‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠনের অন্যতম সদস্য কাজী আরেফ, তিনি এক জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।।কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডর স্মৃতিচারণ ।। ইতিহাসের পাতা থেকে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
কাজী আরেফ ১৯৬০ সালে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরেুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
কাজী আরেফের পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া জেলার মীরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে জগন্নাথ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে বি এস-সি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কালো তালিকাভুক্ত হন। ফলে তাকে স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আরেফ ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন। পরবর্তীতে শাখাটি ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিষদটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতি-কৌশল প্রনয়ণের কাজে নিয়োজিত হয়।[৬] ১৯৬৪ সালে আরেফের পৈত্রিক নিবাস পুরনো ঢাকার ১৪/৩ অভয় দাস লেনের বাড়িতে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন স্থাপন করা হয়। এ মেশিনে মূদ্রিত ‘জয়বাংলা’ ও ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামে স্বাধীনতার ইশতেহার প্রচার করা হতো।
কাজী আরেফ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জাসদে যোগদান করেন। তিনি জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে জাসদের কৃষক সংগঠন জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি এবং ১৯৭৯ সালে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় গ্রেফতার হন এবং ১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চ মুক্তি পান। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
কাজী আরেফ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। ভারতের কালসিতে “এইটটি লিডার্স”এর নেতৃত্ব পর্যায়ে ট্রেনিং গ্রহণ করেন তিনি। পরবর্তীতে পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ছাত্রলীগের সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করতেন।
কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন।তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকারদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদবাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কাজী আরেফ ছিলেন ছাত্রলীগের সমন্বয়ক ও বিএলএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জাসদের কৃষক ফ্রন্ট জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন।
কাজী আরেফ ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কালিদাসপুরে একটি জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
দীর্ঘ বিচার শেষে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে কাজী আরেফ হত্যার ৩ আসামী কুষ্টিয়ার মিরপুরের রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান, কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর হয়।
কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড একজন প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ
১৯৯৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লোকমুখে শুনতে পেলাম কাজী আরেফ আহমেদ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর স্কুলমাঠে জাসদের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সেই সঙ্গে দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের বৈরাগীর চর স্কুলমাঠে ও মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজমাঠে শহীদ মারফত আলীর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতেও তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানটির সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জাসদের সিনিয়র অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলীর সঙ্গে দেখা করতে কুষ্টিয়া কোর্টে এলে তিনিও বললেন, ‘হ্যাঁ, সমাবেশ হবে।’ তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি ফিরোজ চেয়ারম্যান ও হেলালের সঙ্গে দেখা করো, সমাবেশের পোস্টার ছাপানো হয়েছে।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার সময় কালিদাসপুর স্কুলমাঠে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সভাপতিত্ব করবেন স্থানীয় নেতা হেলালউদ্দিন। আমি এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় খবর নিতে শুরু করলাম।
১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর, মিরপুর, ভেড়ামারা; মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা; চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় তত্কালীন উগ্র সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটেছে।
ঠিক সে সময়ই জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সমাবেশ করতে আসছেন! আমি যখন চারদিকে খেয়াল রাখছি, খবর নিচ্ছি, তখনই জানতে পারি, পূর্ব বাংলা নামের উগ্র সশস্ত্র চরমপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী লাল্টু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা চারদিকে ছড়িয়ে আছে সশস্ত্র অবস্থায়। আমি চেষ্টা করি কাজী আরেফ আহমেদের এ কর্মসূচি বাতিল করতে। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। আমি হেলাল এবং ফিরোজ আল মামুন, তত্কালীন আড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলি। তারা দুজনই আমাকে বলেন, আমরা অনেক নিষেধ করেছি, আমাদের কথা আরেফ ভাই শুনছেন না। আমি তখন ঢাকায় যাওয়ার জন্য কুষ্টিয়া এসবি পরিবহনের টিকিট নিয়ে বাসায় এলাম, সকাল ৬টায় বাস ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। ভোরে গ্রামের বাড়ি থেকে এসে এসবি পরিবহন ধরতে পারিনি। কিছুক্ষণ আগে বাসটি ঢাকার উদ্দেশে চলে গিয়েছে। চেষ্টা করলাম লোকাল বাসে উঠে ছেড়ে যাওয়া বাসটি ধরার জন্য, কিন্তু পারলাম না। বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। কাউন্টারে অনুরোধ করলাম ঢাকাগামী পরের বাসটিতে আমাকে একটি টিকিট দেয়ার জন্য, কিন্তু পরিবহন কর্তৃপক্ষ দিতে রাজি হয়নি। আমার কাছে নতুন টিকিট কেনার অতিরিক্ত টাকা না থাকায় ঢাকা যেতে পারলাম না।
আমি মজমপুর গেটে একটি দোকান থেকে কাজী আরেফ আহমেদের ঢাকার টিকাটুলীর বাসায় ফোন করি এবং কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে আমার কথা হয়। আরেফ ভাইকে বলি, আমি আসতে পারলাম না, আপনার বাসার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠালাম, আপনি চিঠি পড়ে অবশ্যই সমাবেশের তারিখ পরিবর্তন করবেন বা বাতিল করবেন। তিনি বললেন, ওকে। বড় একটি চিঠি কুরিয়ারে পাঠাই, তিনি পরের দিন চিঠি পেয়েছেন, পড়েছেন।
১৯৯৯ সালে ১৫, ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনদিনের প্রোগ্রাম ঢাকা থেকে পরিকল্পনা করেন। তত্কালীন জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী কাজী আরেফ আহমেদকে অনুরোধ করেন এ তিনটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য। তিনি রাজি হয়েছিলেন।
১০ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলা ছিল থমথমে, ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে, তাদের বাধা দেয়ার কেউ ছিল না। কাজী আরেফ আহমেদকে হত্যার জন্য চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করে খুনিরা, যাতে কোনোভাবেই তিনি জীবিত ফিরে যেতে না পারেন।
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ—চারদিকে সশস্ত্র অবস্থান নেয় খুনিরা। তিনদিনের অনুষ্ঠান, কোনোভাবেই মিস করা যাবে না—এটাই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা। তারা সেভাবেই হত্যার মিশন সম্পন্ন করেছে। এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। কাজী আরেফ আহমেদের হত্যার ভয়ংকর দৃশ্য না দেখলে বোঝার উপায় নেই হত্যাকারীরা কত বেপরোয়া ছিল।
১৩ ফেব্রুয়ারি। আমি সারা দিন চারদিকে খবর নিচ্ছি। এলাকার পরিবেশ থমথমে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে আমি মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজমাঠে বসে আমার সহপাঠীদের নিয়ে আলোচনা করছি, এমন সময় সংবাদ পেলাম ১৬ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর কালিদাসপুর বৈরাগীচর স্কুলমাঠে জাসদের উদ্যোগে কাজী আরেফ ভাইয়ের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে খবর পেলাম তিনি দৌলতপুরে অবস্থান করছেন।আমাকে খবর পাঠিয়েছেন কালিদাসপুর থেকে জাসদ নেতা হেলাল ভাই, ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে যেন ছাত্রলীগের ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে মঞ্চ তৈরি করি। আমি নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়ে মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ করি। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে, এমন সময় উগ্র চরমপন্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসী মান্নান মোল্লাকে সমাবেশস্থল স্কুলমাঠে দেখতে পাই। আমি দ্রুত সমাবেশের প্রধান আয়োজক অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলীকে অবগত করি। তিনি আমাকে ‘ভয় পেয়ো না’ বলে সাহস দিলেন। আমি সে সময়ে অনবরত আতঙ্ক ও শঙ্কার মধ্যেই ছিলাম।
