স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ইতিহাসে’২০২৪ জুলাই মাসের ঘটনা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ
ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন
চলতি মাসে বাংলাদেশে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামার জেরে এর সূত্রপাত হয়। তারা পুলিশ এবং ক্ষমতাসিন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং রাজধানী ঢাকার রাস্তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। তারা রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) -তেও হামলা করে, যখন সহিংসতা দেশের ৬৪টি জেলায় প্রায় অর্ধেক জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। জবাবে সরকার সশস্ত্র সৈন্য পাঠায় এবং ২০ জুলাই থেকে দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশের পাশাপাশি দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে।
২৩শে জুলাই আংশিক পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবাগুলোও বন্ধ করে দেয় সরকার । বিশ্ব থেকে দেশের ১৭১ মিলিয়ন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ততক্ষণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপগুলো ঢাকার বিক্ষোভকে অনেকটাই শান্ত করে এনেছে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য সাধারণ মানুষকে বাইরে বেরোনোর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছিল প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য। তবুও গত কয়েকদিনে প্রায় ২০০ জন বিক্ষোভকারী এবং তাদের সমর্থনকারী নিহত হয়েছে (সম্ভবত আরও বেশি) এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে, হিসাবটা হয়তো এমন যা সামনে আনার মানসিকতা শেখ হাসিনার নেই।
১৫ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনের মধ্যে এটি তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সাম্প্রতিক দিনের সহিংসতার জন্য কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে ৬১,০০০ জনকে অভিযুক্ত করেছে, যার মধ্যে অনেকেই বিরোধী দলের। যাদের শেখ হাসিনা সর্বদা দেশে যা কিছু ঘটে তার জন্য দায়ী করে এসেছেন। এমনকি আন্দোলনের উপর এই ক্র্যাকডাউন অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেললেও, প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত ‘অপরাধীদের’ বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিশোধের আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্কটের মধ্যে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং আপসহীন প্রতিক্রিয়া জনগণের মধ্যে ভুল ধারণার জন্ম দেয়।
ক্ষমতার উপর তার দখল নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করে ।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগটি প্রথম সামনে আসে জুন মাসে, যখন হাইকোর্ট ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির ৩০% আলাদা করে রেখে দীর্ঘদিনের কোটা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
একবার বিবেচনা করুন যে, ক্ষমতাসিন দল আওয়ামী লীগের (আ.লীগ) শিকড় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে প্রোথিত এবং শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ( যিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যার আগ পর্যন্ত নতুন দেশের নেতা ছিলেন) কন্যা হওয়ার জন্য অনেক কিছুই করেছেন।
এর অর্থ হলো কোটা আওয়ামী লীগের সদস্যদের সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়েছিল । যেখানে দুই-পঞ্চমাংশ তরুণ বাংলাদেশিদের নিয়মিত কর্মসংস্থান নেই, সেখানে এই কোটা ব্যবস্থা তাদের স্নায়ুতে আঘাত করে। প্রায় ৪ লাখ স্নাতকদের ইতিমধ্যেই একটি অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের বাজারে মাত্র ৩০০০ সরকারি চাকরির জন্য প্রতি বছর প্রতিযোগিতা করতে হয়। অন্ততপক্ষে সরকার একটা ভালো কাজ করেছিল যে, তাড়াহুড়ো করে দেশের শীর্ষ আদালতকে নিম্ন আদালতের রায়কে বাতিল করতে বলা। ২১শে জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটা কমিয়ে ৫% করেছে। তবে কোটা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অনেক বেশি। একজন শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশির জন্য প্রায় প্রতিটি চাকরির সুযোগ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য থেকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পর্যন্ত, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে চলে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তার কর্তৃত্বকে গভীরভাবে বিস্তৃত করেছে এবং ১৭ কোটি মানুষের এই দেশকে বিভক্ত করেছে। সরকার তার অনুগতদের পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনপীড়ন, সীমাহীন আইনি জটলা এবং কারাবাসের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সরকারের রক্তাক্ত ক্র্যাকডাউনে কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছে।
