ইতিহাসের পাতা থেকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি
রুহুল কুদ্দুস টিটো
২০০৪ সালে বিবিসির অনুষ্ঠানমালার নাম ছিল ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ এবং তার প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব, অভাবনীয়
১৮ বছর আগে তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে বিবিসি শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার নববর্ষ ভোর সাড়ে ছ’টার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়, তাঁর জীবন কাহিনী প্রচার করা হয়। তার আগের দিনই সবাই বুঝে গেছেন প্রথম স্থানে কার নাম থাকতে পারে – যার নাম আগের ১৯টি স্থানে আসে নি।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।শীর্ষ স্থান অধিকারী শেখ মুজিবর রহমান বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।বাঙালাকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠিকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিল।
“…মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।
দেশের প্রচুর মানুষ এতে আনন্দিত হয়েছিলেন, আবার কিছু লোক বেশ ক্ষুব্ধ ও হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনুসারীরা এখানে একটি ‘ষড়যন্ত্রের’ আভাস খুঁজে পেলেন। রবীন্দ্র-ভক্তরা প্রশ্ন করলেন, কীভাবে অন্য কোন বাঙালি বিশ্বকবির ওপরে স্থান পান। অনেক পত্রিকা এই অনুষ্ঠানমালাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে তালিকার শীর্ষে শেখ মুজিবের স্থানের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে লেখা-লেখি প্রচার করে। অন্যদিকে দু’ তিনটি পত্রিকা এই জরিপকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: শেখ মুজিবুর রহমান। (১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তোলা ছবি)
দ্বিতীয় স্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তৃতীয় স্থানে কাজী নজরুল ইসলাম।
চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে এ কে ফজলুল হক এবং সুভাষ চন্দ্র বোস
ষষ্ঠ স্থানে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
জগদীশ চন্দ্র বসু, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, রামমোহন রায়, মীর নিসার আলী তিতুমীর এবং লালন ফকির।
সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, বায়ান্নর ভাষা শহীদ, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বিবেকানন্দ, অতীশ দীপঙ্কর, জিয়াউর রহমান এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: বিবিসির ২০০৪ সালের অনুষ্ঠানমালা যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল
সাবির মুস্তাফা সম্পাদক, বিবিসি নিউজ বাংলায় প্রকাশিত লেখা থেকে তুলে ধরা হলো
বিবিসি বাংলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান করেছে, যেগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কিছু অনুষ্ঠানকে হয়তো যুগান্তকারীও বলা যেতে পারে। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগ ছিল ইতিহাসের কোন একটি বিশেষ সময়ে খবরের বিশেষ চাহিদা মেটানোর ব্যাপার।
যেমন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রতি দিনের খবর। বাংলাদেশের যুদ্ধ-অবরুদ্ধ মানুষের কাছে সেসময় প্রতিটি খবরই যেন ছিল এক একটি যুগান্তকারী অনুষ্ঠান।
তারপর আশির দশকের শেষ দিকে যখন তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, তখন বিবিসির গুরুত্ব আবার হয়ে ওঠে অপরিসীম।
হরতাল, মিছিল, মিটিং, আন্দোলনের খবর যাতে জনগণের কাছে না পৌঁছয়, সেটাই ছিল সরকারের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে দেশের মিডিয়ার ওপর আরোপ করা হয় সেন্সরশিপ, এমনকি বিবিসির বিদেশী সংবাদদাতাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়, আর স্থানীয় প্রতিনিধি আতাউস সামাদকে নেয়া হয় কারাগারে। এমন অবস্থায় বিবিসি বাংলার ওপর মানুষের নির্ভরতা প্রচণ্ড ভাবেই বেড়ে যায়।
একই জিনিস হলো ১৯৯০ সালের শেষ মাথায়, যখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বিবিসি বাংলার সংবাদের ওপর মানুষের নির্ভরতা আমরা আরেকবার খেয়াল করলাম ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের ব্যাপক সহিংসতা, কেয়ারটেকার সরকারকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট, অচলাবস্থা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নির্বাচন স্থগিত আর জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠানমালা
তবে এসব ছিল ঘটনা-নির্ভর, দৈনন্দিন সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপার। কোন একক বিষয়ের ওপর একটি অনুষ্ঠানমালা, যার সাথে সাময়িক ঘটনার কোন যোগাযোগ নেই, যেটাকে কোনভাবে ‘খবর’ বলা যাবে না, সেরকম কোন ফিচার সচরাচর আলোড়ন সৃষ্টি করে না, আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায় না।
তবে ২০০৪ সালে ঠিক তাই হয়েছিল। অনুষ্ঠানমালার নাম ছিল ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ এবং তার প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব, অভাবনীয়।
দু’হাজার তিন সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় বিবিসির নতুন অফিস উদ্বোধন করা হয়। এই প্রথম ঢাকায় বিবিসির অফিসে দুটি স্টুডিও স্থাপন করা হলো। লন্ডন থেকে প্রচারিত রেডিও অনুষ্ঠানগুলোতে সরাসরি অংশগ্রহণ করার সুবিধা ঢাকার এই নতুন স্টুডিওগুলো সংযোগ করা হয়।
এই স্টুডিওর যাতে সদ্ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ভোরে র অনুষ্ঠান প্রভাতীতে ঢাকা থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া যায়, সে লক্ষ্যে কিছু প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিবিসি বাংলার কর্মীরা নতুন অনুষ্ঠানের রূপরেখা তৈরি করেন, যার একটি উদ্দেশ্য ছিল অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সম্পৃক্ততা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা দেখা।
তাদের একটি প্রস্তাব ছিল শ্রোতাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি জরিপ। বিষয়? সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
বিষয়টা নিয়ে কিছুটা চিন্তা করলাম। এই জরিপের মাধ্যমে শুধু শ্রোতাদেরকেই যে অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে তাই না। বাঙালির ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার অপূর্ব সুযোগও তৈরি হবে। কোন্ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে অনুষ্ঠানমালা তৈরি হবে, সেটাও ঠিক হয়ে যাবে এই জরিপের মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশে তখন রাজনৈতিক উত্তাপ তেমন নেই। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার দেশ চালাচ্ছে। বিরোধীদল হাল্কা আন্দোলনের মধ্যে থাকলেও, দেশে কোন অস্থিরতা নেই, কোন অনিশ্চয়তা নেই। এই সময়ে বাঙালির ইতিহাসের মনীষীদের নিয়ে অনুষ্ঠানমালার চেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ আর কী হতে পারে?
প্রশিক্ষণের সময় আমার সহকর্মীরা একটি সঙ্গীত বাছাই করেছিলেন এই অনুষ্ঠানমালার ঘোষণা বা ট্রেলারের সাথে বাজানোর জন্য। সঙ্গীতটি গতানুগতিক কোন বাংলা গানের সুর ছিল না। ব্রিটেনের ব্র্যাডফোর্ডে জন্ম নেয়া এবং লন্ডনে বেড়ে ওঠা দুই সিলেটি ভাই, ফারুক এবং হারুন শমসের-এর ব্যান্ড ‘জয়’- এর ‘দ্য জার্নি’ টিউনটিই আমরা বেছে নেই ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’র সূচনা সঙ্গীত হিসেবে।
প্রশিক্ষণ শেষে আমরা যখন জরিপটি করার সিদ্ধান্ত নিই, তখন কয়েকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। প্রথমত: কয়টা পর্ব হবে, অর্থাৎ কয়জন সেরা বাঙালিকে নিয়ে অনুষ্ঠানমালা হবে? উত্তর: ২০জন ব্যক্তি, ২০টি পর্ব। দ্বিতীয় প্রশ্ন: পর্বগুলো কি দৈনিক হবে নাকি সাপ্তাহিক? উত্তর: শ্রোতার মনে দাগ কাটার জন্য দৈনিক প্রচারই শ্রেয়। তৃতীয় প্রশ্ন: কীভাবে এই পর্বগুলো প্রচার করা হবে? উত্তর: কাউন্টডাউন পদ্ধতিতে এগুলো প্রচার করা হবে – অর্থাৎ, প্রথম দিন ২০ নম্বর, দ্বিতীয় দিন ১৯ নম্বর, তৃতীয় দিন ১৮ ইত্যাদি। এর ফলে এক ধরনের উত্তেজনা এবং প্রতীক্ষার আমেজ সৃষ্টি হবে।
স্বাধীনতা দিবস থেকে বাংলা নববর্ষ
চতুর্থ প্রশ্ন: এই ২০টি পর্ব কখন প্রচার করা হবে? উত্তর: ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাতেই একটি সময় মনে হলো লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসলো – মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে এপ্রিলের ১৪ তারিখ, ঠিক ২০ দিন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে শুরু করে বাংলা নববর্ষের নববর্ষে দিনে শেষ। ইতিহাসের সেরা বাঙালিদের জীবন নিয়ে অনুষ্ঠানমালা প্রচার করার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় আর কী থাকতে পারে?
তবে এই অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম। প্রথমত, বাংলাদেশের মিডিয়াতে এধরনের তালিকা মাঝে-মধ্যে প্রকাশ করা হয়, যা নিয়ে হয় বিতর্ক হয়, না হয় সেগুলোকে তাচ্ছিল্য করা হয়। তার চেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল ফলাফল নিয়ে বিতর্কের সম্ভাবনা।
‘হঠকারি জরিপ‘
যেমন, ট্রেলার চলাকালে বাংলাদেশের একজন শ্রোতা চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করলেন, “এই জরিপের ফলাফল প্রকাশের সাহস কি আপনাদের আছে?” কিন্তু এখানে সাহসের কিছু ছিল বলে আমার মনে হয়নি। আবার, পশ্চিমবঙ্গের একজন শ্রোতা এই জরিপ বন্ধ করার জোর আবেদন জানালেন। তাঁর যুক্তি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুভাষ চন্দ্র বোসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলা তাঁর কাছে হঠকারিতা।
ঝুঁকিগুলো আমরা বিবেচনা করে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানে আমরা নিজেদের কোন মনগড়া তালিকা তৈরি করছি না। এখানে শ্রোতারা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের মতামত জানাবেন, এবং সেই মতামতের ভিত্তিতে, কোন রকম মারপ্যাঁচ ছাড়াই ২০জন সেরা বাঙালির তালিকা তৈরি করা হবে। স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করা জরিপ ‘বিজ্ঞানসম্মত’ নাও হতে পারে। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এই তালিকা যে নিরপেক্ষ, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না।
মার্চ মাসের ২৬ তারিখে যাতে অনুষ্ঠানমালা শুরু করা যায়, সে লক্ষ্যে প্রতিদিন রেডিও অনুষ্ঠানে ঘোষণা বা ট্রেলার বাজানো হলো, যার মাধ্যমে জয়-এর দ্য জার্নি টিউনটি শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত চিঠি এবং ইমেইল গ্রহণ করা হয়।
প্রতি শ্রোতাকে পাঁচজন করে ব্যক্তিকে বাছাই করতে অনুরোধ করা হয়। তাদের ক্রমানুসারে পয়েন্ট দেয়া হয় – যেমন, প্রথম স্থানে যিনি তাঁকে ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় স্থানে চার, ইত্যাদি। সব পয়েন্ট যোগ করে পূর্ণ তালিকা তৈরি করা হয়, যাতে শতাধিক ব্যক্তির নাম স্থান পায়। তালিকার প্রথম ২০জনকে নিয়ে তৈরি করা হয় ২০ পর্বের অনুষ্ঠানমালা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’।
শ্রেষ্ঠ বাঙালির ‘কাউন্টডাউন’
এই অনুষ্ঠান নিয়ে আমরা কোন মার্কেটিং তৎপরতা চালাই নি। এমনকি কোন পত্রিকাকে একটি প্রেস রিলিজ পর্যন্ত দেয়া হয় নি। কিন্তু প্রথম পর্ব, অর্থাৎ ২০ নম্বরে রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম প্রচার হবার পরে দেখা গেল ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় অনুষ্ঠানের সারমর্ম ছাপা হয়েছে। কিছু দিন পর আরও দু’তিনটি পত্রিকা শ্রেষ্ঠ বাঙালির ‘কাউন্টডাউন’ কাভার করতে শুরু করলো। অনুষ্ঠান যখন তালিকার ১০ নম্বরে পৌঁছায়, তখন আট-দশটি জাতীয় পত্রিকা গোটা অনুষ্ঠানই তাদের প্রথম পাতায় তুলে ধরছিল। শেষের দিকে মোটামুটি সব পত্রিকাই যোগ দেয়।
তালিকার প্রথম স্থান, অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছিল। এপ্রিলের ১৩ তারিখের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় স্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষণা করা হয়। পরের দিন, বাংলা নববর্ষের ছুটি। নববর্ষের প্রভাতী অনুষ্ঠানে আসবে প্রথম স্থান। কিন্তু তার পরের দিন, ১৫ই এপ্রিল কোন পত্রিকা বের হবে না। দু’দিন পর, ১৬ তারিখে শ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রথম স্থান আর ‘তাজা খবর’ থাকবে না।
তাই ১৩ তারিখে বেশ কয়েকটি পত্রিকা থেকে আমাদের ঢাকা অফিসে ফোন করে প্রথম স্থানের নামটি নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হলো, যাতে তারা ১৪ তারিখের পত্রিকাতেই সেই খবর প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ১৪ তারিখের আগে এই প্রথম স্থান আমরা পত্রিকাদের জানিয়ে দিতে পারি না। অনুষ্ঠান করা হয়েছে আমাদের রেডিও শ্রোতাদের জন্য, তাদেরই দেয়া ‘ভোটে’ তৈরি এই তালিকা। কাজেই প্রথম তাঁরাই শুনবেন তাঁরা কাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মনোনীত করেছেন।
নববর্ষের ভোরে মুজিবের নাম
ভোর সাড়ে ছ’টার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়, তাঁর জীবন কাহিনী প্রচার করা হয়। তার আগের দিনই সবাই বুঝে গেছেন প্রথম স্থানে কার নাম থাকতে পারে – যার নাম আগের ১৯টি স্থানে আসে নি। কিন্তু তারপরও, আমাদের অনুষ্ঠানে ঘোষণা না আসার আগে কেউ সেটা ছেপে দেন নি।
এই অনুষ্ঠানমালা ঘিরে মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ এবং প্রতীক্ষার উত্তেজনা ছিল,তা বিবিসি বাংলার অন্য কোন অনুষ্ঠান বা সিরিজ ঘিরে হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। এপ্রিলের ১৬ তারিখের পত্রিকা দেখে মনে হয়নি খবরটি ‘বাসি’ হয়ে গেছে। একবারে তাজা খবরের মতই অনেক পত্রিকাতেই শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছিল শীর্ষ খবর। একটি পত্রিকা পুরো ২০টি পর্ব নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।
দেশের প্রচুর মানুষ এতে আনন্দিত হয়েছিলেন, আবার কিছু লোক বেশ ক্ষুব্ধ ও হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনুসারীরা এখানে একটি ‘ষড়যন্ত্রের’ আভাস খুঁজে পেলেন। রবীন্দ্র-ভক্তরা প্রশ্ন করলেন, কীভাবে অন্য কোন বাঙালি বিশ্বকবির ওপরে স্থান পান। অনেক পত্রিকা এই অনুষ্ঠানমালাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে তালিকার শীর্ষে শেখ মুজিবের স্থানের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে লেখা-লেখি প্রচার করে। অন্যদিকে দু’ তিনটি পত্রিকা এই জরিপকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করে।
কয়েক দিন পরে বিবিসির হিন্দি বিভাগের একজন সিনিয়ার সহকর্মী আমাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথ প্রথম স্থানে না আসায় তিনি অবাক হয়েছেন। আমি জবাবে বললাম, ৩০ বছর আগে এই জরিপ হলে রবীন্দ্রনাথ নি:সন্দেহে শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনোনীত হতেন। কিন্তু এই ৩০ বছরে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেছে – বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের আবির্ভাব হয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব। এই জরিপের ফলাফল সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন।
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা