বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাসে মেহেরপুর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মাহেন্দ্রক্ষণের ধারক মেহেরপুরের মাটি।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেহেরপুরের নাম আজ স্বর্ণাক্ষরে লেখা । তৎকালীন পূর্ব বাংলার এক প্রান্তে অবস্থিত মহকুমার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বৈদ্যনাথতলা ইতিহাসের এক মহান ঘটনার জন্মলগ্নের ধাত্রী মর্যাদা লাভ করেছে।ইতিহাসের কী মহান খেয়ালিপনা, ২১৪ বছর আগে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দুরের পলাশীর আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল তারই যেন মহিমান্বিত অভ্যুদয় ঘটল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আরেক আম্রকাননে।
সারা দেশের মানুষের মত মেহেরপুরের মানুষও নির্বাচনে বাঙালী তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয় লাভে অধীর আগ্রহে দিন গুনছিলেন ।বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বাঙালী জাতি কার্যত তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” এবং “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে” বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের এই ভাষণকে তারা আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে গ্রহণ করে এবং যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত হতে থাকে। মেহেরপুরের দুটি থানার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত তাদের প্রিয় নেতার নির্দেশ অনুসারে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
এ প্রেক্ষাপটে ২৫শে মার্চ রাজধানী ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণ এবং গণহত্যার সংবাদ ঐ রাতেই ঢাকা টেলিফোন এক্সচেন্জ থেকে কুষ্টিয়ার এক্সচেনজে পৌঁছায়।
২৫শে মার্চ রাতেই কুষ্টিয়া শহরে ২৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য আকস্মিকভাবে প্রবেশ করে এবং কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে শিবির স্থাপন করে। তারা শহরে প্রবেশ করেই কারফিউ জারী, ধর পাকড়, অত্যাচার নির্যাতন ও মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। এ সংবাদ মেহেরপুর সহ কুষ্টিয়ার তিনটি মহকুমায় ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বহ্নি শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়। ঢাকায় পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং কুষ্টিয়া শহরে পাকহানাদার বাহিনীর প্রবেশের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে তা মেহেরপুর টেলিফোন এক্সচেনজে পাঠান হয়। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য গাংনীর নুরুল হক সঙ্গে সঙ্গে এ খবর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে জানিয়ে দেন। সংবাদ পাওয়া মাত্র এসডিও সাহেব, জাতীয় পরিষদ সদস্য মেহেরপুর শহরের সহিউদ্দিন ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মেহেরপুর থানার ওয়্যারলেস স্টেশনে উপস্থিত হন । তাদের নির্দেশে ওয়্যারলেস অপারেটর আব্দুস সামাদ ঢাকার সাথে যোগাযোগের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ঢাকার রাজার বাগ পুলিশ লাইন থেকে Movement Start কেবল এই বার্তাটুকু গ্রহণ করতে সক্ষম হন এর পর পরই ঢাকার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অগ্নিস্ফলিঙ্গের মত এই সংবাদ রাতারাতি মেহেরপুর শহর ও গাংনী বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মেহেরপুরের মানুষ তো আগে থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল, তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের প্রশাসনিক নেতৃত্বে শুরু হয় সম্ভাব্য পাকিস্তানী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের বাস্তব প্রস্তুতি। মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে মেহেরপুর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ইসমাইল হোসেন ও মেহেরপুরের সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর গাংনী বাজারে যেয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২৫শে মার্চ রাতেই মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের খলিশাকুণ্ডির কাঠের সেতু নষ্ট করে দেন।
২৬শে মার্চ সারাদিন ব্যাপি আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। মেহেরপুর জেলখানায় আটক কয়েদী ও হাজতীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। মহকুমা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জনগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও আক্রমণের কলা-কৌশল শেখান শুরু হয়। মহকুমা প্রশাসক স্বয়ং পেট্রোল বোমা তৈরি ও নিক্ষেপ করার প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
