সূর্যদয়ের সময় আলো-ছায়ার খেলা
সূর্য (রবি নামে ডাকা হয়) সৌরজগতের কেন্দ্রের খুব কাছে অবস্থিত তারাটির নাম। প্রায় আদর্শ গোলক আকৃতির এই তারা প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত যার মধ্যে জড়িয়ে আছে চৌম্বক ক্ষেত্র।এর ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ, ভর প্রায় ২×১০৩০ কিলোগ্রাম তথা পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গুণ। এই ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ।
সূর্যোদয় হল সেই মুহূর্ত যখন সূর্যের উপরের রিম সকালে দিগন্তে উপস্থিত হয়। শব্দটি সৌর ডিস্কের দিগন্ত অতিক্রম করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এবং এর সাথে থাকা বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাবকেও উল্লেখ করতে পারে।
যদিও সূর্যকে দিগন্ত থেকে “উত্থান” বলে মনে হয়, এটি আসলে পৃথিবীর গতি যা সূর্যের আবির্ভাব ঘটায়।
জ্যোতির্বিদ্যাগতভাবে, সূর্যোদয় শুধুমাত্র তাত্ক্ষণিক ঘটে: যে মুহুর্তে সূর্যের উপরের অঙ্গটি দিগন্ত স্পর্শ করে। যাইহোক, সূর্যোদয় শব্দটি সাধারণত এই বিন্দুর আগে এবং পরে উভয় সময়কালকে বোঝায়:
- গোধূলি, সকালের সময়কাল যার সময় আকাশ উজ্জ্বল হয়, তবে সূর্য তখনও দেখা যায় না। সকালের গোধূলির শুরুকে বলা হয় জ্যোতির্বিদ্যাগত ভোর ।
- সূর্য উদিত হওয়ার পরের সময়কাল যেখানে আকর্ষণীয় রং এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাব বিদ্যমান থাকে।
সূর্যদয়ের সময় আলো-ছায়ার খেলা ও নানা রঙের আভায় চারদিক রঙিন হয়ে হাতছানি দেয় পর্যটকদের ।সূর্যের এমন রূপে মাতোয়ারা হতে অনেক পর্যটক ছুটে যায় দেশ থেকে বিদেশে
বাংলাদেশের কুয়াকাটা
কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার একটি শহর ও পর্যটনকেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এখানে আছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যা পর্যটকদের কাছে “সাগরকন্যা” হিসেবে পরিচিত। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকত বিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়।ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শুধু সূর্যোদয় নয়, কুয়াকাটা এমনই একটি সৈকত যেখানে সূর্যাস্তও দেখা যায়। পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই দু’টো দৃশ্যের দেখা মেলে। বাংলাদেশের সেই স্থানটি হলো কুয়াকাটা (Kuakata)। যা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সৈকত (Sea beach) যেখান থেকে সূর্যোদয় (Sunrise) ও সূর্যাস্ত (Sunset) দুটোই দেখা যায়।
সূর্যোদয়ের পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে মূল সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে, গঙ্গামতির চর পেরিয়ে কাউয়ার চর। সেখান থেকেই দেখা মিলবে সূর্যোদয়।
মাউন্ট ব্রোমো, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে আইকনিক পাহাড় এবং বিশ্ববিখ্যাত আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে অন্যতম মাউন্ট ব্রোমো। এটির উচ্চতা পূর্ব জাভার চেয়ে ৭ হাজার ৬৪১ ফুট উঁচু।
চূড়াহীন এই পাহাড়ের ভেতর থেকে সাদা সালফারের ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। মাউন্ট ব্রোমোর পার্শ্ববর্তী পাহাড় মাউন্ট পেনানজাকানে দুই ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে প্রিমিয়ার ভ্যান্টেজ পয়েন্টে পৌঁছানোর পর দেখা মেলে সূর্যোদয়ের চমৎকার দৃশ্য।
এটিকে সূর্যোদয় দেখার জন্য বিশ্বের সর্বোত্তম স্থানগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে ধরা হয়।
মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো, তানজানিয়া
মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো পর্বতারোহীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি ১৯ হাজার ৩৪১ ফুট উঁচু। অন্যান্য পাহাড়ের চেয়ে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর চূড়া জয়ের অভিজ্ঞতা খানিকটা ভিন্ন।
এটির চূড়ায় পৌঁছানোর পর অতি আশ্চর্যকর সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে এখানে যখন সূর্যোদয় হয় হলুদ, কমলা, বেগুনি এবং নীল রঙের আভা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় দিক-দিগন্তে।
অ্যাঙ্কোর ওয়াট, কম্বোডিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ, কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীক এবং খেমার সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে খ্যাত অ্যাঙ্কোর ওয়াট মন্দির কমপ্লেক্স। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় অনেক পর্যটক এখানে ভিড় করে।
ডুবন্ত কুসুম দেখতে যেমন হয় এখানে সূর্যের রূপও ঠিক তেমনভাবেই ধরা দেয়। শুধু তাই নয়, সূর্যের আলো যখন স্মৃতিস্তম্ভের খোদাইকৃত পাথরের ওপর পড়ে তখন সেগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বহু মানুষ এখানে আসে এমন মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। সন্ধ্যেবেলার চেয়ে সূর্যোদয়ের সময় পর্যটকদের ভিড় কম থাকে।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, অ্যারিজোনা
অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে গেলে দেখা যায় সূর্যের আরেক রূপের ঘনঘটা। সূর্য উদয়কালে আলো যখন পাথরের ওপর পড়ে ব্রোঞ্জ, বেগুনি, কমলা এবং লাল রঙের আভা ছড়ায় তখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এক মাস্টারপিসে রূপান্তরিত হয়।
দক্ষিণ দিকের রিম থেকে ম্যাথার পয়েন্টের দিকে তাকালে দেখা যায় সূর্যের বিকিরণ প্রতিটি ফাটলে ছড়িয়ে পড়ার পর পরই উপত্যকা সোনালি আভায় সেজে ওঠে।
সিনাই পর্বত, মিশর
ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্য মিশরের সিনাই পর্বত বিখ্যাত স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানেই নবী মুসা (আ.) দশটি আদেশ পেয়েছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই স্থানটি পরিদর্শনের জন্য অনেক দর্শনার্থী আসে।
মিশরীয় সিনাই পর্বতের রুক্ষ পাহাড়ের আড়াল থেকে যখন সূর্য উঁকি দেয় তখন অদ্ভুত এক অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। ভিন্ন রকমের সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য এককথায় মিশর অনন্য।
স্বালবার্ড, নরওয়ে
নর্দার্ন লাইটস এবং সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে নরওয়ে ব্যাপক পরিচিত। এখানে নর্ডিক জাতির উইন্টার সান ইভেন্টের দেখা পাওয়া যায় মে এবং আগস্টের মাঝামাঝিতে। এ দেশে এলে সূর্যকে সবসময় আকাশে ভাসমান অবস্থায় দেখা যায়।
এখানকার আকাশে লাল, হলুদের মেলা বসেছে বলে মনে হয়। ইথারিয়াল আলোতে দেশটির হিমবাহ ল্যান্ডস্কেপ তখন আলো-ছায়ার খেলায় মেতে ওঠে।
মাচু পিচু, পেরু
ইনকা সভ্যতা পেরুর প্রাচীন স্থাপত্যের একটি বিস্ময়কর উদাহরণ। এটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি ২০০৭ সালে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মুকুট লাভ করে।
এ ছাড়া পেরুর মাচু পিচুর কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যোদয়ও কিন্তু বেশ বিখ্যাত। তাই দিনের শুরুতে সূর্যের আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে ইন্টিপুঙ্কু সান গেইটে বহু মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
কেপ টাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় উপভোগ করা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে। গ্রীষ্মের উষ্ণ আবহাওয়া শহরে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটক এবং স্থানীয়রা তাদের প্রিয় পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে চমৎকার সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে আটলান্টিকের তীরে। অন্তহীন সমুদ্রে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠা ডলফিন, তিমিও তখন তাদের মহা আনন্দে অভিবাদন জানায়।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হলো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক। কলোরাডো নদীর ভূতাত্ত্বিক রঙ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত গাঠনিক কাঠামোয় সেজে উঠেছে এখানকার গিরিখাত। সূর্যোদয়ের আলো যখন পাথর এবং গিরিখাতের ওপর পড়ে তখন ঝলমলে আলো-ছায়ার নৃত্যে গিরিখাতের দেয়াল কমলা, মরিচা এবং লাল বর্ণ ধারণ করে।
সান্তোরিনি, গ্রীস
কালো বর্ণের বিশালাকার পাহাড়, কালিমাখা জল এবং সাদা ধোঁয়ার মিশ্রণে গ্রীসের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপে পরিণত হয়েছে সান্তোরিনি। ঝলমলে এজিয়ান জলের ব্যাকগ্রাউন্ডে তৈরি নীল গম্বুজ এবং সাদা ঘরবাড়ি এবং আগ্নেয়গিরির পাহাড়ের উপর অবস্থিত গির্জাগুলোর প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। বলা হয়, সান্তোরিনির মরিচা-লাল ক্লিফের উপরে নির্মিত রোমান্টিক গ্রাম ওইয়া সূর্যোদয় দেখার জন্য সেরা জায়গা।
হালেকালা ন্যাশনাল পার্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ান দ্বীপের মাউইতে অবস্থিত হালেকালা ন্যাশনাল পার্ক। ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় আগ্নেয়গিরির শিখর, বিশাল আকাশ এবং বিস্তৃত সমুদ্রের দৃশ্য মনকে শান্ত করে দেয় নিমিষেই। ছায়া ও রঙের খেলায় আগ্নেয়গিরির উপর সূর্যোদয় তখন বাড়তি মাত্রা যোগ করে।
নামিব-নাউক্লুফ্ট ন্যাশনাল পার্ক, নামিবিয়া
প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং বন্যপ্রাণী দেখার জন্য নামিবিয়া অতুলনীয়। নামিব-নউক্লুফ্ট-এর কালো গাছের দেহাবশেষ এবং লাল রঙের টিলার মাঝে যখন সূর্যোদয় হয়, চারপাশের নির্জনতায় তখন প্রাণের সঞ্চার হয়। নিরিবিলি এ দৃশ্য দেখার জন্য পর্যটকদের উৎসাহের শেষ নেই।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া,অরিজিনাল ট্রাভেল, দ্য ট্রাভেল, মোমোনডো, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা