সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে কি ভাবে করবে তা জানিয়েছে :চরমোনাই পীর।।বিএনপিকে সমর্থন ইসলামী আন্দোলনের
আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগের আলটিমেটামসহ চার দফা দাবি জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। আজ শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে তিনি এ ঘোষণা দেন।আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ বিএনপির সব নেতাকর্মীকে মুক্তি ও রাষ্ট্রপতিকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে বলে সভায় দাবি করেন।
বিএনপিকে সমর্থন ইসলামী আন্দোলনের, ইসলামপন্থী অন্য দলগুলো কী ভাবছে
বিবিসি বাংলা বলছে বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখে ‘নির্বাচনে যাওয়া কিংবা না যাওয়ার’ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজেদের কৌশল নির্ধারণের বিষয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসলামপন্থী দলগুলো।
করণীয় নির্ধারণে দলের অভ্যন্তরে নিজেদের মধ্যে এবং বাইরে অন্যদের সাথে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে এসব দলের নেতারা।
এদিকে ইসলামী আন্দোলন শুক্রবার ঢাকায় এক মহাসমাবেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে দলটি বিরোধী দল বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচিকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে।
“সরকার দাবি না নিলে আন্দোলনরত বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবো। ২০১৪ ও ১৮ সালের মতো নির্বাচন মানুষ হতে দেবে না,” মহাসমাবেশে ঘোষণা দিয়েছেন দলটির আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম।
একই সঙ্গে তিনি তিনি আগামী দশই নভেম্বরের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগ করে সব নিবন্ধিত ও প্রতিনিধিত্বশীল আন্দোলনরত দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিএনপিসহ আটক সব নেতাকে মুক্তি দিয়ে জাতীয় সংলাপের জন্য রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আরও কয়েকটি ইসলামপন্থী দল ইঙ্গিত দিয়েছে যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরপরই তারা নির্বাচনে ‘অংশ নেয়া বা না নেয়ার বিষয়ে’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে।
তবে যে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন- সেটিই অব্যাহত থাকলে এসব দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে নাও যেতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন কয়েকটি দলের নেতারা।
বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামি ছাড়া আর যে কয়টি ইসলামী দলের তৎপরতা বেশী দেখা যায় তার মধ্যে ইসলামি আন্দোলন একটি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেনও ২০০৮ সালে ১৬৬ প্রার্থী নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি।
সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়িয়ে পড়া এই দলটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নিয়েও আলোচনায় এসেছিলোা।
আর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন আগেই বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের দলটির ২২ জন প্রার্থী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলো।
কিন্তু এখন আর তাদের জোট কার্যকর নেই। তবে বিএনপির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে মিল রেখে তারাও গত ২৮শে অক্টোবর থেকে একই ধরণের কর্মসূচি পালন করছে।
পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দিতে নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের চাপ আছে-এমন খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।
তবে বহুল আলোচিত হেফাজত ইসলামী নামের মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠনটি রাজনৈতিক বা নির্বাচন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার নীতিই চালিয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
যদিও এই সংগঠনের অনেক নেতাই আলাদা করে বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে কী ভাবছে ইসলামি দলগুলো
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশ নেয়া সত্তরটির মতো ইসলামপন্থী দলের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ছিলো ১০টি। এর মধ্যে ছয়টি ছিলো আওয়ামী লীগের সাথে আর দুটি ছিলো বিএনপি জোটের সাথে।
আর এবার নতুন করে পর্যালোচনার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে এমন ৪৬টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় দল আছে নয়টি।
এগুলো হলো তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (রিক্সা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস (দেয়াল ঘড়ি)।
এর মধ্যে কয়েকটি দলের নেতারা ধারণা দিয়েছেন যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই তারা আসলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন যে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ও বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে অংশ নিবেন কি-না।
এমনকি চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষেই তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেন এমন ধারণাও দিয়েছেন কয়েকটি ইসলামী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসেছিলো তার একটি দল ছিলো ইসলামী ঐক্যজোট। এখন বিএনপির জোটে না থাকলেও তারা নিজেদের মতো করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয়।