২৬শে মার্চ সকালের দিকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ভারতে দুটি চিঠি পাঠান। একটি চিঠি নদীয়ার জেলা শাসকের কাছে। অপরটি পাঠান হয় মেহেরপুর সীমান্তের বিপরীতে অবস্থিত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সি. ও. লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তীর কাছে। চিঠি দুটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত । একটিতে লেখা ছিল, Indian Brethren help us. অন্যটিতে ছিল, Help us with arms. দু’টি চিঠিতেই মেহেরপুরের মহকুমা শাসক হিসাবে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী স্বাক্ষর করেন। একটি চিঠির বাহক ছিলেন ইদ্রিস আলী ও শাহাবাজ উদ্দিন লিজ্জু। তারা চিঠিটি মেহেরপুর সদর থানার অন্তর্গত দারিয়াপুরের আলীজান মাস্টার ও ডাঃ শামসূল হুদার সহায়তায় নাটনা সীমান্ত ফাঁড়ির মাধ্যমে ভারতে পৌঁছিয়ে দেন। অপর চিঠিটি বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়ীবাঁকা গ্রামের নবীছউদ্দিন আহমদের পুত্র ইদ্রিস আলী খোকাই শেখের পুত্র মজিবর রহমান ও পাতান শেখের পুত্র মহাম্মদ আলী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর নাটনা ক্যাম্পে পৌঁছে দেবার জন্য গেলে সেখান থেকে তাদের তিনজনকে লালবাজার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পত্রবাহকদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ২৯শে মার্চ পর্যন্ত তাদের হেফাজতে রেখে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন যাদব মেহেরপুর থেকে প্রাপ্ত চিঠির বিষয়ে তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে মেহেরপুরের মহকুমা শাসকের পত্র প্রেরণের বিষয়টি ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়।
ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২৯শে মার্চ মেহেরপুরের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ি বেতাই ক্যাম্পে নদীয়ার জেলা শাসক ও বিএসএফ-এর অধিনায়ক কর্নেল চক্রবর্তীর সাথে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে সম্ভাব্য পাকিস্তানী আক্রমনের ফলে উদ্ভূত শরণার্থী প্রবাহ নির্বিঘ্ন ও সহজতর করার জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেবার ব্যাপারে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মেহেরপুরের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও নিশ্চিত যোগাযোগ স্থাপনের স্বার্থে মেহেরপুরের মহকুমা শাসকের সীলমোহর ও স্বাক্ষরযুক্ত পরিচয় পত্রকে পাসপোর্ট হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহেরপুর থেকে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে ইপিআর-এ চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ উইং-এর হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই ২৬শে মার্চ ভোরের দিকে চুয়াডাঙ্গা উইং হেডকোয়ার্টারের সকল অবাঙালী সদস্যকে আটক করেন। এই দিনেই চুয়াডাঙ্গা ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এই অঞ্চলে সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর অস্থায়ী প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
২৫শে মার্চ রাতে আগত পাক হানাদার পাকবাহিনী ২৭শে মার্চ কুষ্টিয়া শহর পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেয়। কুষ্টিয়াকে পাকবাহিনীর দখলে রেখে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে নিরাপদে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং যুদ্ধ পরিচালনা করা ভাবে সম্ভব নয় এই কৌশল গত দিক বিবেচনায় এনে অবিলম্বে কুষ্টিয়া শহরকে হানাদার মুক্ত করার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার জনতাই সর্ব প্রথম পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে এবং সংক্ষিপ্ত প্রস্তুতিতে বলতে গেলে ঢাল-সড়কি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর নিখাদ দেশপ্রেমই ছিল জনতার প্রধান হাতিয়ার ।
২৫শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর কুষ্টিয়া অনুপ্রবেশের পরপরই কুষ্টিয়ার তিন মহকুমার রাজনৈতিক ও সামরিক-বেসামরিক নেতৃবৃন্দ কুষ্টিয়াকে হানাদার বাহিনীর দখল মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করা শুরু করেন। পরিকল্পনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৯শে মার্চ ভোর ৪টায় পাক হানাদার বাহিনীর শিবির জেলা স্কুল আক্রমণ করা হবে।
এই প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহেরপুর অংশের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোটি ছিল মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে, তাকে সহায়তা করেন আওয়ামী লীগ নেতা সহিউদ্দিন, জালাল উদ্দিন, গোলাম রহমান, নুরুল হক, ইদ্রিস আলী; ছাত্র নেতা সহিদুল ইসলাম, আব্দুর রশীদ, চাঁদ আলী, মহিউদ্দিন, সাহবাজ উদ্দিন লিজ্জু প্রমুখ। মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রথম কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজারের মুছাদের বাড়ীতে মহকুমার সকল বন্দুক মালিকদের সহযোগিতায় বন্দুক বাহিনীর কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। গাংনী থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গাংনী বাজারে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে মেহেরপুরের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ব্যাবস্থা করেন। আনসার, মুজাহিদ এবং দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ যুদ্ধ যাবার জন্য প্রস্তুত সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে মেহেরপুর ও গাংনীতে রাতদিন সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। মেহেরপুর শহরের নিউমার্কেটে প্রশিক্ষণার্থীদের খাদ্য সরবরাহের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প খোলা হয়। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের ফ্রন্টের একটি নামকরণও করা হয়- ‘সাউথ ওয়েস্টার্ন কমান্ড’ অর্থাৎ ‘দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন’। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এই কমান্ডের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কমন্ডার নিযুক্ত হন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে মেজর ওসমানের কমান্ডের অধীনে ৭০০ বাঙালী ইপিআর সদস্য ছাড়াও আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ মুক্তিপাগল স্বেচ্ছাসেবকগণ যোগ দেন।
২৯শে মার্চ ভোর ৪টায় পাকবাহিনীর ওপর হামলার দিন-ক্ষণ নির্ধারিত করা হলেও কুষ্টিযা সদর মহকুমার দৌলতপুর থানার ফিলিপনগর সীমান্ত এলাকা থেকে সুবেদার মোজাফফরের নেতৃত্বে ইপিআর-এর একটি কোম্পানির কনভয় কুষ্টিয়ার অদুরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে যথা সময়ে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিতে ব্যর্থ হলে আক্রমণের সময় ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
পরিবর্তিত সময়-সূচী অনুসারে ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায় জেলা স্কুলে অবস্থিত পাকবাহিনীর অবস্থানে বাঙালী প্রতিরোধ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত নরহত্যার আদিম নেশায় উন্মত্ত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে বাঙালী যোদ্ধাদের দৃঢ় দেশপ্রেম, নিরঙ্কুশ জনসমর্থন আর যুদ্ধজয়ের অদম্য বাসনা ছিল প্রধান অস্ত্র। ইপিআর,পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র, যুবক, সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সাধারণ বন্দুক, টু টু বোর রাইফেল, এয়ার গান, ঢাল-সড়কি, লাঠি-ফালা, দা-কুড়াল, যার যা ছিল তাই নিয়ে অংশ গ্রহণ করেন। তাদের পিছনে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপনা ও সাহস জোগাতে “জয় বাংলা” ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। অকস্মাৎ গোলাগুলির শব্দ ও গগন বিদারী জয় বাংলা ধ্বনিতে পাক হানাদার বাহিনী হতভম্ব হয়ে যায়। তারা কোন প্রকার পাল্টা আক্রমণ তো দুরের কথা আত্মরক্ষার উপযুক্ত কৌশলও উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণের ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই কুষ্টিয়ার অধিকাংশ এলাকা ও স্থাপনাসমুহ মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এই যুদ্ধে অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয়। দিন শেষে জেলা স্কুলের পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছাড়া সমগ্র কুষ্টিয়া শহর মুক্তি বাহিনী শত্রু মুক্ত করে। হানাদার বাহিনী কার্যত তাদের শিবিরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সারা দিনের যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রাণহানি ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার ঘটনায় এবং কোন প্রকার ত্বরিৎ সাহায্যের কোন আশা না থাকায় সর্বোপরি জনগণের কাছ থেকে ন্যুনতম সহানুভূতি না পেয়ে পাকবাহিনীর মনোবল ও যুদ্ধ করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে এই যুদ্ধে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো ছাড়া আর কোন উত্তম বিকল্প নেই। ৩০শে মার্চ রাত ৮টার দিকে তিনটা জিপে করে পাকবাহিনীর একদল পর্যুদস্ত সৈন্য ঝিনাইদহের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে শৈলকুপার কাছে তারা জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে প্রাণ হারায়।
৩১শে মার্চ ভোর বেলা মুক্তিবাহিনী পুনরায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের কিছু সময়ের মধ্যেই পাকবাহিনীর ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকবাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। তাদের অধিকাংশ সৈনিক যুদ্ধে প্রাণ হারায়, জীবিতরা পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী ও প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে তারাও নিহত হয়। পাক বাহিনীর ব্যবহৃত অত্যাধুনিক বিপুল অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যুদ্ধ-জয়ী বীর মুক্তিবাহিনী ও জনতার বিজয়োলাসে কুষ্টিয়ার আকাশ বাতাস আনন্দমুখরিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে প্রথম যুদ্ধে বাঙালী মুক্তি যোদ্ধাদের এই বিজয় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই যুদ্ধে জনতার অংশগ্রহণ ছিল আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে জেলার তিনটি মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে এবং পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ, শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডু থেকে শত শত মুক্তিকামী সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ট্রাকে ও বাসে করে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরী খাবার, ভাত, রুটি, ডাব, চিড়া, মুড়ি, গুড়, ছাতু ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন। তারা যুদ্ধ চলাবস্থায় প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে যেভাবে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেছিলেন সেই আত্ম-নিবেদনের অক্ষয় স্মৃতি কোন দিন ম্লান হবে না।
কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহেরপুর থেকে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে মেহেরপুরের ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাঁরা হলেন: (১) খন্দকার আব্দুর রশীদ, পিতা: ডাঃ আব্দুর রহমান খন্দকার, গ্রাম-বামন পাড়া, মেহেরপুর। (২) মোঃ ফজলুর রহমান, পিতা: নছির উদ্দিন, মেহেরপুর শহর, মেহেরপুর। ঐ যুদ্ধে মেহেরপুরের আহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: (১) রায়হান উদ্দিন, পিতা: আব্দুল লতিফ, গ্রাম: রতনপুর, মেহেরপুর। (২) গোলাম রহমান, পিতা: নুর মোহাম্মদ, গ্রাম: মনোহরপুর, মেহেরপুর। (৩) আব্দুল মজিদ (পাতান), পিতা: দুধ মলিক শাহ, মেহেরপুর বড় বাজার। (৪) মোঃ পাতান আলী, পিতা: রতন আলী, মুখার্জি পাড়া, মেহেরপু। (৫) আবদুর রশিদ, পিতা: ইছাহাক বিশ্বাস, গ্রাম: চক শ্যাম নগর, মেহেরপুর। (৬) রবিন, গ্রাম: ভবেরপাড়া, মেহেরপুর।
১লা এপ্রিল সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা পাকিস্তানী শাসন মুক্ত হয়ে যায়। এই সময় থেকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও মাগুড়া অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়। অফিস-আদালতে এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসমুহে স্বাধীণ বাংলাদেশের পতাকা বিরামহীনভাবে উড়তে থাকে।
সম্মুখ যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়ায় উপর্যুপরি বিমান আক্রমণ করে। এই বিমান হামলায় কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজ, জেলা স্কুল ও কয়েকটি বাড়িঘর গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৩রা এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চালায়। বিমান হামলার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিকামী জনতার মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করা এবং কুষ্টিয়ার যুদ্ধের গ্লানিকর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। কিন্তু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার এই বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিকামী জনতা আরও কঠিন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
৩১শে মার্চ একদিকে যখন কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে অন্যদিকে ঐ দিনই ভারতের চেংখালী সীমান্ত ফাঁড়িতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী, মেজর আবূ ওসমান এবং তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এক বৈঠকে মিলিত হন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দ’জন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী এই বৈঠকে ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকের সিদ্ধান্তানুসারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু ত্রাণ সামগ্রী ও হালকা অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মেহেরপুর মহকুমাকে সম্ভাব্য পাকিস্তানী হামলা থেকে রক্ষার জন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ইপিআর-এর জোয়ানদের সার্বিক তত্বাধানে মেহেরপুর আনসার ব্যারাকে কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে লব্ধ পাকিস্তানী অস্ত্র দিয়ে বেসামরিক যুবক ও ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়।
মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে ১লা এপ্রিল থেকেই মেহরপুর সহ কুষ্টিয়া জেলার তিনটি মহকুমা এবং ঝিনাইদহ ও মাগুড়া মহকুমা অঞ্চলে রণপ্রস্তুতি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সুশৃংখল ও যুদ্ধোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে সামরিক প্রশিক্ষণকালেই সামরিক চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বাঙালী বাহিনীতে মেজর আবু ওসমান ছাড়া আর মাত্র এক জন কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। তাই জরুরী ভিত্তিতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাকসক তৌফিক-ই-ইলাহী, ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন ও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক সফিক উল্লাহকে সরাসরি সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে কমিশন দেওয়া হয়। তাদের এই কমিশনিং আদেশ জারি করেন মেজর আবু ওসমান। এই আদেশটিতে বলা হয়: “On behalf of the Bangladesh High Command, I hereby award commission to the following persons directly in the rank of Captain to meet operational requirements:
(a) Mr.Towfiq Elahi Chowdhury.
(b) Mr.Mahbubuddin Ahmed.
(c) Mr. Safiqullah.
এই তিনজন অফিসারই ১৯৭১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত এই সেক্টরে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। কমিশন প্রদানের পর পরই ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন কে ঝিনাইদহ অঞ্চলের সার্বিক প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী কে মেহেরপুরের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন সফিক উল্লাহ মেজর ওসমানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে তার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
স্বাধীনতা ঘোষণাকারী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটিকে কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোন আনুষ্ঠানিক সরকারী সিদ্ধান্ত না নিলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও সম্পদ বিনাশকে প্রতিবেশী দেশের একটি জনগোষ্ঠীর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করে স্বাভাবিক মানবিক দায় বোধ থেকে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আত্মরক্ষার জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী সাহায্য প্রদান করে। ভারতীয় সামরিক সাহায্য ও অন্যান্য উপকরণ ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধূরীর সার্বিক তত্বাবধানে সড়ক পথে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত চেংখালী চেকপোস্টের মাধ্যমে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গায় প্রেরণ করা হয়। ১০ই এপ্রিলের পর থেকে তা বেতাই সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে মেহেরপুরে পাঠানো হয়।
বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে বিতাড়িত করার লক্ষ্য ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে যথার্থ হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিপন্ন করার জন্য একটি সরকার গঠনের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করেন।
চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয়
প্রবাসী সরকারের রাজধানী হিসেবে চুয়াডাঙ্গাকে নির্বাচন করা হয়। এই সময় কুষ্টিয়া জেলার তিনটি মহকুমা এবং পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ ও মাগুড়া মহকুমার সমন্বয়ে গঠিত মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিল চুয়াডাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সংবাদ সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবাদে দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া জেলার অন্যান্য অঞ্চল সহ চুয়াডাঙ্গা তাৎক্ষণিকভাবেই পাকিস্তানী বিমান হামলার শিকার হয়।
১১ই এপ্রিল কুমারখালীতে, ১৪ই এপ্রিল কুষ্টিয়া শহরে এবং ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাতে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী বিমান হামলা চালায়। হানাদাররা চুয়াডাঙ্গায় নাপাম বোমা বর্ষণ করে। এতে চুয়াডাঙ্গার কয়েক স্থানে আগুন ধরে যায়। উপর্যুপরি বিমান হামলার ফলে নবগঠিত প্রবাসী সরকারের পক্ষে চুয়াডাঙ্গা অবস্থান ও কার্যক্রম পরিচালনা করা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয় এবং ১৬ই এপ্রিল মুক্তাঞ্চলের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরের সন্নিকটে ইছাখালীতে স্থানান্তর করা হয়। এর একদিন আগে মেজর আবু ওসমানের নির্দেশে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি মেহেরপুর ট্রেজারিতে নিয়ে আসা হয়।
যুদ্ধকালীন জরুরী প্রয়োজনে এবং নবঘোষিত সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় মেটানোর লক্ষ্যেই এই সম্পদ সংগ্রহ করা হয়। সম্পদ সংগ্রহের এই উদ্যোগে চুয়াডাঙ্গার ডাঃ আসহাব উল হক, মেহেরপুরের জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন, মহকুমা প্রশাসক তথা ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। এই উদ্যোগে সাড়ে চার কোটি নগদ টাকা এবং ২০ সের স্বর্ণ সংগৃহীত হয়। মেহেরপুর খাদ্য গুদামে রক্ষিত পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্যশস্যও নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়। ১৬ই এপ্রিলের মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ের সকল নেতৃবৃন্দ মেহেরপুরে এসে সমবেত হন। নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চলেই নবগঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হবে।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের একটি কার্যকর সরকার গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে তীব্রভাবে। নবঘোষিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক মহলে এই নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে জাতীয় পরিষদ সদস্যবৃন্দ ইতোমধ্যেই ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। এই স্বাধীনতার বাস্তবায়ন তথা দখলদার পাক বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত যুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের জন্যও একটি সরকার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন আঞ্চলিক ভিত্তিতে একাধিক সামরিক ও বেসামরিক তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধরত বাহিনী সমুহকে একটি একক কমান্ডে আনার জন্যও একটি সরকার গঠন প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমনকি অবিলম্বে একটি সরকার গঠনের জন্য যুদ্ধরত সামরিক বাহিনীর কমান্ডারগণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের আশঙ্কা ছিল একটি উপযুক্ত ও বৈধ সরকারের অনুপস্থিতিতে সেনা বাহিনীর স্বাধীনতাকামী বাঙালী যোদ্ধারা বিশ্বজনমতের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী দস্যু হিসেবে গণ্য হবে।
(উদাহারণ স্বরূপ: On April 4, Major Khaled Mosharraf took me, Mohammad Ilyas and Altafur Rahman Chowdhury to the Dak Bunglow at Srimangal and put pressure on us to form a government immediately. He said that the members of the armed forcess would be branded as bandits by the outside world if a government was not formed immediately; he added that they would be compelled to form a government if the Awami League did not form one. -Dewan Farid Gazi, M.P. Our Liberation War in retrospective, Weekend Independent, 24 December 1999) .
আর এই সরকারের বাস্তব গঠন ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান যাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে হয় এ বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। সকল দিক বিবেচনা করে মেহেরপুর শহর থেকে সামান্য দূরে পাকিস্তানী হামলার আশঙ্কামুক্ত সীমান্তবর্তী যে কোন স্থানকে বেছে নেবার সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পরপরই মেহেরপুর সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমান্ত সংগ্রাম পরিষদ নামে স্বাধীন বাংলা প্রত্যাশী একটি সংগঠন গঠিত হয়। মেহেরপুরের বাগোয়ান ইউনিয়নের ভবরপাড়া গ্রামে এই সংগঠনটির তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। সীমান্তবর্তী এই এলাকার জনমত সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল এটা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে পূর্বাহ্নেই অবহিত করা হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান নির্বাচনের সময় অন্যান্য বিষয়ের সাথে সীমান্তবর্তী এই এলাকাটির এই বিশেষ অবস্থাটিও বিবেচনা করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ১৫ই এপ্রিল সকালের দিকে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ভবরপাড়া ও বৈদ্যনাথতলা সরজমিন পরিদর্শন করেন। তিনি ভবরপাড়া সীমান্ত সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ঘোষণা দেন যে বৈদ্যনাথতলায় নবগঠিত সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। তার এই ঘোষণার পরপরই এই এলাকায় সাজসাজ রব পড়ে যায়। ১৬ই এপ্রিল থেকে পুরো এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। সারাদিন ধরে মঞ্চ তৈরী এবং আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়। এই কাজে ভবরপাড়া সীমান্ত সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ও নেতৃবৃন্দ প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মঞ্চে নেতৃবৃন্দের আসন তৈরীর জন্য ইপিআর ক্যাম্প থেকে চৌকি সরবরাহ করা হয়। মঞ্চে ওঠার সম্মুখ ভাগে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। তোরণের ওপরে কাপড় ও তুলা দিয়ে ইংরেজিতে Welcome লিখেছিলেন ভবরপাড়া মিশনের সেবিকা ভগিনী ক্যাথরিনা ও ভগিনী তেরেজিনা।
১৭ই এপ্রিল, মেহেরপুর শহর প্রায় জনশূন্য। চারিদিকে থমথমে ভাব। সন্নিকটে আগত হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের গর্জন মেহেরপুরের সর্বত্র প্রকম্পিত করে তুলেছে। তখনও পর্যন্ত হানাদাররা মেহেরপুরে প্রবেশ করতে পারেনি। মেহেরপুর মহকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে এই সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা ভীড় জমাতে থাকেন। কয়েকশ বিদেশী সাংবাদিক বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সমবেত হন। সকাল থেকেই ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়। স্থানটিতে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্যদের মধ্যে স্থানীয় ১২ জন আনসার এই ঐতিহাসিক ঘটনার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হন । তারা