হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা কানাডায় ।।‘খালিস্তান’ নিয়ে কেন ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি।।ভারত-কানাডা বিরোধ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো কেন শঙ্কিত
রুহুল কুদ্দুস টিটো
খালিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার পাঞ্জাব অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম দেশ। প্রস্তাবিত রাষ্ট্রকে ভূখণ্ডগতভাবে ভারতীয় পাঞ্জাব রাজ্য থেকে শুরু করে বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চল পর্যন্ত অথবা অনেক সময় এর প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যসমূহকেও অন্তর্ভুক্ত করে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
এ অঞ্চল শিখদের ঐতিহ্যগত মাতৃভূমি। ইংরেজ দ্বারা অধিকৃত হবার আগে পাঞ্জাব শিখদের দ্বারা ৮২ বছর শাসিত হয়; ১৭৬৭ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র পাঞ্জাব শিখ মিসল (সার্বভৌম শিখ রাষ্ট্র) সমূহের অধীন ছিল, তারপর মহারাজা রণজিৎ সিং শিখ মৈত্রী সঙ্ঘকে শিখ সাম্রাজ্যের মাঝে একীভূত করেন। তবে সেখানে শিখদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু ও মুসলিমও বসবাস করত, এবং ১৯৪৭ সালের আগে শিখরা ব্রিটিশ অখণ্ড পাঞ্জাব রাজ্যের শুধুমাত্র লুধিয়ানা জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ যখন মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবী জানায়, তখন কিছু শিখ নেতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে হিন্দু ও মুসলিমের ভিত্তিতে ভারত বিভাজিত করলে শিখ সম্প্রদায়ের কোন স্বাধীন মাতৃভূমি থাকবে না। তারা তখন বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চলে বিস্তৃত খালিস্তান নামক একটি ধর্মরাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণা পেশ করেন।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দাবী করেন যে শিখরা বরাবরই একটি পৃথক ও সার্বভৌম জাতি ছিল, এবং দক্ষিণ এশিয়ার শিখ অধ্যুষিত এলাকাগুলো দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হবার পূর্ব পর্যন্ত বহু শতাব্দী ধরে স্বাধীন ছিল।
১৮৪৮-১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এ যুদ্ধের ফলে শিখ সাম্রাজ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ হয়, পাঞ্জাব অঞ্চল কোম্পানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তা পরবর্তীতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পরিণত হয়। অনেক শিখ বিশ্বাস করেন যে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময়, হিন্দু-মুসলিমদের পাশাপাশি শিখদেরকেও একটি পূর্ণ সার্বভৌম অথবা পাকিস্তানের অধীনে একটি অর্ধ সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, পরবর্তীতে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে যা থেকে শিখরা বঞ্চিত হয় এবং পাঞ্জাব রাজ্য ভারত-পাকিস্তানের মাঝে বিভাজিত হয়।
ভারত সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় থাকা খালিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিং নিজ্জরের মৃত্যু হয়েছে। কানাডার সারে-তে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। কানাডার খালিস্তান টাইগার ফোর্স (KTF)-এর প্রধান ছিল মৃত খালিস্তানি জঙ্গি। ২০২২ সালে পঞ্জাবের জলন্ধরে একজন হিন্দু পুরোহিতকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে হরদীপ সিং নিজ্জরের বিরুদ্ধে। ঘটনার তদন্ত শুরু করে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। পুরোহিত হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য নিজ্জরের মাথার দাম ১০ লাখ টাকা ধার্য করা হয়েছিল।
এছাড়াও, ভারতে সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মে যোগ থাকার অভিযোগে নিজ্জরের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দাখিল করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি। সেই সময় পালিয়ে গিয়ে কানাডায় আশ্রয় নেয় সে। সম্প্রতি, নাশকতার অভিযোগে ভারত সরকারের তরফে ৪০ জন জঙ্গির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেই তালিকায় মৃত কানাডার খালিস্তান টাইগার ফোর্স (KTF)-এর প্রধানের নাম রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত মার্চ মাসে কানাডায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সম্মানে দূতাবাসে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ছিল। খালিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংয়ের গ্রেফতারের প্রতিবাদে কানাডার খালিস্তানিদের তাণ্ডবের জেরে অনুষ্ঠানের বিঘ্ন ঘটে। বিক্ষোভকারীদের হাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও হেনস্থা হয়েছিলেন বলে অভিযো। পর্যাপ্ত পুলিশি নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও, এই ঘটনার নিন্দা করে সরব হয় ভারতের বিদেশমন্ত্রক। ভারতীয় হাইকমিশনারের অফিসে সামনে সেই বিক্ষোভের মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল খালিস্তানি জঙ্গি নিজ্জরের বিরুদ্ধে।
শুধু হাইকমিশনারের অফিস নয়, গত বেশ কয়েক মাস ধরে কানাডার একাধিক ভারতীয় মন্দিরে তাণ্ডবের ঘটনা ঘেটেছে। মন্দিরের দেওয়াল বিকৃত করার পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি অবনমাননারও অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনাও মৃত খালিস্তানি জঙ্গির মদত ছিল বলে অনুমান। কয়েকদিন আগে লন্ডনে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে খালিস্তান লিবারেশনের প্রধান অবতার সিং খান্দা-র।
যদিও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে খালিস্তানি নেতার মৃত্যুর তত্ত্ব মানতে নারাজ খান্দার অনুগামীরা। হাসপাতালে বিষ প্রয়োগ করে খালিস্তানি লিবারেশনের প্রধানকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি তাদের। আর ঘটনার পিছনে ভারতের মদত রয়েছে বলে দাবি করেছিল অনুগামীরা। মৃত অবতার সিং খান্দা লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিল। শিখ যুবকদের বিপথে চালিত করতে বড় ভূমিকা ছিল সে। ভারতে ধৃত খালিস্তানী নেতা অমৃতপালের উত্থানের পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল খান্ডারের। খালিস্তান লিবারেশন প্রধানের মৃত্যুর কয়েকদিনের ব্যবধানে এবার খুন হল খালিস্তানি জঙ্গি নিজ্জর।
গুরু নানক শিখ গুরুদ্বারের সভাপতি ছিল সে। গত বছরই তাকে ‘ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট’ বলে ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। জানা গিয়েছে, রবিবার সন্ধ্যায় গুরু নানক শিখ গুরুদ্বারের পার্কিং লটে, হরদীপ সিং নিজ্জর নিজের গাড়িতে বসার সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্দুকধারী এসে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে তাকে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে। গুরুদ্বার সংলগ্ন এলাকায় তাদের পথ অবরোধ করতে দেখা গিয়েছে।
বর্তমানে কানাডাবাসী হলেও, তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা জলন্ধরের এক গ্রামে। ‘শিখস ফর জাস্টিস’ বা এসএফজে (SFJ) সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল হরদীপ সিং নিজ্জর। সেই সঙ্গে খালিস্তানিপন্থী জঙ্গি সংগঠন, ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্সে’র কানাডার প্রধানও ছিল সে। দুই খালিস্তানি সংগঠনই ভারতে নিষিদ্ধ। কানাডার ব্রাম্পটন শহরে খালিস্তানি গণভোট আয়োজনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ-র তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে সন্ত্রাসবাদকে ছড়িয়ে দিতে খালিস্তানপন্থী সন্ত্রাসবাদী দল তৈরি করছিল নিজ্জর। এর জন্য সদস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে তাদের প্রশিক্ষণ, অর্থের জোগান – সমস্ত কিছুর সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল সে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উস্কানিমূলক এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়েও দেওয়ার সঙ্গেও যোগ ছিল তার। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ লক্ষ টাকার নগদ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।
খালিস্তান আন্দোলন কী?
গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক খালিস্তানের দাবী উঠতে শুরু করলেও তা আন্দোলনে রূপ নেয় সত্তর আর আশির দশকে। শিখদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির চত্বর থেকে ওই আন্দোলন পরিচালিত হত। আটের দশকের শুরু থেকে ওই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে, অস্ত্র মজুত করা হতে থাকে মন্দির সংলগ্ন ভবনগুলিতে।
সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ১৯৮৪ সালের পয়লা জুন স্বর্ণমন্দির চত্বরে সেনা প্রবেশ করে, শুরু হয় অপারেশন ব্লু স্টার।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শীর্ষ খালিস্তানি নেতা জার্নেইল সিং ভিন্দ্রনওয়ালে সহ বহু খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হন।
সরকারি হিসাবে ওই অপারেশনে ৮৩ জন সেনা সদস্য ও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বেসামরিক নাগরিক সহ ৪৯২ জন নিহত হয়েছিলেন বলে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা তাদের একটি পুরনো প্রতিবেদনে লিখেছে।
কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছিল যে নিহতের সঠিক সংখ্যা অনেকগুন বেশি।

ছবির উৎস,GETTY IMAGESছবি:অপারেশন ব্লু স্টারের পরে স্বর্ণমন্দির চত্বরে অকাল তখৎ ভবন
দশদিনের ওই সেনা অপারেশনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শিখ সম্প্রদায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তারা মনে করেন যে এই অপারেশন তাদের ধর্মের প্রতি সরাসরি আঘাত।
অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে অবস্থানরত শিখ সৈন্যদের একটা অংশ বিদ্রোহ করে। তাদের অনেককে সেনাবাহিনীর অন্যান্য রেজিমেন্টের সদস্যরা গ্রেপ্তার করে যাদের পরে কোর্ট মার্শাল হয়। অনেক বিদ্রোহী শিখ সেনা সদস্য গুলির আঘাতে নিহতও হন।
অপারেশন ব্লু স্টারের কারণেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর।
তারপরে ভারতব্যাপী শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়, যাতে এক হাজারেরও বেশি শিখ নিহত হন। ওই দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ছিল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে।
‘খালিস্তান’ নিয়ে কেন ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে দেশের পার্লামেন্টে ভারতের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলেছেন তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে ভারত সরকারের গুপ্তচরেরা এক কানাডীয় নাগরিককে হত্যার ঘটনায় জড়িত। নিহত ওই শিখ ব্যক্তি ভারতে একজন ঘোষিত সন্ত্রাসী ছিলেন।
কানাডা ভারতের দিকে ওই গুরুতর অভিযোগ তোলার প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে।
কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের একটি শিখ গুরুদ্বারের বাইরে গত ১৮ই জুন গুলি করে হত্যা করা হয় হরদীপ সিং নিজ্জারকে।
সোমবার কানাডার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, “কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের গুপ্তচরদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কানাডার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে।
“কানাডার গভীর উদ্বেগের কথা ভারত সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মধ্যে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছি,” পার্লামেন্টের ভাষণে বলেন মি. ট্রুডো।
ওই ভাষণের পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জলি ঘোষণা করেন যে এক শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে ওই কূটনীতিক পবন কুমার রাই ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সি আর এন্ড এ ডব্লিউয়ের অফিসার।
মি. নিজ্জারকে হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে দিল্লি ‘মনগড়া’ এবং ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে নাকচ করে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী টুইট করে লিখেছেন, “এই ধরণের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়া চলছে।“
এর পরে মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক ডেকে পাঠায় দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকে-কে।
কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়।
জি টুয়েন্টি সম্মেলন থেকে ফেরার সময়ে মি. ট্রুডোর বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান নামের যে বিশেষ বিমানটি ব্যবহার করেন, সেটিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিতে চেয়েছিল ভারত।
তবে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কানাডা। দুদিন দিল্লিতে অপেক্ষা করতে হয় জাস্টিন ট্রুডোকে। আর তিনি দেশে ফেরার পরেই কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজির এক মুখপাত্র জানান, যে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তা স্থগিত করা হচ্ছে।
দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক চন্দন নন্দী, যিনি ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেদন করেন, তিনি বলছেন, “দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যা আবারও ঠিক হতে অনেক সময় লেগে যাবে। গত তিন দশকের মধ্যে এমন ঘটনা মনে পড়ছে না যেখানে কোনও বন্ধুত্বপূর্ণ পশ্চিমা দেশ ভারতের কূটনীতিককে বহিষ্কার করে দিয়েছে। অতি বিরল ঘটনা এটা।“
সম্পর্কের ধারাবাহিক অবনতি
খালিস্তানীদের ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত আর কানাডার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। ভারত বলে আসছে যে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্ম কানাডা ছাড়া যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে আছে।
সাম্প্রতিক জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যেই ওই তিন রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস লিখছে যে, শিখ কট্টরপন্থীদের বাড় বাড়ন্ত এবং ওই দেশগুলিতে ভারতীয় সম্পদের ওপরে হামলা নিয়ে কথা বলেন মি. ডোভাল।
“অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেও কানাডার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবিচল ছিলেন”, লিখেছে পত্রিকাটি।
তারা এটাও লিখেছে যে খালিস্তান সমর্থক জগমিৎ সিংয়ের নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জাস্টিন ট্রুডোর সরকারকে সমর্থন করে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি:শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডো
ভারত-কানাডা বিরোধ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো শঙ্কিত কেন
কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারতের সরকারের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙ্গুল তোলার পরে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এখন চাইছেন যে কানাডার মিত্র দেশগুলি তাদের পাশে দাঁড়াক।
কমনওয়েলথ ছাড়াও কানাডা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, অর্থাৎ নেটো এবং জি-৭-এর সদস্য।
মি.ট্রুডো চান এই দুটি গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে আনা তাদের অভিযোগগুলি গুরুত্ব সহকারে দেখুক।
মঙ্গলবার তিনি বলেন, “এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা, যা অত্যন্ত গুরুতর।“
তার কথায়, মিত্র-দেশগুলি ও ভারতের কাছে উত্থাপন করার আগে পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেছেন।
মঙ্গলবার পার্লামেন্ট হিলে জাস্টিন ট্রুডো সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যা জানতে পেরেছি ঘটনাটি নিয়ে, সেটা প্রথমে আমাদের সহযোগী দেশগুলিকে জানাতে চেয়েছিলাম। আবার আমরা বিষয়টি ভারতের কাছেও গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করেছি।“
ভারত জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে যে এটি কানাডায় ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দেওয়ার ইস্যু থেকে মনোযোগ ঘোরানোর জন্য করা হচ্ছে।
মিত্র দেশগুলিকে আগেই জানিয়েছিল কানাডা
নেটো আর জি-৭ ছাড়া ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স অ্যালায়েন্সেরও সদস্য কানাডা । ওই গোষ্ঠীতে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা রয়েছে। কানাডার তোলা অভিযোগগুলিকে অন্য চারটি দেশই অত্যন্ত গুরুতর বলে অভিহিত করেছে।
পশ্চিমা একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, ফাইভ আইজ অ্যালায়েন্স হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে একটি যৌথ বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানালেও জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে বিষয়টি উত্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জাস্টিন ট্রুডো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও এই ইস্যুতে কথা বলেছেন।
ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলি একে অপরের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে।
ফাইভ আইজ-এর অপর সদস্য দেশ অস্ট্রেলিয়া গত কয়েক বছরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
আবার অস্ট্রেলিয়ায় হিন্দু মন্দিরগুলিতে খালিস্তান-সমর্থকদের ক্রমবর্ধমান হামলার নানা খবর আসছে এবং নরেন্দ্র মোদী অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের কাছেও ওই হামলার ঘটনাগুলির বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি:নেটো সদর দপ্তর। কানাডা নেটো ছাড়াও জি-৭ গোষ্ঠীরও সদস্য
পশ্চিমা কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে
নিউ ইয়র্ক থেকে বিবিসি-র কূটনীতিক সংবাদদাতা জেমস ল্যাণ্ডেলের বিশ্লেষণ:
কানাডা ও ভারতের মধ্যে যে কূটনৈতিক বিরোধ শুরু হয়েছে, তা যাতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলির ওপরে প্রভাব না ফেলে, তার জন্যই এখন প্রবল প্রচেষ্টা চালাবে পশ্চিমা বিশ্বের মন্ত্রী আর কর্মকর্তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলি এই মুহূর্তে কখনই চাইবে না যে এমন একটা বিরোধ তৈরি হোক যেটি ভারতের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে।
বিশ্ব রাজনীতির বৃহত্তর দাবার বোর্ডে ভারত এক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ।