পত্রিকাটি বলছে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ কোটার বিরোধিতায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল। তবে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারি দলের সহিংস প্রতিক্রিয়া দেশকে নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
কূটনীতিকরা এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে মারাত্মক রাজনৈতিক সহিংসতার পর্যাপ্ত ইতিহাস থাকলেও এমন নৃশংসতা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশটিতে নজিরবিহীন। অনেক বাংলাদেশির কাছে, এখানে সীমারেখা অতিক্রম করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি শিগগির কমবে বলে মনে হচ্ছে না।
কূটনীতিক এবং কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫০ জন নিহতের সংখ্যা একটি রক্ষণশীল হিসেবে। স্থানীয় সংবাদপত্র বলছে, মৃত্যুর সংখ্যা ২০০-এর কাছাকাছি। আন্দোলনের নেতারা বলছেন, নিহতের সংখ্যা সম্ভবত তার কয়েক গুণ।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ছাত্রনেতারা অভিযোগ করেছেন, বিক্ষোভের ওপর সহিংস পুলিশি দমনপীড়নের সময় তাদের অপহরণ এবং নির্যাতন করা হয়।
ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের অভিযোগ, গত শনিবার রাত ৩টায় পুলিশ পরিচয় দেওয়া ২০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা তাঁকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে তুলে নেয়। এর পর তাঁর ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। রড দিয়ে তাঁর জয়েন্ট, কাঁধে এবং বিশেষ করে বাঁ পায়ে মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে রাজধানী ঢাকার রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়।
ভারতের গণমাধ্যমে টানা কয়েক দিন গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন
ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে শেষ কবে বাংলাদেশ এভাবে জায়গা দখল করেছিল জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোই–বা কবে এভাবে সরগরম হয়েছে, সেটাও গবেষণার বিষয়। স্মরণাতীতকালের মধ্যে সম্ভবত এই প্রথম সর্বভারতীয় প্রচারমাধ্যমে টানা ১০ দিন ধরে বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনের খবর জ্বলজ্বল করছে।
এভাবে খবরে থাকা যদিও বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। অনাবশ্যক ধ্বংস, আত্মঘাতী সংঘর্ষ, পারস্পরিক সন্দেহ ও বিশ্বাসহীনতা নিয়ে খবর হওয়া কোনো দেশের কাম্য হতে পারে না। কাম্য নয় ভারতের কাছেও।
তবু বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও সম্পর্কের স্পর্শকাতরতার বিচারে দীর্ঘতম সীমান্ত থাকা পরমবন্ধু ও প্রতিবেশী এই দেশের সাম্প্রতিকতম চ্যালেঞ্জের বিষয়ে ভারত অতি সতর্ক। তাই বাংলাদেশে যা ঘটে চলেছে, তা ‘সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলা ছাড়া ভারতের দিক থেকে অন্য মন্তব্য করা হয়নি। বাড়তি বক্তব্য, ভারতের আশা—পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে।
ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় বা ত্রিপুরার গণমাধ্যমে বাংলাদেশের খবর যতটুকু দেখা যায়, তার ছিটেফোঁটা গুরুত্বও পায় না সর্বভারতীয় গণমাধ্যমে। চীন ও পাকিস্তান নিয়ে সর্বভারতীয় গণমাধ্যমের আগ্রহ চিরকালীন। এ দুই দেশকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলাদেশ নিয়ে তার কিঞ্চিৎও দেখা যায় না। যদিও এবার দেখা গেল হিংসার ভয়াবহতা, ধ্বংসের ব্যাপ্তি ও মৃত্যুর বহরের দরুন। সর্বভারতীয় গণমাধ্যম থেকে এখনো সেই রেশ মুছে যায়নি।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় গণমাধ্যম বাদ দিলে কোটা আন্দোলন নিয়ে সর্বভারতীয় গণমাধ্যম ১৬ জুলাই পর্যন্ত নীরব ছিল। তত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে যতটুকু আগ্রহ ছিল, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে কেন্দ্র করে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় গণমাধ্যম বাদ দিলে কোটা আন্দোলন নিয়ে সর্বভারতীয় গণমাধ্যম ১৬ জুলাই পর্যন্ত নীরব ছিল। তত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে যতটুকু আগ্রহ ছিল, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে কেন্দ্র করে। এর নেপথ্যে ছিল হাসিনার ভারত সফর ও তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন বোঝাপড়া, যেদিকে চীনও নজর রেখেছিল।
চীন সফর নিয়ে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের দিকে ভারতের নজর বেশি নিবদ্ধ ছিল। সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য ঘিরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, তা ছিল কল্পনার অতীত।
তারপর ১৭ জুলাই সব প্রভাতি সংবাদপত্রে সেটাই হলো খবর। বাংলা তো বটেই, সর্বভারতীয় ইংরেজি ও হিন্দি গণমাধ্যমেও ছাপা হলো ছয়জনের মৃত্যু, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সহিংস হয়ে ওঠার খবর। আনন্দবাজারের শিরোনাম হলো, ‘আটক মৈত্রী (এক্সপ্রেস), ছাত্র সংঘর্ষে বাংলাদেশজুড়ে নিহত ৬’। সঙ্গে রয়টার্সের পাঠানো ঢাকার রাস্তায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ছবি। একই খবর ছাপা হলো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ অন্যান্য গণমাধ্যমেও।
পরের দিন পুলিশের গুলির সামনে আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি ভারতীয় গণমাধ্যমেও ভাইরাল হয়ে যায়। বার্তা সংস্থা এপি, রয়টার্সের পাঠানো ছবি, তাদের ও পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে কোটা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন মানুষ ও বিশ্লেষকের মতামত ছাপা হতে থাকে।
১৭ জুলাই সব প্রভাতি সংবাদপত্রে সেটাই হলো খবর। বাংলা তো বটেই, সর্বভারতীয় ইংরেজি ও হিন্দি গণমাধ্যমেও ছাপা হলো ছয়জনের মৃত্যু, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সহিংস হয়ে ওঠার খবর। আনন্দবাজারের হেডিং হলো, ‘আটক মৈত্রী (এক্সপ্রেস), ছাত্র সংঘর্ষে বাংলাদেশজুড়ে নিহত ৬’।
১৮ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাইটার্স অ্যাট দ্য রিসিভিং এন্ড অব কোটা ব্যাকল্যাশ’। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে তিন কলাম শিরোনাম, ‘ভায়োলেন্স ওভার গভর্নমেন্ট জব কোটা: বাংলাদেশ আর্জেস অল ইউনিভার্সিটিজ টু ক্লোজ’। প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয় এপির পাঠানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জমায়েতের ছবি। নিহত ব্যক্তিদের ছয়টি কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতীকী জানাজার ছবি।
১৯ জুলাই থেকে পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলোয় বাংলাদেশ চলে আসে প্রথম পৃষ্ঠায়। সর্বভারতীয় দৈনিকে বের হতে থাকে একাধিক স্টোরি। টানা পাঁচ দিন সেই অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে। ১৯ জুলাই আনন্দবাজারের লিড, পাঁচ কলামজুড়ে শিরোনাম, ‘ছাত্র–পুলিশ সংঘর্ষ তুঙ্গে, আলোচনার প্রস্তাব খারিজ, বন্ধ ইন্টারনেট’। মূল শিরোনাম ‘বাংলাদেশে হত ৩২’। পঞ্চম কলামে ঢাকার মর্গে নিহত ছেলেকে দেখে মায়ের আহাজারির হিউম্যান স্টোরির হেডিং, ‘চাকরি না হয় না দিবি, কিন্তু ছেলেটাকে মারলি কেন?’
সেদিনই আনন্দবাজারের সম্পাকদীয় শিরোনাম ‘ক্ষোভাগ্নি’। তাতে লেখা হয়, ‘…মতবৈষম্য যত দূরই হোক না কেন, উভয় পক্ষই যদি হিংসার আশ্রয় নেয় এবং সেই হিংসা যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের দুর্দশার আর শেষ থাকে না।…সুতরাং জনকল্যাণের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনেই ফিরে যেতে হবে। এবং প্রশাসনের তরফেও অহিংস পথেই সেই জন–আন্দোলনের মোকাবিলা করতে হবে।’ সম্পাদকীয়তে এ কথাও লেখা হয়, ‘…ক্রোধের বিস্ফোরণ এতটা লাগামছাড়া হয়ে গেল কোন নেতৃত্বের উসকানিতে, তা অবশ্যই জানা জরুরি।’
সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে অনেকে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারতের “মণ্ডল কমিশনবিরোধী আন্দোলন”–এর মিল খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু সেই আন্দোলনকে ভাঙার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তৎকালীন শাসক দল পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় যায়নি। এ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে দিতে ছাত্রলীগকে রাস্তায় নামানো আওয়ামী লীগের পক্ষে কার্যত বুমেরাং হয়ে গিয়েছে।’