হলেন, সিরাজউদ্দিন, লিয়াকত আলী, সাহেব আলী, হিন্দ কমান্ডার, হামদিল, হাফিজউদ্দিন, আজিমউদ্দিন শেখ, মহি মণ্ডল, অস্তির মল্লিক, আরশাদ আলী, ইয়াদ আলী কমান্ডার, ও নজরুল ইসলাম। গাঢ় ছায়াবৃত আম্রকাননের এক পাশে একটি সাধারণ মঞ্চ ও তোরণ। বাঁশের কাবারী দিয়ে অতি সাধারণ একটি বেষ্টনি তৈরী করা হয়েছে। বেলা তখন ১১টা। দীর্ঘ আলোচনার পর বহু প্রতীক্ষিত সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের সূচনা হলো। অনুষ্ঠান সূচী তৈরী করেছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই- ইলাহী চৌধুরী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, তাজ উদ্দিন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ মঞ্চে এসে দাঁড়ান। অনুষ্ঠান সূচী অনুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই সময় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল তাকে গার্ড-অব-অনার দেয়। আয়োজিত অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন আনন্দবাস মিয়া মনসুর একাডেমীর সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ বাকের, পবিত্র বাইবেল পাঠ করেন পিন্টু বিশ্বাস। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন আসাদুল হক, সাহাবুদ্দিন আহমদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস ও ঢাকা থেকে আগত কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠণ ও ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পর পরই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘোষণা ও সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর মহকুমার একটি অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হিসেবে মুজিবনগর নাম ধারণ করে এক মহান জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যায়। মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের এই সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নবঘোষিত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাজউদ্দিন আহমদ নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। খোন্দকার মোশতাক আহমদকে আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র দপ্তর, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কর্ণেল এম.এ.জি.ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে পূর্বোলিখিত ১২জন আনসার ও অন্যান্যদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড-অব-অনার প্রদর্শন করে। এই সময় মঞ্চে তার ডান পাশে একটু পিছনে সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী। শপথ গ্রহণের অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নবগঠিত সরকার ও অভ্যাগত অতিথিবৃন্দ ঐতিহাসিক এই আম্রকানন ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। প্রগাঢ় শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত একটি বিশালায়তন আম্রকানন তার আঁচলতলে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সজীব চিত্রের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিকে বুকে ধরে নীরবে তার নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার অস্তিত্বে প্রোথিত মুজিবনগর এক বিমূর্ত বাস্তবতা হয়ে ব্যাপ্ত হয়ে গেল বাঙালীর সংগ্রামী চেতনা ও কর্মে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলির প্রতিটি ক্ষণে মুজিবনগর হয়ে উঠলো অনিবার্য উচ্চারণ আর বাঙালীর অবিনাশী আশ্রয়।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ ঘোষণা প্রবাসী মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হিসাবে কার্যকর হয়। এমনকি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ঘোষণা দেশের সংবিধান হিসাবে কার্যকর থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্থান সামরিক বাহিনী কর্তৃক ঢাকা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের অন্যান্য অংশে জনগণের উপর আক্রমণ চালানার প্রাক্কলে উর্ধ্বতন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন।
৩০ মার্চের মধ্যেই তাদের অনেককে কলকাতায় সমবেত হন। গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য ১০ এপ্রিলের মধ্যে কলকাতায় মিলিত হন তারা একটি প্রবাসী আইন পরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপরিষদ সদস্য এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার মাধমে নবগঠিত আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। এ ঘোষণাবলে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার বৈধ বলে বিবেচিত হয় এবং এ ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলের মধ্যে চেইন অব কমান্ড স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
তথ্য সূত্র: আলকামা. অর্গা