মুজিব: একটি জাতির রূপকার শ্যাম বেনেগল পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ।। ৮ এপ্রিল ২০১৭ নরেন্দ্র মোদী অনুষ্ঠানিকভাবে চলচ্চিত্রটির ধারণা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
যদিও বহু লোক বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলো তবে তারা কেউ সফল হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের অভিনেতা রাজ তাকে নিয়ে ১৯৭০ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন যার নাম ছিলো বঙ্গবন্ধু।
আবদুল গাফফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দ্য পোয়েট অফ পলিটিক্স (আক্ষ. ’রাজনীতির কবি’) শিরোনামে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এটা শোনা গিয়েছিলো যে অমিতাভ বচ্চন সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন৷ যাই হোক, চলচ্চিত্রটি আলোর মুখ দেখেনি।
ছবি:২০১৭ সালে হায়দ্রাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা
২০১০ সালে ভিবজিয়র ফিল্মস হলিউডে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করে। জানা যায় যে চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ ২০১১ সালে শুরু হবে।এর সাত বছর পরে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার বাবার জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র করার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি তার পছন্দ হয়। ৮ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে, শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নতুন দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদী অনুষ্ঠানিকভাবে চলচ্চিত্রটির ধারণা ঘোষণা করেন।
২৭ আগস্ট ২০১৭-এ ভারতের রাজধানীতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মধ্যকার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিলো বঙ্গবন্ধুর উপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা।১৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে যে চলচ্চিত্র সম্পৃক্ত প্রাথমিক কর্মকান্ড সেই বছর থেকে শুরু হবে।পরিচালনার জন্য ভারত থেকে তিনজন পরিচারলকের নাম প্রস্তাব করা হলে চলচ্চিত্র কমিটি শ্যাম বেনেগলকে বাছাই করে।
শ্যাম বেনেগল চলচ্চিত্রটি পরিচালনার কাজের প্রস্তাব গ্রহণ করেন কেননা তার মনে হয়েছিলো যে চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রটি ছিলো তার সময়ের একটি আকর্ষণীয় ব্যক্তি।পরবর্তীতে ১৪ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে আরেকটি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করা হয়।শ্যাম বেনেগল এছাড়াও বলেন যে এটি একটি বাঙালী জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র।শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন যে চলচ্চিত্রটির ভাষা হোক ইংরেজি বা হিন্দুস্তানি কিংবা উর্দু ভাষা। কিন্তু শ্যাম বেনেগল চলচ্চিত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা তথা বাংলায় নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।বেনেগল বাংলা ভাষা না জানায় তাকে অনুবাদকদের সাহায্য নিতে হয়েছে। দুই বছর পরে এর অফিশিয়াল নাম ঘোষণা করা হয়।পরিচালক চলচ্চিত্রের জন্য এই নাম দেন মুজিব নামটির তাৎপর্যপূর্ণতার কারণে।
চলচ্চিত্রের গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে অতুল তিওয়ারি ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশে ভ্রমণ করেন। পিপলু খান ছিলেন তার সাহায্যকারী ও গবেষণা সংক্রান্ত সহকারী। গবেষণার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা পরিচালককে তার বাবার জীবন সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রের কাহিনী পর্যালোচনা করলেও তিনি এর মধ্যে কোন বড় পরিবর্তন করেননি।চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ করার জন্য শামা জাইদি ও অতুল তিওয়ারি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র সম্পর্কে গওহর রিজভীর গবেষণাপত্রের সাহায্য নেন। গবেষণার অংশ হিসেবে লেখকেরা বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। চলচ্চিত্রের সংলাপের জন্য একটি সংলাপ লেখক কমিটি গঠন করা হয়। অনম বিশ্বাস, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, শিহাব শাহীন ও সাধনা আহমেদকে কমিটির সদস্য হিসেবে বাছাই করা হয়। কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর সদস্যদের সাহায্য করেন।
শ্যাম বেনেগেল পরিচিতি
শ্যাম বেনেগল (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪) হলেন একজন ভারতীয় পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। তার প্রথম চারটি চলচ্চিত্র – অঙ্কুর (১৯৭৩), নিশান্ত (১৯৭৫), মন্থন (১৯৭৬), ও ভূমিকা (১৯৭৭) দিয়ে তিনি একটি নতুন ধরনের অংশ হন, যা বর্তমানে ভারতের “মধ্য চলচ্চিত্র” বলে অভিহিত। তিনি এই পরিভাষাটি অপছন্দ করেন এবং তার কাজগুলিকে নব বা ভিন্নধারার চলচ্চিত্র বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার চলচ্চিত্রগুলিতে প্রধানত নারী এবং নারীর অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে জোর দেওয়া হয়ে থাকে।তিনি ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯৭৬ সালে বেনেগল ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী লাভ করেন এবং ১৯৯১ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ লাভ করেন।২০০৭ সালে বেনেগল ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের আজীবনন সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি সাতবার শ্রেষ্ঠ হিন্দি ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ২০১৮ সালে মুম্বই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ভি. শান্তরাম আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
শ্যাম বেনেগল ১৯৩৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ত্রিমুলঘেরিতে(বর্তমান তেলেঙ্গানা, ভারত) এক ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্টে জন্মগ্রহণ করেন।তার জন্মনাম ছিল শ্যামসুন্দর বেনেগল। তার পিতা শ্রীধর বি. বেনেগল ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। শ্যামের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তার পিতার দেওয়া একটি ক্যামেরা দিয়ে।তিনি হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি হায়দ্রাবাদ ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
মুজিব: একটি জাতির রূপকার চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে ১৫৩ টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে গতশুক্রবার
মুজিব: একটি জাতির রূপকার হলো শ্যাম বেনেগল পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত একটি বাংলা ভাষার জীবনীসংক্রান্ত চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে আরিফিন শুভ বঙ্গবন্ধু নামে খ্যাত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যাকে ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থানের সময় সপরিবারে হত্যা করা হয়।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যয় ৮৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মোট অর্থের ৫০ কোটি ও ভারত ৩৩ কোটি টাকা দিয়েছে।আরিফিন শুভ, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও জায়েদ খান চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মাত্র ৳১ পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছেন। চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখে তথা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর পরের দিন শুরু হওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে চলচ্চিত্রের কাজে দেরি হয়।
চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্রে কে অভিনয় করবেন তা নিয়ে বাংলাদেশীদের মাঝে প্রচুর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ প্রধান চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন, নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকী, বোমান ইরানি, আদিল হুসেইন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারিক আনাম খানের নাম প্রস্তাব করে। অনেক নেটিজেন কিছু অভিনেতাদের ছবি সম্পাদনা করে তাদের চেহারায় বঙ্গবন্ধুর মতো চুল ও গোঁফ বসিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে।
শ্যাম বেনেগল জানিয়েছেন যে এই চলচ্চিত্র পরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি আনন্দিত, ভারতের বন্ধু হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাও করেন।চলচ্চিত্রটির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিবাচক ছিলেন। শ্যাম বেনেগল পরিচালিত চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তিনি আশা করেন যে এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।এর শিল্প নির্দেশক নীতিশ রায়। পিয়া বেনেগল চলচ্চিত্রের পোশাক পরিচালনার দায়িত্বে। দয়াল নিহালনি হলেন এর সহকারী পরিচালক। এর চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন অতুল তিওয়ারি ও শামা জাইদি। এর নির্বাহী প্রযোজক হলো নুজহাত ইয়াসমিন। এর লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ হোসেন জেমি।এর সংলাপ লেখক, তত্ত্বাবধায়ক ও কোচের নাম সাধনা আহমেদ।এর কাস্টিং পরিচালক শ্যাম রাওয়াত ও বাহারউদ্দিন খেলন।
বাংলা ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রটি ইংরেজি ও হিন্দি দুই ভাষাতে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।এর প্রাথমিক মুক্তির তারিখ ছিলো ১৭ মার্চ, ২০২০।পরে এর মুক্তির নতুন তারিখ হিসেবে ১৭ মার্চ, ২০২২ নির্ধারণ করা হয়।৩ মার্চ ২০২২ তারিখে ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন ঘোষণা দেওয়া হয় যে চলচ্চিত্রটি একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি দেওয়া হবে।
৬ই সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা চার দিনের জন্য ভারত সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেন ,যে চলচ্চিত্রটি মুক্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি , তবে তিনি আশা করছেন ২০২২ সালের শেষের দিকে এটি মুক্তি পাবে।
২০২৩ সালের ৩১জুলাই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড চলচ্চিত্রটিকে আনকাট সেন্সর শংসাপত্র প্রদান করে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে হাসান মাহমুদ বলেন যে সরকার অক্টোবরে দেশে চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
২০২৩ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে নিশ্চিত করা হয় যে এটি ২০২৩ সালের ২৭শে অক্টোবর ভারতে মুক্তি পাবে।অক্টোবরের প্রথম দিনে জানা যায় যে , চলচ্চিত্রটি একই মাসের ১৩ তারিখে বাংলাদেশে মুক্তি পাবে।
১২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে বায়োপিকটির প্রিমিয়ার শো দেখেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৩ অক্টোবর শুক্রবার, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৫৩টি সিনেমা হলে মুক্তি পায় ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া