১৯ জুলাই হিন্দুস্তান টাইমসের বিদেশ পৃষ্ঠার এক–চতুর্থাংশ জুড়ে বাংলাদেশ। ছবি, লেখা ও গ্রাফিকসে। শিরোনাম, ‘স্টেট টিভি হেডকোয়ার্টার্স সেট অন ফায়ার অ্যাজ ডেথ টোল রাইজেস টু ৩২’। গ্রাফিকসে ছাত্ররা কেন বিক্ষোভের পথে।
পরের দিন ২০ জুলাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ‘এক্সপ্লেন্ড’ সেকশনের অর্ধেকজুড়ে কোটা বিশ্লেষণ। বাংলাদেশে কোটার ইতিহাস, আদালতের নির্দেশ, সংবিধানের বৈধতা ও কোটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, দেশের অর্থনীতির হাল ও বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন। নিবন্ধের একেবারে শেষে ‘রাজাকার’ বৃত্তান্ত। কোনো রকম অভিমতের মধ্যে না গিয়ে কোটা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত তারা তুলে ধরে।
২০, ২১ ও ২২ জুলাই দেশের সব ভাষাভাষী কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা বাংলাদেশের দখলে ছিল। নিহত মানুষের সংখ্যা ৩২ থেকে বেড়ে ৭৫, তারপর ১২৩ হয়ে যাওয়া, সেনা নামানো, কারফিউ, দেখামাত্র গুলির নির্দেশের খবরের পাশাপাশি ভারতীয় শিক্ষার্থী ও অন্যদের উদ্ধারের কাহিনি সর্বত্র। বাংলা কাগজে সেই সঙ্গে ছাপা হতে থাকে প্রাণ হাতে পালিয়ে আসা ও উদ্ধার পাওয়া মানুষের রোমহর্ষ কাহিনি।
হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হতে থাকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষের ছবি, সেনা টহল, আটকে পড়া ভারতীয়দের জন্য সরকারি উদ্বেগ ও উদ্ধারের খবর।
এই এত দিন ধরে ভারত সরকারের তরফ থেকে একটিও মন্তব্য করা হয়নি। একবারের জন্যও মৃত্যুহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি। ভারত যে চিন্তিত, সেটুকু পর্যন্ত বলা হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে উঠে আসে একাধিক প্রশ্ন। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়ালের একটিই জবাব, বাংলাদেশে যা চলছে, তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
স্পষ্টতই বোঝা যায়, নানা কারণে ভারত অতিরিক্ত সতর্ক। দুই দেশের ‘সোনালি সম্পর্ক’ সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতার বহর, ব্যাপ্তি ও প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে ভারতবিরোধী স্লোগান ওঠা নিয়ে ভারত বিব্রত। অতি সতর্কতার কারণও তা–ই।
২০, ২১ ও ২২ জুলাই দেশের সব ভাষাভাষী কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা বাংলাদেশের দখলে ছিল। নিহত মানুষের সংখ্যা ৩২ থেকে বেড়ে ৭৫, তারপর ১২৩ হয়ে যাওয়া, সেনা নামানো, কারফিউ, দেখামাত্র গুলির নির্দেশের খবরের পাশাপাশি ভারতীয়দের পড়ুয়া ও অন্যদের উদ্ধারের কাহিনি সর্বত্র।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে সুপ্রিম কোর্ট কোটার পরিমাণ ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত জানানোর সময় থেকে। ২২ জুলাই সেই খবর স্থান পায় সব কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়। সেদিনই দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কে ভরদ্বাজ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে উপসম্পাকদীয় নিবন্ধে কোটা ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে লেখেন, ‘হাসিনা সরকার মনে করে তাদের উচ্ছেদ করাই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। কিন্তু এটাও ঠিক, বেকারত্ব সে দেশে উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে রাজনৈতিক মতপার্থক্য প্রকাশের জন্য সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণ দেশের স্থিতিশীলতাকেই নষ্ট করবে। হাসিনার উপর্যুপরি চতুর্থ জয় বাংলাদেশকে তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক নিরাপত্তা জুগিয়েছে এবং এর ফলে অর্থনৈতিক সুরাহাও পাওয়া গেছে। ২০২৬ সালে তারা মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছে। এই সন্ধিক্ষণে বেকারত্বের সমস্যা সতর্কভাবে মেটানো দরকার। সংস্কারের রাস্তায় হাঁটতে গেলে দেশকে বৃহত্তর সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্র: মানবজমিন, সমকাল, প্রথমআলো