তারা যে শুধুই একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি, তা নয় – ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। আবার চীনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবেও ভারতকে দেখে পশ্চিমা দেশগুলি।
এটা ভারতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে দেখা গিয়েছিল যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে নাম উল্লেখ না করেই একটি চূড়ান্ত বিবৃতিতে ঐকমত্যে পৌঁছিয়েছিল ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্র-দেশগুলি।
এই বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক এড়ানোর মাধ্যমে তারা ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রক্ষা করার পথ বেছে নিয়েছিল, যদিও তাতে আবার কিয়েভের একটা অংশ ক্ষুব্ধ হয়।
পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে আরেকটি আশঙ্কা আছে যদি বিভিন্ন দেশ কানাডা-ভারত বিরোধে কোনও একটা পক্ষ নেওয়া শুরু করে।
গত জুনে কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে এক শিখ নেতাকে হত্যার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই সপ্তাহের গোড়ায় অভিযোগ করার ফলে দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনা তৈরি হয়।
ভারত সম্প্রতি নিজেকে উন্নয়নশীল দেশগুলি, যাদের কখনও ‘গ্লোবাল সাউথ’ হিসাবে পরিচয় দেওয়া হয়, তাদের নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলির মধ্যে অনেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ কঠোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে এইসব দেশগুলিকে বোঝানো যায় যে এই যুদ্ধ তাদের কাছে এবং তাদের অর্থনীতির কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনীতিকরা চাইবেন না যে তাদের সেই প্রচেষ্টায় কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক ভারত-কানাডা বিতর্ক, যেটাকে দুটি কমনওয়েলথ দেশের মধ্যে উত্তর বনাম দক্ষিণ বিরোধ অথবা একটি ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তি আর একটি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসাবে পরিগণিত হয়।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মি. ট্রুডো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি: ক্যাপশান,যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই কানাডার অভিযোগগুলিকে অত্যন্ত গুরত্ব দিলেও সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের কী অবস্থান?
আপাতত কানাডার মিত্ররা বিশ্বস্ত, অথচ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
হোয়াইট হাউস বলেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যার অভিযোগের বিষয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ আর ‘কানাডার যে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।
যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলির জন্য, যেখানে বৃহৎ শিখ সম্প্রদায় রয়েছে, সেখানে সবসময় এই জাতীয় কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের বিদেশ সচিব জেমস ক্লেভারলি বলছেন যে ব্রিটেন “কানাডার গভীর উদ্বেগগুলি খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনবে।“
তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন যে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জলির সঙ্গে তাদের তোলা অভিযোগগুলি নিয়ে সোমবারেই কথা হয়েছে এবং “কানাডা যা বলছে, সেগুলিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে” যুক্তরাজ্য।
তবে ব্রিটেন ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করবে কী না, তা নিয়ে কিছু বলতে চান নি, তবে এটা বলেছেন যে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কানাডীয় তদন্ত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে যুক্তরাজ্য।
“কানাডা এবং ভারত উভয়ই যুক্তরাজ্যে ঘনিষ্ঠ মিত্র, তারা কমনওয়েলথের অংশীদার,” বলেছেন মি. ক্লেভারলি।
অস্ট্রেলিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, ওই অভিযোগুলির ব্যাপারে ক্যানবেরা ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’, এবং তাদের ‘উদ্বেগের ব্যাপারে ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।‘তাই, আপাতত পশ্চিমা দেশগুলি তদন্তের অগ্রগতির ওপরে নজর রাখবে।
আবার কানাডীয় গোয়েন্দারা যা জেনেছেন, সেই তথ্য কয়েকটি মিত্র দেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হতে পারে।
যদি সেটা করা হয়, তাহলে পশ্চিমা শক্তিকে বেছে নিতে হবে যে দিল্লি না অটোয়া, কাকে তারা সমর্থন করবে। আইনের শাসনের নীতিমালা, না রাজনীতির কঠোর বাস্তবতা – এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তখন।
অতীতে রাশিয়া, ইরান বা সৌদি আরবে মতো দেশের বিরুদ্ধে যখন ভিন দেশে হত্যার অভিযোগ উঠেছে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব সেই ঘটনাগুলির নিন্দা জানিয়েছিল।তারা চাইবে না যে ভারতও সেই তালিকাভুক্ত হোক।
তথ্রসূত্র: উইকিপিডিয়া,বিবিসি বাংলা , এ সময়, টিভি9 বাংলা,