পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে মেহেরপুর
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের অব্যবহতি পর থেকে ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচন ভিত্তিক ব্যাপক গণজাগরণের কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে মেহেরপুর জেলার অধিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ মেহেরপুরের ইতিহাসকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে। জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রভূমি তথা রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দুরের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল হলেও এই অঞ্চলের সচেতন জনতা বিশেষকরে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের আন্তরিক ও নিরলস কর্মকাণ্ডের ফলে তৎকালীন জাতীয় আন্দোলন ও কর্মসূচীসমুহে আপামর জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তবে যথাযোগ্য সংরক্ষণের অভাবে এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের একটি বিরাট অংশ বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সূত্র ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর গুলি বর্ষণ ও রফিক, সফিউর, বরকত, সালাম সহ আরো অনেক ছাত্র-জনতার শাহাদৎ বরণের ঘটনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেহেরপুরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৪শে ফেব্রুয়ারী মেহেরপুরের তৎকালীন ছাত্র নেতা-কর্মী মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন, কাউছার আলী চানা, শান্তি, বংকা ঘোষ, নারায়ণ চক্রবর্তী, সতীনাথ ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। তাদের নেতৃত্বে তীব্র পিকেটিং-এর মাধ্যমে ঐ দিন মেহেরপুরে সাধারণ ধর্মঘটও পালিত হয়। ১৯৫৪ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালনের দায়ে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রকে স্কুল থেকে Rusticate করা হয়। পরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হলে মেহেরপুরের জনতা তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেন। এই নির্বাচনে মেহেরপুরের জনগণের ভোটে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী মৌলবী আব্দুল হান্নান আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে মেহেরপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে মেহেরপুরের রাজনীতি নবধারা সূচিত হয়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করলে মেহেরপুরের ছাত্র-জনতা তার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানায়। ৬ দফা দাবীকে সামনে নিয়ে মেহেরপুরে ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। এই সময় মেহেরপুর থেকে মুসলিম লীগ প্রায় বিলুপ্ত হতে থাকে।
১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনে মেহেরপুরে জোয়ার সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার বিশাল বিশাল মিছিল সভা সমাবেশে মেহেরপুর মহকুমার সদর ও গাংনী থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল কাঁপিয়ে তুলেছিল। আন্দোলন চলার এক পর্যায়ে মেহেরপুর শহরে ছাত্র-জনতার একটি মিছিলের প্রতি আনছার বাহিনীর এক সদস্য অশ্লীল মন্তব্য করলে ছাত্র-জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে, এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করলে ছাত্র নেতা আবু বক্কর মিয়া, নজরুল ইসলাম ও একরামুল হক কালু গ্রেফতার হন। ছাত্র নেতা শহীদুল্লাহ, নাসিরুদ্দিন, ওমরুল হুদা ও আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। আব্দুস সামাদ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠান হয়। একই ঘটনায় ন্যাপের সভাপতি আহমদ আলী এবং অ্যাডভোকেট আসগর আলীকেও গ্রেফতার করা হয়। একুশ দিন কারাভোগের পর ১৯৬৯ সালের ২৪শে মার্চ আইয়ুব খানের পদত্যাগের পরপরই তারা মুক্তি লাভ করেন। আবু বক্কর মিয়া, নজরুল ইসলাম ও একরামুল হক কালুকে সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এক বছর কারাভোগের পর তারা মুক্তি লাভ করলে মেহেরপুরের জনতা তাদের প্রিয় নেতাদের বিপূর সংবর্ধনা দিয়ে সম্মান জানায়।
ঊনষত্তরের গণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে মেহেরপুরে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ আসনে মোট প্রার্থী ছিলেন চারজন, আওয়ামী লীগের,মোঃ সহিউদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট খালেদুজ্জামান, ন্যাপ(ভাসানী)র অ্যাডভোকেট আসগর আলী এবং জামায়াতে ইসলামীর অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, আওয়ামী লীগের নুরুল হক, ন্যাপ(ভাসানী)র আহমদ আলী এবং জামায়াতে ইসলামীর শামসুদ্দিন। মহকুমার দুই থানার প্রতিটি গ্রামে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও নৌকা মার্কার প্রতি এক অভূতপূর্ব ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের আসনে সহিউদ্দিন এবং প্রাদেশিক পরিষদের আসনে নুরুল হক নির্বাচিত হন।