দলের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তার দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত অংশ নিবেন কি-না সেটি দশই নভেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত করবেন তারা।
“আমরা সবসময় নির্বাচনমুখী দল। ২০০১ সাল পর্যন্ত সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব ছিলো। এখনো প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা, তবে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেই আমরা নির্বাচনে যাবো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবো দলের শুরা (সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম) বৈঠকে,” বলছিলেন তিনি।
আবার একসময় ইসলামী ঐক্যজোটের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এবং এই দল থেকেও সংসদ সদস্য ছিলো অষ্টম জাতীয় সংসদে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটের অংশ হিসেবে এই দলটির একটি অংশকে তিনটি আসন আর অন্য অংশকে একটি আসন দিয়েছিলো বিএনপি।
সিলেট বিভাগের কিছু জায়গাসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় এ দলটি সক্রিয়। সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটিতেই আগামী নির্বাচনে দলটি প্রার্থী দিবে বলে এর কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয়ভাবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও নির্বাচনে যাবে কি-না তা চূড়ান্ত করার আগে সবশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার দিকে চোখ রেখেছে তারা।
দলটির মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি তাদের দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে তারা অংশ নিবেন।
“আমরা আগে থেকেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চেয়ে আসছি। এখন যেভাবে করার কথা বলা হচ্ছে সেভাবে হলে নির্বাচনে আমরা যাবো না। কিন্তু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এমনকি নির্বাচনে অংশ না নিলে এই দলটি বিএনপির চলমান আন্দোলন ও কর্মসূচিতে সমর্থন দিবে কি-না তা নিয়েও দলটির আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। দলটির অন্য একজন নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না গেলে বিএনপির আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত নির্বাচনে অংশ নেয়া আরেকটি দল হলো বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। তবে তারা কখনোই বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেধে নির্বাচন বা আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি। এবারও বড় দুই দলের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেধেই এগুতে চাইছে দলটি।
“আমরা দেখছি পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। ইসি কতটা ভালো নির্বাচন দিতে হবে সেটি নিশ্চিত হতে হবে। আমরা মনে করি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া দরকার। তফসিল ঘোষণার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন দলটির নায়েবে আমীর মুজিবর রহমান হামিদী।
তিনি বলেন নির্বাচনে যাওয়ার জন্য সরকার পক্ষের কারও সাথে তাদের যেমন কোন কথা হয়নি তেমনি না যাওয়া বা আন্দোলনে সমর্থন দেয়ার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গেও তাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। “আমরা এসব বিষয়ে নিজেদের মতো করেই সবসময় সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি। এবারও তাই করবো”।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গেও যোগাযোগ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেই আছে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। গত নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দুইটি আসন পেয়েছিলো, যেখানে এই দলের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে এবারো তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। এছাড়া মেজবাউর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইসলামি ঐক্যজোটও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে।
তবে ১৪ দলীয় জোটের একটি সূত্র জানিয়েছে যে নির্বাচন প্রশ্নে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা কাজ করছেন এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো বিএনপি নির্বাচনে না আসলে যত বেশি সংখ্যক দলকে নির্বাচনে আনা।
এর বাইরে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও গত নির্বাচনের সময় আটটি ইসলামি দলকে নিয়ে সম্মিলিত ইসলামী জোট নামে একটি জোটের ঘোষণা দিয়েছিলো।
সেই জোটের অংশ হয়েও পরে মতবিরোধ হওয়ায় পাঁচটি আসনে নিজেদের রিকশা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। তবে দলটি এখন দুই ভাগে বিভক্ত এবং উভয় দলই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে।
খেলাফত মজলিসের একাংশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মামুনুল হক বিভিন্ন মামলায় ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে কারাগারে আছেন।
সে কারণে বিএনপি নির্বাচনে না গেলে এই দলটির নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা।
তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে যেসব নির্বাচনগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিচিত সেসব নির্বাচনে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলো প্রায় ১০-১২ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে আসছে।
এক্ষেত্রে নিবন্ধনের বাইরে থাকা অনেক ছোট ছোট দল আছে যারা সরাসরি নির্বাচনে অংশ না নিলেও নানা দল বা জোটের সাথে যৌথভাবে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে থাকে।