সাহিত্যের ভাষা ও রাজনীতির ভাষা।। ইসলাম বলে ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগে সংযত হতে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
ভাষা ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন, কেননা যেকোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়। তাই ভাষার আত্মসংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তবে ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায় যে ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত (বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনিভিত্তিক রূপে বা রূপে) হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা পারে না। আর কণ্ঠধ্বনির সহায়তায় মানুষ মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। কণ্ঠধ্বনি বলতে মুখগহ্বর, কণ্ঠ, নাসিকা ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনি সৃষ্টি হয় বাগ্যন্ত্রের দ্বারা।
ভাষা মূলত বাগযন্ত্রের মাধ্যমে কথিত বা “বলা” হয়, কিন্তু একে অন্য মাধ্যমে তথা লিখিত মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। এছাড়া প্রতীকী ভাষার মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে। ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল একটি ভাষিক প্রতীক এবং এর দ্বারা নির্দেশিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক।
ঠিক কথা বলা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সুরা: আহযাব, আয়াত: ৭০)। সঠিক কথার ব্যাখ্যা হলো, যে কথা চার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ—
এক. বিশুদ্ধ হওয়া। মহানবী (সা.) অত্যন্ত বিশুদ্ধভাষী ছিলেন। তাঁর বাণীই বিশুদ্ধতার জ্বলন্ত প্রমাণ।
দুই. সত্য হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা দূরে থাকো মিথ্যা কথা বলা থেকে।’ (সুরা: হজ, আয়াত: ৩০)
তিন. গাম্ভীর্যপূর্ণ হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কারণ, যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কারণ, যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’ (সুরা: হুজুরাত, আয়াত: ১১)
চার. কোমল হওয়া। মহানবী (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার কথা ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ১০)
স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা: স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় এমনভাবে কথা বলতে হবে যেন সবাই তা বুঝতে পারে। মুসা (আ.)-এর মুখে জড়তা থাকায় তিনি আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘আমার ভাই হারুন—সে আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী; অতএব তাকে আমার সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশঙ্কা করি তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে।’ (সুরা: কাসাস, আয়াত: ৩৪)
স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষা সবার জন্যই কাম্য বিষয়। প্রয়োজনে কোনো কথা তিনবার বলতে হবে। পবিত্র কোরআনে অনেক কথা তিনবার করে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কী? মহাপ্রলয় সম্পর্কে তুমি কী জানো?।’ (সুরা: আল-কারিয়া, আয়াত: ১-৩)। এ ছাড়া নবী (সা.) অনেক কথা তিনবার করে বলতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) যখন কোনো কথা বলতেন, তা তিনবার বলতেন, যেন তা বোঝা যায়। (বুখারি, হাদিস: ৯৫)
শালীনতা বজায় রাখা: সর্বদা শালীন ভাষায় কথা বলা উচিত। কাউকে ভর্ৎসনা, গালমন্দ ও অভিসম্পাতমূলক, অশ্লীল ও অশালীন কথা ইমানদারের জন্য মোটেও শোভনীয় নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি কারও প্রতি ভর্ৎসনা ও অভিসম্পাত করে না এবং অশ্লীল ও অশালীন কথা বলে না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপ আর তার সঙ্গে লড়াই করা কুফরি। (বুখারি, হাদিস: ৪৮)
অনর্থক কথা না বলা: যেসব কথার মধ্যে ইহকালীন ও পরকালীন কোনো উপকার নেই, ইমানদার ব্যক্তির তা থেকে বিরত থাকা খুবই দরকার। আল্লাহ তাআলা অনর্থক কথা বলা থেকে বেঁচে থাকাকে মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র এবং যারা অনর্থক কথা বলা থেকে বেঁচে থাকে।’ (সুরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-৩) হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির ইসলামি গুণ এবং সৌন্দর্য হলো, অহেতুক কথা ও কাজ পরিহার করা।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩১৮)
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পরিহার: কাউকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা, অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা, অবমাননাকর ও মন্দ নামে ডাকা কোনো ইমানদারের ভাষা হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। যারা তওবা করে না তারা জালিম।’ (সুরা: হুজুরাত, আয়াত: ১১)
বিতর্কিত ভাষা বর্জন: আল্লাহ তাআলা তাঁর একনিষ্ঠ বান্দার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম।’ (সুরা: ফুরকান, আয়াত: ৬৩), অর্থাৎ তারা শান্তি কামনা করে এবং তর্কে লিপ্ত হয় না।
ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগে সংযত হতে হবে। বিশুদ্ধ, স্পষ্ট ও শালীন ভাষায় কথা বলতে হবে। অশ্লীল, অনর্থক, ব্যঙ্গাত্মক, ঝগড়া ও দ্বন্দ্বমূলক ভাষা পরিহার করতে হবে। সর্বোপরি কথা বলার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহির কথা স্মরণ রাখতে হবে।
ভাষার চর্চা করতে হয় সাহিত্যের সুবাদে। সেখানে ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল। শব্দ ব্যঞ্জনা সেখানে মানব চরিত্রের কোমল ধারাকে সিক্ত করে, পল্লবিত করে, প্রস্ফুটিত করে। ঘরে বাইরে বাজারে মাঠে-ঘাটে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি তা দিয়ে সাহিত্য রচিত হয় না। সাহিত্যের ভাষার ধারা ভিন্ন।
তেমনি রাজনীতির ভাষা। রাজনীতিতে ব্যবহৃত ভাষা মূলত সংবেদনশীল এবং সংযুক্তির। দেশের আপামর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ। জাতিকে উজ্জীবিত করার স্বপ্ন এক স্বপ্ন জাগানিয়ার নান্দনিক প্রকাশ। মূলত রাজনীতির ভাষা স্বভাবতই নান্দনিক। সাংস্কৃতিক আবহে অবারিত দেশকে ভালোবাসার ভাষা। দেশকে এগিয়ে নেয়ার ভাষা, জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর ভাষা। যুবশক্তিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে জাতিগঠনে উদ্বুদ্ধ করার ভাষা। এখানে ঘৃণা বা বিদ্বেষের কোন স্থান নেই। নেই কাউকে ছোট করার কোনো চেষ্টা। রাজনীতির ভাষা হবে সংযত মার্জিত রুচিশীল। রাজনীতিবিদেরা জাতির সম্মানীয়জন। গোটা জাতি তাদের অনুকরণ করে। অনুসরণ করে, তাদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়। তাদের আহ্বানে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যের বন্ধন গড়ে সর্বোচ্চ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়।
রাজনীতিবিদদের ভাষা আচরণ বিস্তৃত হয় জনপদের সর্বত্র। আমরা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দেখেছি। দেখেছি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিম উদ্দিন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের মতো নন্দিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দেখেছি। শাহ আজিজুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুস সবুর খান নিকট অতীত। তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, অবস্থান ছিল বিপরীত মেরুতে; কিন্তু তাদেরকে কখনো অপরের প্রতি নিন্দনীয় অরুচিকর ভাষা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি।
বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে, রাজনীতি চর্চায় গণতন্ত্রের ভাষা, নীতি ও আদর্শের চর্চা বলতে গেলে আগা গোড়াই অনুপস্থিত। এজন্য যে ধরনের মন মানসিকতা ও পরিবেশ থাকা দরকার তার যথেষ্ট ঘাটতি রাজনীতির অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে। অবলীলায় জনসভায়, সংবাদ সম্মেলনে, টেলিভিশনের টকশোতে যেসব বাক্যবাণ ব্যবহার করা হয়; সেগুলো সপরিবারে দেখার বা শোনার অবস্থা প্রায়ই থাকে না। আমরা খাবি খেতে থাকি কোনটা অশালীন ভাষা কোনটা আলোচনার ভাষা কোনটা ঝগড়ার ভাষা তা বোঝার জন্য।
উঠতি প্রজন্মও কিন্তু একই রকম ভাষা (মৌখিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে দৈহিক) প্রয়োগে অভ্যস্ত হচ্ছে। যার প্রতিফলন প্রায়শই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে আমরা দেখতে পাই। অবস্থা দেখে মনে হয় গণতন্ত্রের ভাষা এখন প্রতিস্থাপিত হচ্ছে ঝগড়ার ভাষা দিয়ে, বিভাজনের ভাষা দিয়ে, ঘৃণার ভাষা দিয়ে। যারা এসব ভাষা অবলীলায় ব্যবহার করেন সম্ভবত তারা উপলব্ধি করেন না বিভাজনের ভাষা দিয়ে দেশ গড়া যায় না, দেশপ্রেম জাগ্রত হয় না, সর্বোপরি স্মার্ট জাতি সৃষ্টির স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
রাজনীতিবিদরা নির্মোহ হবেন। তারা জনগণের কথা বলবেন। তাদের নিজস্ব দলীয় আঙ্গিকে। কিন্তু সেখানে মুখ্য বিষয় হচ্ছে জাতি ও দেশ। প্রায়শই দেখা যায় তাদের পাশে যারা থাকেন, যারা তোষামোদের তেল দিয়ে সারাক্ষণ তাদের সিক্ত রাখেন বা রাখার চেষ্টা করেন, তাদের ব্যবহৃত ভাষাশৈলী আরো কদর্য। তারা তোষামোদ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব ভাষা ব্যবহার করেন শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। এতে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। মোদ্দাকথা হলো নেতা বা তার পরিষদ সবাইকেই ভাষার ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার যেন তারা অনুকরণীয় হয়ে থাকতে পারেন; আদর্শ (ওফড়ষ) হিসেবে চিত্রিত হন। মনে রাখা দরকার অপরকে সম্মান করলে নিজেকেই সম্মান করা হয়।
একটা কথা না বললেই নয়। গণতন্ত্রে আলাদিনের চেরাগের মতো রাতারাতি সবকিছু বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভব স্বপ্ন দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জাতিকে সত্য এবং বাস্তবভিত্তিক স্বপ্ন দেখানো দরকার। নইলে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে বিদায় নিতে হবে। অবাস্তব স্বপ্ন দেখানোর ব্যর্থতার দায় সব সময়ই রাজনীতিবিদদের বহন করতে হয়। আশপাশের সুযোগসন্ধানী তোষামোদকারীদের কিছুই হয় না। কলঙ্কের ছাপ নিয়ে অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হয় রাজনীতিবিদদের। গণতন্ত্রের শিক্ষাই হলো গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুসরণ করা বিভাজনের ঘৃণার ভাষাকে গণতন্ত্রের পরিভাষায় রূপান্তরের মাধ্যমে।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া,অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম ‘রাজনীতির ভাষা’