কাজী আরেফ আহমেদসহ জাসদের নেতারা এলেন। সভা শুরু হলো। সভাপতি হেলাল উদ্দিন আমাকেই সভা পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। আমি মাইকে কাজী আরেফ আহমেদসহ সব নেতাকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়ে সভার কাজ শুরু করলাম। বক্তব্য রাখলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান জাসদ নেতা ফিরোজ আল মামুন, দৌলতপুর উপজেলা জাসদের সভাপতি হাসেমউদ্দিন হাসু চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক আজিবর রহমান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন, মিরপুর জাসদের নেতা বশির উদ্দীন কচি, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী, জেলা জাসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন। শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখার জন্য জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদ ভাইয়ের নাম ঘোষণা করেই আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে সভাস্থলের চারদিকে লক্ষ রাখছিলাম। আরেফ ভাই যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন লোকমান হোসেন, ইয়াকুব আলী, সভাপতি হেলালউদ্দিন, সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন, ইসরাইল হোসেন তফসের আর আমি। হঠাৎ সভাস্থলের পূর্ব পাশ থেকে সশস্ত্র অবস্থায় ১০-১২ জন মঞ্চের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে লোকমান হোসেন, ইয়াকুব আলী, ইসরাইল হোসেন তফসের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ব্রাশফায়ারের পর চোখে শুধুই ধোঁয়া দেখছিলাম। আমি কাজী আরেফ ভাইকে হাত ধরে টান দিতেই তিনি আমাকে মঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি।
চারজনকে হত্যার পর তারা শুধু জানতে চায় কাজী আরেফ আহমেদ কে? কোথায় কাজী আরেফ? সর্বশেষে কাজী আরেফ আহমেদ নিজেই বলেন,‘হ্যাঁ, আমি কাজী আরেফ আহমেদ, কী চাও তোমরা? আর কাউকে গুলি করবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে খুনিরা গুলি করে কাজী আরেফ আহমেদের বুক ঝাঁজরা করে দেয়।
খুনিরা যখন কাজী আরেফ ভাইয়ের বুকে গুলি করে তখন তিনি আমার পিঠের ওপর আছড়ে পড়েন। কাজী আরেফ ভাইয়ের রক্তে আমি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকি। কিছুক্ষণ পরে যখন সন্ত্রাসীখুনিরা চলে যায়, তখন আমি উঠে পড়ি এবং কাজী আরেফ আহমেদকে বাঁচাতে দ্রুত ঢাকা থেকে নিয়ে আসা গাড়িতে করে দৌলতপুর হাসপাতালের দিকে যাই, ডাক্তার দেখে মৃত ঘোষণা করেন। আমি দৌড়ে যাই টেলিফোন অফিসে, প্রথম ফোন করি আরেফ ভাইয়ের টিকাটুলীর বাসায়, ফোন ধরেন ভাইয়ের মেয়ে জুলি, তাকে বিস্তারিত বলি। এরপর ফোন করি তখনকার দলের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ভাইয়ের বাসায়। ফোন ধরেন ভাবী আফরোজা হক। আমি তাকে বলি, আরেফ ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর আমার মনে হয়েছে কথাগুলো বলা প্রয়োজন। বলা হয়, কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ নেতার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী সশস্ত্র উগ্র চরমপন্থী গোষ্ঠী। অন্যান্য শক্তিও তাদের মদদ দিয়েছে, সহায়তা করেছে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে ৪ আসামি এখনো রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অপর একজন কারাবন্দি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। মামলাটির ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামির একজন রওশন আলী গ্রেফতার হয়েছেন। ফাঁসির রায় কার্যকর না করে কেন বিলম্ব করা হচ্ছে, তা জানি না। এখনো যারা গ্রেফতার হয়নি, তাদের দ্রুত গ্রেফতার এবং সবার শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। কাজী আরেফ আহমেদসহ সেদিনে হত্যাকাণ্ডের শিকার জাসদের পাঁচ নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।-স্মৃতিচারণ করেছেন কারশেদ আলম: জাসদ নেতা
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া,বণিকবার্তা