একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি আসাদ চৌধুরী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
আলাপচারিতা
আজ বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে কানাডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। কবি আসাদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।
আসাদ চৌধুরী (জন্ম: ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩- মৃত্যু: ৫ অক্টোবর ২০২৩) বাংলাদেশের একজন কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার ব্যঙ্গার্থক কবিতা ‘কোথায় পালালো সত্য’ একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে
মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধোগতি, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন –
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
নিজের ‘কবিতার জন্মরহস্য’ নিয়ে তিনি এভাবে লিখেছেন- ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো ২০০১ সালে। এরপর ভারতে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবনতি ঘটে। মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা ভাঙচুর ও ধ্বংস করা হয়। সে সময় আমার কবিসত্তা দারুণভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এমন দামামা। আমাকে চরমভাবে ব্যথিত ও আন্দোলিত করে। ভাষা-সংস্কৃতি এক অথচ ধর্মকেন্দ্রিক এই দাঙ্গা। বিশেষত চট্টগ্রামে মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তারই প্রতিফলন আমার এই ব্যথাভরা নতুন কবিতাটি’ (সালিম সুবেরী, কারুজ কবিতাকৃতির মধ্যমাঠে: কবি আসাদ চৌধুরী, নয়াদিগন্ত)।
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
– আসাদ চৌধুরী
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিল গানের সুরে
আগুন ছিল কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিল
এ কথা কে ভাববে ?
কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিল মুক্তিসেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিল সব অন্যায়।
এখন এসব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
আসাদ চৌধুরী ছিলেন স্পষ্টবাদী কবি। ‘সত্যফেরারী’ কবিতায় শক্তিমান এই কবি লিখেছেন-
‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।
গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,
নকশী পাতিল, চৌকির তলা,
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!
সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,
ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!
কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই
রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই
নাটকের কোন সংলাপে নেই
শাসনেও নেই, ভাষণে নেই
আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই
রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,
উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই
লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই
হতাশায় নেই, আশাতেও নেই
প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই
এমন কি কালোবাজারেও নেই
কোথায় গেলেন সত্য?’
আসাদ চৌধুরী আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
আসাদ চৌধুরী ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যারা উলানিয়ার চৌধুরী বংশ হিসাবে পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুষ শায়খ মহম্মদ আসাদ আলী পারস্য থেকে ভারতবর্ষের অযোধ্যা শহরে আসেন। তারপর সেখান থেকে বাংলার মুর্শিদাবাদে আসেন। শায়খ মহম্মদ আসাদ আলীর নাতির ঘরের নাতির ছেলে মহম্মদ হানিফ ছিলেন সুবাহদার শায়েস্তা খাঁর অন্যতম সেনানায়ক, যিনি মগ-পর্তুগিজ জলদস্যু দমনে কর্মরত এবং গোবিন্দপুরের সংগ্রাম কেল্লার জমাদার ছিলেন। হানিফ বৃহত্তর বরিশালের তেতুলিয়া গাঁওয়ে বসবাস শুরু করেন। এই বংশের মহম্মদ তকি তেঁতুলিয়া জমাদার বাড়ি ছেড়ে উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর ছেলে হাসন রাজা হলেন আসাদ চৌধুরীর পরদাদা এবং তিনি তাঁর দুই ভাই কালা রাজা ও নয়া রাজার সাথে সুপারি, লবণ, চালের ব্যবসা করে কলকাতার মারোয়াড়িদের বিখ্যাত বণিক হুকুম চাঁদের সাথে মিত্রতা লাভ করেন। তিন পরদাদারা লালগঞ্জ, আলিগঞ্জ ও কালিগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচুর ফুলুস জমা করে ইদিলপুর জমিদারী স্থাপন করেন।
আসাদ চৌধুরীর বংশলতিকা হচ্ছে: আসাদ চৌধুরী ইবনে মহম্মদ আরিফ চৌধুরী ইবনে এছলাম চৌধুরী ইবনে মজিদ চৌধুরী ইবনে হাসন রাজা ইবনে মহম্মদ তকি।আসাদ চৌধুরীর মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। আসাদ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম।