“সহীহ বুখারী” কেন কি ভাবে লেখা ।। ইমাম বুখারী কে ছিলেন ।। মুসলিম বিশ্বে বুখারি শরীফকে আল-কুরআনের পরেই সম্মান করা হয়
আলাপচারিতা
ইমাম বুখারী ছিলেন একজন আলেম ও বিখ্যাত হাদীসবেত্তা। তিনি “সহীহ বুখারী” নামে একটি বিশুদ্ধ হাদীসের সংকলন রচনা করেন, যা মুসলমানদের নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস-গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর জন্মনাম হল মুহাম্মদ। উপনাম আবু আবদুল্লাহ। আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীস তাঁর উপাধি।
বুখারা তাঁর জন্মস্থান বলেই সেদিকে সম্পৃক্ত করেই তাকে ইমাম বুখারী বলা হয়।
ছবি : মানচিত্রে হাদিস অন্বেষণে ইমাম বুখারীর সফর।
হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।
তিনি ১৯৪ হিজরি সালের ১৩ শাওয়াল রোজ শুক্রবার (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের বুখারা নামক ( বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ ) স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইসমাইল। তাঁর দাদার নাম ইব্রাহিম। তাঁর দাদার সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও তার বাবা ইসমাঈল তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনিও একজন হাদীসবিদ ছিলেন। তিনি হাদিস শাস্ত্রবিদ আল্লামা হাম্মাদ ও হযরত ইমাম মালেকের শাগরিদ ছিলেন।
এছাড়াও বিখ্যাত মনীষী আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের শাগরিদ ছিলেন বলে জানা যায়।সমসাময়িক যুগের অনেক বুজুর্গ আলেমের কাছ থেকে দ্বীনের জাহেরি এবং বাতেনি ইলম হাসিল করে সুযোগ্য আলেম ও বিজ্ঞ মুহাদ্দিস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ইমাম বুখারী শিক্ষা, জ্ঞান ও যোগ্যতা শুধু পিতার দিক থেকে পাননি; বরং মাতার দিক থেকেও অর্জন করেন। ইমাম বুখারীর মাতা ছিলেন বিদূষী ও মহীয়সী মহিলা। তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে।
বাল্যকালে ইমাম বুখারী একবার একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং এই রোগের প্রভাবে তার দুই চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মা পুত্রের চোখের আলো পুনঃপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এক রাত্রে স্বপ্নে তিনি হযরত ইব্রাহীমকে তার শিয়রে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত ইব্রাহীম তাকে বলেন, তোমার প্রার্থনা আল্লাহ্ কবুল করেছেন। পরদিন সকালে তিনি ঘুম থেকে জেগে তার পুত্র ইমাম বুখারীকে দেখেন যে, তার চোখ ভাল হয়ে গিয়েছে।
ইমাম বুখারী শৈশবেই বাবাকে হারান। এরপর মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। পিতা মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধনসম্পদ রেখে যান। ইমাম বুখারীর বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। প্রথমত তিনি কোরআন পাঠ শুরু করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্থ করা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি “আবদুল্লাহ বিন মুবারক” ও “ওয়াকীর পান্ডুলিপিসমূহ” মুখস্থ করে ফেলেন।
ইমাম বুখারী ষোল বছর বয়সে তিনি মা এবং বড় ভাইয়ের সাথে হজ্জে গমন করেন। হজ্জের পর তিনি মক্কাতে রয়ে গেলেন এবং হিজাযের হাদীসবিশারদদের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করতে থাকলেন। এ সময় তিনি “কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবীয়ীন” নামক গ্রণ্থ রচনা করেন। এরপর হাদীস অন্বেষণের জন্য তিনি ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ বহু অঞ্চলে সফর করেন। একদা ইমাম বুখারি মুহাদ্দিস দাখেলির দরসগাহে যোগ দেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি হাদীস অন্বেষণের ভ্রমণ শেষ করে নিজ মাতৃভূমি বুখারায় ফিরে আসেন।
ইমাম বুখারীর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর
১৮ বছর বয়সে আবারো তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন।
তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তার জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন। তার জীবনীতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে,একদা ইমাম দাখেলি একটি হাদিসের সনদ বর্ণনা করবার সময় ‘জুবাইর’ এর স্থলে ‘আবু জুবাইর’ বলেছেন। ইমাম বুখারি নম্রস্বরে বললেন- এখানে আবু জুবাইর’ এর স্থলে ‘জুবাইর’ হবে। অতঃপর ইমাম দাখেলি বাড়িতে গিয়ে কিতাব দেখে তার ভুল সংশোধন করেছেন। এর অব্যবহিত পরই দাখেলি তাকে খুব স্নেহ করতেন।
তিনি এতদ্ভিন্ন অন্য এক দরসগাহে ও যোগ দিতেন। সেখানে অন্য ছাত্রগন হাদিসগুলো লিখে নিতেন। তিনি তা লিখতেন না। তার সহপাঠীগণ তাকে হাদিস না লিখে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর দেননি। অতঃপর সহপাঠীগণ তাকে হাদিস লেখার জন্য জোর তাগিদ দিলে তিনি উত্তর দিলেন- “আপনাদের লেখা কপিগুলো নিয়ে আসুন। তারা কপিগুলো নিয়ে আসলে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাদের সামনে হাদিসগুলো পাঠ করে শোনান। সেই মজলিসে তাদের লেখা অনুসারে প্রায় পনের হাজার (১৫,০০০) হাদিস মুখস্থ পাঠ করে শোনান। ইমাম বুখারী বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীস মুখস্থ রয়েছে। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেনি।
বাগদাদে স্মরণ শক্তির পরীক্ষা
তৎকালীন সমগ্র ইসলামী রাজ্যে যখন মুহাদ্দিছ হিসেবে ইমাম বুখারীর কথা ছড়িয়ে পড়ল তখন সেই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তিনি যখন বাগদাদে আগমণ করলেন তখন চারশত মুহাদ্দিস একত্রিত হয়ে ১০০টি সহীহ হাদীছ নির্বাচন করে তার সনদ ও মতন পাল্টিয়ে দিয়ে ১০ ভাগে বিভক্ত করে দশজন মুহাদ্দিসের হাতে সোপর্দ করলেন। অতঃপর তার জন্য হাদীসের মজলিস স্থাপন করা হলো। তিনি যখন আসন গ্রহণ করলেন তখন প্রথমে একজন মুহাদ্দিস ১০টি হাদীস নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি একটি করে সবগুলো হাদীস পাঠ করে শেষ করলেন। প্রতিটি হাদীস পড়া শেষ হলেই ইমাম বুখারী বললেনঃ এ ধরনের কোন হাদীস আমার জানা নেই। এমনিভাবে ১০ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ১০০টি হাদীছ তার সামনে পাঠ করলেন। সকল হাদীছের ক্ষেত্রেই তিনি বার বার একই কথা বললেন।
পরিশেষে তিনি সকলকে ডেকে উলটপালট কৃত হাদীসগুলোর প্রত্যেকটি হাদীসকে তার আসল সনদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন এবং ঠিক করে দিলেন। হাদীছগুলোর সনদ থেকে কোন রাবীর (হাদিস বর্ণনাকারী) নাম বাদ পড়েনি এবং মতনসমূহ থেকে একটি শব্দও ছুটে যায় নি। এমনকি হাদীসগুলো সঠিকভাবে সাজানোতে মুহাদ্দিছগণ তার কোন ভুল-ত্রটি ধরতে পারেন নি। বলা হয় যে, সমরকন্দে যাওয়ার পরও তাকে একই নিয়মে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এতে সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে সকলেই তাকে স্বীকৃত প্রদান করলেন।
ইমাম বুখারীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম হচ্ছে হাদিসের এই গ্রন্থের রচনা। তিনি নিজের শিক্ষক ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন। একদিন ইমাম ইসহাক একটি এমন গ্রন্থ প্রকাশ করার আশা করেন, যাতে লিপিবদ্ধ থাকবে শুধু সহিহ হাদীস। ছাত্রদের মাঝে ইমাম বুখারী তখন এই কঠিন কাজে অগ্রসর হন। ২১৭ হিজরী সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মক্কার হারাম শরীফে এই গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী সনে এর সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়। বুখারী শরীফের সংকলনকালে তিনি সর্বদা রোজা রাখতেন এবং প্রতিটি হাদীস গ্রন্থ সন্নিবেশিত করার আগে গোসল করে দু’ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে মুরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন।এই গ্রন্থে তিনি সকল সহিহ হাদীস সংকলন করেননি। বরং সহিহ হাদীসের মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে, সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন।
তিনি স্বয়ং বলেন, “আমি জা’মে কিতাবে সহিহ হাদিস ব্যতীত অন্যকোন হাদিস ওল্লেখ করিনি। তবে কলেবর বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সহিহ হাদিসকে বাদ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি আমার কিতাবে প্রতিটি হাদিস লেখার পূর্বেই গোসল করেছি এবং দু রাকাআত নামায আদায় করে নিয়েছি।
ইমাম বুখারীর প্রায় ৬ লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। বুখারী শরীফের পুরো নাম হলোঃ আল-জামি আল-সাহীহ আল-মুসনাদ মিন উমুরি রাসূলিল্লাহ ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। বুখারি শরীফ প্রণয়ের স্থানঃ আবুল ফজল মোহাম্মদ বিন তাহেরের বর্ণনা মতে, ইমাম বুখারী তাঁর গ্রন্থখানি বুখারাতে বসে রচনার কাজ শেষ করেছেন। আবার কারো মতে মক্কা মুয়াজ্জামায় আবার কারো মতে বসরাতে। তবে উল্লেখিত সকল বর্ণনা নির্ভুল। কেননা তিনি উল্লেখিত স্থানগুলোর সকল নগরীতে অবস্থান করেছেন।
স্বয়ং ইমাম বুখারী বলেছেন, আমি আমার সহিহ বুখারি সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়ের কাজ শেষ করি।
আর প্রতি বছরই হজ্ব পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি। তিনি ৬ লাখ হাদিস হতে যাচাই বাছাই করে সর্বসাকুলে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিধ্য গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। এখানে মোট হাদিস আছে সাত হাজার একশত পচাত্তর খানি(৭,১৭৫)। আর পুনরুক্ত ছাড়া আছে চার হাজারের (৪,০০০) মতো। আর কারো মতে, বুখারিতে পুনরুক্ত হাদিস আছে মাত্র একখানি যা রুমালের বর্ণনা।
সহীহ বুখারী সংকলনের কারণ
ইমাম বুখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীস সমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও যঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম যঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন।
তিনি তার বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতে এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেন যে, এক দিন আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইয়ের মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ যদি হাদীসের এমন একটি গ্রন্থ করতো, যাতে শুধু সহীহ হাদীসগুলোই স্থান পেতো তাহলে খুবই সুন্দর হতো। মজলিসে উপস্থিত সকলেই তার কথা শুনলেও এ কাজে কেউ অগ্রসর হওয়ার সাহস পায় নি। ইসহাকের কথাগুলো ইমাম বুখারীর অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি সেই দিন হতেই এই মহান দায়িত্ব পালন করবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন। তার জীবনীতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীরে মাছি বসছে। তিনি এতে কষ্ট পাচ্ছেন। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তার পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানোয়াট হাদীস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এতে রাসুল কষ্ট পাচ্ছেন । আলেমদের ব্যাখা শুনে শুধু সহীহ হাদীস সংবলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তার আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়।
সহীহ বুখারী রচনায় বুখারীর সতর্কতা
ইমাম বুখারী তার কিতাবে কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলোই বর্ণনা করেছেন। কোন হাদীসকে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য এবং তা সহীহ বুখারীতে লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি সুস্পষ্ট করে কোন শর্তের কথা উল্লেখ না করলেও আলেমগণ তার কাজের উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত শর্তগুলো বের করেছেন:
১) হাদীসের রাবী (হাদিস বর্ণনাকারী) তার উপরের রাবীর সমসাময়িক হতে হবে এবং উভয়ের মাঝে সাক্ষাত হওয়া প্রমাণিত হতে হবে। অর্থাৎ সাক্ষাৎ করা এবং হাদীসগুলো শুনা প্রমাণিত হওয়া জরুরী। এই শর্তে তিনি অন্যান্য মুহদ্দিসদের বাদ দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিমের মর্ত হচ্ছে উভয়ের মাঝে সাক্ষাৎ সম্ভব হলেই চলবে। জীবনে কমপক্ষে একবার সাক্ষাত হয়েছে বলে প্রমাণিত হওয়া এবং নির্দিষ্ট কোন হাদীস শুনা জরুরি নয়।
২) রাবী ছিকাহ মানে নির্ভরযোগ্য হতে হবে।
৩) ন্যায়পরায়ন তথা মানুষের সাথে কথা-বার্তায় ও লেনদেনে সত্যবাদী হতে হবে।
৪) রাবী পূর্ণ ম্মরণশক্তি সম্পন্ন হওয়া।
৫) হাদীছের সনদ মুত্তাসিল হওয়া। অর্থাৎ মাঝখান থেকে কোন রাবী (হাদিস বর্ণনাকারী ) বাদ না পড়া।
কোন হাদীসে কেবল উপর্যুক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলেই ইমাম বুখারী স্বীয় কিতাবে তা লিখে ফেলেন নি। বরং প্রতিটি হাদীস লেখার আগে তিনি গোসল করে দুই রাকআত নফল নামায পড়েছেন এবং ইস্তেখারা (কোন বিষয়ে দ্বিমত হলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার নামাজ) করেছেন। তার অন্তরে যদি হাদীসটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীসটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না। এইভাবে মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন।
লেখা শেষ করেই তাড়াহুড়া করে তা মানুষের জন্য প্রকাশ করেন নি; বরং কয়েকবার তিনি তাতে পুনঃদৃষ্টি প্রদান করেছেন, ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেছেন এবং পরিমার্জিত করেছেন।এভাবে এই পুনঃদৃষ্টি তিনবার করেছেন। সর্বশেষ লিখিত কপিটিই বর্তমানে মুসলিম জাতির নিকট অমূল্য রত্ম হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও বন্ধুগণের নিকট কিতাবটি পেশ করলে তাদের সকলেই তা পছন্দ করেছেন। যারা এই কিতাবটির প্রশংসা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আহমাদ বিন হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদীনী, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন এবং আরও অনেকেই। তারা সকলেই এর সকল হাদীসকে সহীহ বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।মুসলিম বিশ্ব ও আলেম সমাজ এই বুখারি শরীফকে আল-কুরআনের পরেই সম্মান করে থাকেন ।
আলেমদের মূল্যায়নে সহীহ বুখারী
সংক্ষিপ্তভাবে কিতাবটি সহীহ বুখারী হিসাবে প্রসিদ্ধতা অর্জন করলেও এর পূর্ণ নাম হচ্ছে আল জামেউস সহীহহুল মুসনাদু মিন উমরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। তবে কারও মতে দীর্ঘ নামটির মধ্যে শব্দের তারতম্য রয়েছে। এই কিতাবে তিনিই সর্বপ্রথম হাদীসসমূহকে আধুনিক পদ্ধতিতে সুবিন্যাস্ত করেন। কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় গমণ করেন।
মসজিদে নববীতে বসে একটানা ১৬ বছর কঠোর পরিশ্রম এবং ঐকান্তিক সাধনার ফলশ্র“তিতে সম্পাদিত এই গ্রন্থটি সর্বযুগের সকল আলেমের নিকট সমাদৃত হয়। বিশ্বের সকল মুসলমানদের কাছে পবিত্র আল কুরআনের পরেই সহীহ বুখারী শরীফ সর্বাধিক পবিত্র গ্রন্থ ।
এ যাবৎ সহীহ বুখারীর অসংখ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ বের হয়েছে । এই ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লামা হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী কর্তৃক রচিত ফতহুল বারী সর্বশ্রেষ্ট স্থান দখল করে আছে।