সমর ভট্টাচার্যের শেষ জীবন পশ্চিমবংগে কেটেছে তিনি জন্মেছিলেন অবিভক্ত নদীয়ার মেহেরপুর মহকুমায়।
সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ দুটি প্রকাশনার বই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
সমর ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন অবিভক্ত নদীয়ার মেহেরপুরে ১৩৪৫ সনের চৈত্র মাসে। সমর ভট্টাচার্যের সত্তা বিচলিত মেহেরপুরের অপরিণত স্মৃতি আজীবন তিনি বহন করেছেন। মেহেরপুর সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের তেহট্ট বেতাই সহ করিমপুর কেন্দ্রিক নদিয়া বলায় তো বটেই জেলা সদর কৃষ্ণনগর শহরের সংগে তার আবল্য পরিচয় সত্ত্বেও উচ্ছিন্ন নিরুপায়তায়ছেড়ে আসা সেই ভূ-বিশ্ব ভৈরবের পাড়ের সেই গ্রামীণ অথচ প্রাচীন মেহেরপুর এবং জেলা মহকুমা মেহেরপুর শহর নিসর্গ মানব সঙ্গে সংস্পর্শে কখনো পিছনে ফেলে যেতে পারেননি শহর না জীবন যাপনেও না নিজের সৃজন বিশ্বে!
অকালপ্রয়াত (প্রয়াণ ২০০২) সমর ভট্টাচার্য কোনদিনই বহুপ্রসূ লেখক ছিলেন না। সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহে সম্পাদনা করেছেন শত্ঞ্জীব রাহা তিনি বলেছেন তাঁর পান্ডুলিপি দেখলে বোঝা যায় লেখার থেকে সংশোধন পরিমার্জনে তিনি কত বেশি সময় দিয়েছেন প্রথমদিকে শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম টানপরণ নিয়ে কিছু গল্প লিখলেও (এই লেখাগুলি রচনা সংগ্রহের শেষে আদি ও অন্য সংগ্রহ বিভাগে সংকলিত হয়েছে) সক্ষেত্রে চিঠির প্রতি খুব বেশি সময় লাগেনি সমরের।
পরবর্তী পর্বে একে একে লিখে গেছেন সুখ, ভূঁই চাপা,একটি নক্ষত্রের ক্রন্দন, গাঙের মানুষ, দিল বানু ,পরান হাটির লাল চাঁদের বউ, চাকা, বাইবেলের সাপ, তার চুল্লি, অক্ষয়বট, বিবি পছন্দ ইত্যাদি গল্প।
তিনি উপন্যাস লিখেছেন একটি-রাবণের সিঁড়ি। তাঁর আরেকটি ছিন্ন উপন্যাস উদ্ধার হয়েছে যা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘জলছবি’।
তার জলছবি উপন্যাসে এসেছে মেহেরপুর পরে ব্যথায় কৃষ্ণনগর গোয়ারীবাজার সবমিলিয়ে এই উপন্যাস এক অদ্ভুত মায়াতে পাঠক্রে আচ্ছন্ন করে রাখেন সমর ভট্টাচার্য।
রচনা সংগ্রহের কথা মুখে সম্পাদক শতঞ্জীব রাহা যথার্থ লিখেছেন দেশ বিভাগের সময় নিত্যান্ত বালক ছিলেন বলেই সম্ভবত রিত্তিকের ছবিতে ব্যর্থ বিভাগ পূর্ব জীবনের সমৃদ্ধি নিয়ে যেটুকু নস্টালজির অনুভব করা যায় তার সমুপস্থিত।
সমরের গল্পের সুজীবনের জন্য আকুতি আছে সেই জীবনের বিনষ্টিতে বেদনা আছে কিন্তু আপস নেই। তাঁর চারপাশের মানুষকে দেশকাল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেখেছেন ।দেখেছেন বেঁচে থাকার প্রবল অভিপ্সাসমূহের নিরিখে।
সমর ভট্টাচার্যের প্রয়াণের প্রায় ১৬ বছর পরে পুরনো পত্রিকার পাতা আর পান্ডুলিপি ঘেঁটে লেখা উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন ‘সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ’ শতঞ্জীব রাহা এটি সুপ্রকাশের বই ।
bo!to! -এ সমর ভট্টাচার্যের লেখক জীবন কথা
যা পাওয়া গেছে
অনতি-বাল্যকালেই তাঁদের পরিবার এপার বঙ্গে চলে এলেও সমর তাঁর সত্তা-বিজড়িত মেহেরপুরের অপরিণত স্মৃতি আজীবন বহন করেছেন। উচ্ছিন্ন নিরুপায়তায় ছেড়ে আসা সেই ভূ-বিশ্ব, ভৈরবের পাড়ের সেই গ্রামীণ অথচ প্রাচীন মেহেরপুরের নিসর্গ ও মানবসঙ্গের স্পর্শকে কখনও পেছনে ফেলে যেতে পারেননি সমর– না জীবনযাপনে, না নিজের সৃজন-বিশ্বে !
যে দারিদ্র্য, অর্থাভাব অনতি-কৈশোর থেকেই সমরের জীবনের মূল অভিজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা কিন্তু ছিল তাঁর শৈশবের বিপরীত যাত্রা। মেহেরপুরে থাকতে সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও খাওয়া-পরার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা, বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীদের স্নেহ ইত্যাদিতে ঘাটতি ছিল না। কিন্তু শৈশবের সুখযাত্রা ছিল নিতান্তই স্বল্পস্থায়ী।
বিভাগোত্তোরকালে সমরদের পরিবার দারিদ্র্যে নিক্ষিপ্ত হয়। কৈশোরে পা দেবার আগেই সংসারযাত্রা নির্বাহের পাঠ নিতে হয় তাঁকে। কখনও ফৌজদারি আদালতের মোক্তারবাবুর মুহুরির সহকারী, কখনও সাইকেল সারাইয়ের দোকানের কর্মী, কখনও সরকারি অফিসের নৈশপ্রহরীর কাজ– দু মুঠো অন্নের জন্য কত কিছুই করতে হয়েছে সমরকে। সম্ভবত সেই প্রথম জীবনের জীবিকানির্বাহের বিপন্নতা ও অনিশ্চিতির টলমল সময় থেকেই তিনি স্বাস্থ্যহানির শিকার হতে থাকেন।
আমৃত্যু (প্রয়াণঃ ২০০২ সাল) ক্ষীণস্বাস্থ্য ও শ্রমনাশা শরীরী বেদনা থেকে তিনি রেহাই পাননি। বরং পরবর্তীকালে পেশাগত কারণে অসুস্থতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শরীর-স্বাস্থ্যের দুর্গতি, পরিবেশের প্রতিকূলতার কারণে তাঁর রচনার পাণ্ডুলিপি তো বটেই– মুদ্রিত কপি পাওয়াও সহজ নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গৃহিণীপনার অভাব। স্ত্রীর অকালপ্রয়াণের পর সমরের সংসারযাত্রাই হয়ে পড়েছিল অনিয়মিত, অসংগঠিত– সন্তানেরা ছিল নাবালক– জীবন-সংরক্ষণের ব্যবস্থাই হয়ে পড়েছিল নড়বড়ে– তো মুদ্রিত রচনা আর পাণ্ডুলিপি!
তবু সমর থাকেন, তাঁকে ধরে রাখতে হয় গলার চারণের সুরটিকেও, তাঁর ভেতরে বেঁচে থাকে আজন্ম-কিশোরটি। এক দেশ থেকে অন্য দেশে নদীপথে পৌঁছোনোর সময় নৌকায়-বসা কিশোরটির চোখ দিয়ে বেঁচে থাকেন সমর—
“নগেন পাটনি নৌকোর কাছি খুলে দাঁড় হাতে গলুইয়ে বসে কারও উদ্দেশ্যে প্রণাম করে যাত্রা শুরু করল।
এখন বর্ষাকাল হলেও বর্ষার শেষপর্ব। গমনের সময় উপস্থিত। শরৎ আসছে আসছে ভাব। নদীর দু-কূলে সাদা বকের ডানার মতন কাশফুলের ইশারা। তারই মধ্যে ধূসর আকাশে ফকিরি আলখাল্লার মতো সবুজ-নীল তালি। আওলা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশময়। কখনও-বা বৃষ্টি হতে হতে চলে যাচ্ছে। কখনও-বা নদীর এপারে বৃষ্টি, ওপার শুষ্ক।
অংশু অবাক হয়ে দেখে। স্রোতের পক্ষে নৌকা তরতরিয়ে ছুটছে। হাওয়াটা পক্ষে বলে ছৈ-এর ওপর বাঁশের দণ্ডে পাল টাঙিয়েছে নগেন পাটনি। হাওয়া পেয়ে পাল ফুলে উঠেছে।
নৌকো ছুটছে পক্ষীরাজের মতন। দু-গলুইয়ে দুজন পাটনি হাল ধরে স্থির বসা। পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। নদীর দু-কূল দু-রকম। এক কূল উঁচু পাউরি, অন্যকূল সমান্তরাল। এখন জলময়। অন্য সময় অংশু দেখেছে হা-হা করা বিস্তীর্ণ বালুচর। পাউরির ফাঁকফোকরে মাছ-শিকারী পাখপাখালির বাসা– মাছরাঙা, শঙ্খচিলের ওড়াউড়ি।”
সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ
By ড: সমর ভট্টাচার্য বইটি বাংলাদেশে অনলাইনে বিক্রয় হয়।