অভিনেতা জাফর ইকবাল
বাংলা চলচ্চিত্রের স্টাইলিশ নায়কদের অন্যতম জাফর ইকবাল । তিনি চিরসবুজ নায়ক হিসেবে পরিচিত। শহুরে রোমান্টিক ও রাগী তরুণের ভূমিকায় দারুণ মানালেও সব ধরনের চরিত্রে ছিল তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। অভিনয়ের পাশাপাশি চমৎকার গান গাইতে পারা এ অভিনেতা বেশকিছু ছবিতে গায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
এ প্রজন্মের অনেকেই হয় তো চেনেন না চিত্রনায়ক জাফর ইকবালকে। একই সঙ্গে গায়ক ও নায়ক ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার ভিড়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার ডাক শুনে অস্ত্র হাতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। জীবন তার অনেক সংগ্রামের রঙে রঙিন।
১৯৮৪ সালে আনোয়ার পারভেজের সুরে রাজ্জাক অভিনীত বদনাম ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। মূলত তিনি ছিলেন গিটারবাদক। ভালো গিটার বাজাতেন বলে সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে অনেক ছবির আবহসংগীত তৈরি করিয়েছেন।
তার সেই ছবিগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে জাফর ইকবাল চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। তার অভিনীত প্রথম ছবির নাম আপন পর। এই ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন কবরী। জাফর ইকবালের সাথে অভিনেত্রী ববিতা জুটি হয়ে প্রায় ৩০টির মত ছবি করেন। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় ১৫০টি ছবি করেন।
জাফর ইকবাল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
জাফর ইকবাল ছিলেন একজন অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী।তিনি আশির দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
চলচ্চিত্রে জাফর ইকবাল
প্রায় ৩০টি সিনেমায় জুটি হয়ে কাজ করেছেন জাফর ইকবাল ও ববিতা। দুজনের মধ্যে ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন জাফর ইকবাল। ‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়াল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে ‘মাস্তান’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ। সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তানে’র নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীণ তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে।
জাফর ইকবাল ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতার বিপরীতে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। ববিতার বিপরীতে ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। জাফর ইকবাল অভিনীত ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র সুপারহিট হয়।
সামাজিক প্রেমকাহিনি ‘মাস্তান’ ছবিতে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ ছবির এক গ্রামীণ যুবকের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করেছিলেন।
আমরা প্রায় ৩০টি সিনেমায় জুটিবদ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে সে সময়ে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। এমন গুঞ্জনের সময়েই মুক্তি পায় ‘অবুঝ হৃদয়’। বাংলা চলচ্চিত্র তাকে মনে রাখবে অনন্তকাল।”
সংগীতে জাফর ইকবাল
জাফর ইকবাল ১৯৬৬ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড গ্রুপ ‘র্যাম্বলিং স্টোন’ এবং তার সিনেমায় প্রথম প্লে-ব্যাক করা গান ছিল তার ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে প্রথম গান করেন ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও/আমি তো এখন আর নই কারও’। জাফর ইকবাল এর কণ্ঠে “হয় যদি বদনাম হোক আরো ” গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় প্রথম প্লেব্যাকেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই অভিনেতা। এরপর সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাঁকে দিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করিয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ অন্যতম।
নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানটি গেয়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিলেন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদ্যাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি।
জাফর ইকবালের জন্ম ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫০- মৃত্যু ৮ জানুয়ারি ১৯৯২
পারিবারিক অশান্তির কারণে জাফর ইকবাল মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। পরবর্তীকালে মদ্য পানসহ অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের ফলে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তার হার্ট এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।