমান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। তবে সংস্কৃতি কোন স্থির বা অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, বরং নিয়ত পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন ও ভাঙাগড়া সংস্কৃতির ভিতর-বাহির বদলে দেয়। তাই পালাবদল আর পরিবর্তনের হাওয়ায় হারিয়ে গেছে এ অঞ্চলের স্বনির্ভর, সচ্ছল, ‘শাশ্বত গ্রাম’। সেই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি মুখর গ্রামীণ জীবন নেই। চণ্ডীমণ্ডপ কিংবা গৃহস্থের উঠোনের রামায়ণ–পুথিপাঠের আসর বসে না। পাল–পার্বণ, মেলা উৎসব, পীরকীর্তন, আলকাপ জারিগান, পালাগান, পাঁচালি, কীর্তনে গ্রামীণ জীবন আর মুখর হয়ে ওঠে না। হেমন্তে ধান কাটার পর মানিকপীরের দল আর গ্রাম্য গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ঘোরে না। দেশভাগ–দেশত্যাগ, বিশ্বায়ন, ভোগবাদী সংস্কৃতির বিকাশ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, মামলা মোকদ্দমা আমাদের জীবন–সমাজ–সংস্কৃতিকে বিপন্ন ও বিধ্বস্ত করেছে। এই জনপদ যে একদিন প্রাণরসের আধার ছিল; তা আমরা ভুলতেই বসেছি।