১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ।। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় কি ঘটেছিল ।। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখনো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ।। ইতিহাসের পাতা থেকে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান।
ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রবাসী সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরের গ্রামটি হয়ে উঠল সারা দেশের মধ্যে শুধু নয়, সারা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত। এ দিনেই বৈদ্যনাথতলার সবুজে ঘেরা আম্রকাননে সংঘটিত হল বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেতে যাওয়া এমন একটি দেশের নাম, যে নাম সে দেশের জাতীয় ভাষার নামে রাখা এবং যে নামটি স্বয়ং দিয়েছেন সে দেশেরই স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতার ঘোষক, যিনি হিমালয়সম উচ্চতায় নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন বিশ্বের ইতিহাসে।
তার স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশের হাঁটি হাঁটি করে যাত্রা শুরু বৈদ্যনাথ বাবুর এ আমবাগান থেকে, যা আজ সেই স্বাপ্নিক মানুষটির নামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছে মুজিবনগর নামে। মুজিবনগর নামটি জনগণের হৃদয়ে উৎকীর্ণ করে দিয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শপথগ্রহণের দিনেই। বাংলার মানুষ প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল দিনটিকে ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে পালন করেন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে।
২৫ মার্চ রাতে রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে।
২৬ মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলেছেন– “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন– এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারি মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”
১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়।
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়।
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’–এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম– ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন, সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।
ইত্তেফাক অনলাইন এক সাক্ষাৎকারে ১০ এপ্রিল, ৭১-এর এই দিনে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলেন আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখনো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি
ইত্তেফাক অনলাইন : ১০ এপ্রিল, ৭১-এর এই দিনে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’রচনার মতো ঐতিহাসিক কাজে আপনার অংশগ্রহণের জন্য ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম আপনাকে ইত্তেফাক অনলাইন থেকে কৃতজ্ঞতা।
ইত্তেফাক অনলাইন এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলেন: আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখনো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা-পর্যালোচনা পর্যন্ত হয়নি। তবে ‘বাংলাদেশের গণপরিষদের কার্যবিবরণী ও প্রাসঙ্গিক তথ্য’ গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে বেশ কিছু লেখা আছে। বইটিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের স্বাধীনতার দলিলপত্রের তথ্য রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির পরিপূর্ণ তথ্য রয়েছে। এখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।
১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য সোহেল তাজসহ বিভিন্ন মহল দাবি জানিয়ে আসছেন, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।-ইত্তেফাক অনলাইন
ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম: এটা শুধু আমার মন্তব্য নয়, ইতিহাসও তাই বলবে। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা উচিত। ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করার কথা সোহেল তাজ বলেছেন। সঠিকভাবে সেটা তিনি মূল্যায়ন করেছেন। আজ তাজউদ্দিন আহমেদ বেঁচে থাকলে তিনি এই কথাটি বলতেন। ১৭ এপ্রিল তো সরকার শপথ নিয়েছিল। শপথটা মুখ্য নয়। ঐতিহাসিক দলিল তৈরি হয়েছিল ১০ এপ্রিলে। সেটাকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করার কথা সোহেল তাজ বলেছেন।
এই ঘোষণাপত্র স্বাধীনতাযুদ্ধে কী প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে জানতে চাই।-ইত্তেফাক অনলাইন
ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম: হ্যাঁ, বলা যেতে পারে। যতদিন সংবিধান তৈরি হয়নি, ততদিন এটা ছিল প্রথম সাংবিধানিক দলিল। যেমন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাদের প্রথম সাংবিধানিক দলিল। অতএব এটাকে রাষ্ট্রের প্রথম সাংবিধানিক মৌলিক দলিল বলা যায়। বাংলাদেশের জনগণ কি জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধ করলেন, সেটাও এখানে বলা আছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, এই তিনটি মৌলিক কথা সেখানে উল্লেখ আছে। –ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সাক্ষাৎকারটি ইত্তেফাকে প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২২
মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় কি ঘটেছিল
১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ – মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এক আমবাগানে শপথ নেয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার।শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে। তাঁর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন মেহেরপুরে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে।
সেখানে তিনি বলেন, ”সমবেত সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং উপস্থিত জনসাধারণ, আপনাদের সামনে আমার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীকে আপনাদের সামনে সর্বপ্রথমে উপস্থিত করছি। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ।”
এ সময় সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছাড়াও তিনি মন্ত্রী হিসাবে অনুষ্ঠানে হাজির করেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই মুজিবনগর সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা – যা পরে মুজিবনগর নামে পরিচিতি পায় – সেখানে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, তা আয়োজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সেসময় মেহেরপুরের সাবডিভিশনাল অফিসার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের নানা খুঁটিনাটি কথা।
”আমি এবং আমার বন্ধু মাহবুব, আমাদের সহযোগিতায় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে আমরা সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম,” বিবিসিকে জানিয়েছিলেন তিনি।
”সেই সুবাদে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং পরের দিকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আমরা টেলিফোনে কলকাতার সঙ্গে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গার সংযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।”
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ”এরই ধারাবাহিকতায় যখন সরকার গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিল, তখন আমাকে বলা হলো যে অতিসত্বর সরকার গঠন করা হবে, তোমাদের দিক থেকে একটা প্রস্তুতি নাও। ধারণা দেয়া হলো যে ওই এলাকাটায় এটি গঠিত হতে পারে।”
”কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তখন আমরা পিছু হটতে শুরু করেছি। পাকিস্তান আর্মি যশোর থেকে আক্রমণ শুরু করেছে, চুয়াডাঙ্গায় বম্বিং শুরু করেছে। আর্টিলারির সহায়তায় তারা বেশ অগ্রসর হচ্ছে। টেকনিক্যাল রিট্রিট বলতে যেটা বোঝায়, আমরা সেটা এর মধ্যেই শুরু করে দিয়েছি।”
”এসব ঘটনার মধ্যেই আমাদের মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে যে, তোমরা তৈরি থেকো, সরকার গঠন হতে পারে। এরকম সময়ে ১৫ই এপ্রিলের দিকে আমরা যখন মেহেরপুরে চলে এসেছি, তখন আমাকে খবর দেয়া হলো যে একটা জায়গা তোমরা বাছাই করো,” স্মৃতিচারণ করছিলেন মি. চৌধুরী।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন ছিলো যে বৈদনাথতলার ওই স্থানটিকে বাছাই করার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আমলে নেয়া হয়েছিল? জবাবে তিনি বলেন, এমন একটি জায়গা বাছাই করতে বলা হয়েছিলো যেখানে ভারত থেকে সহজেই ঢোকা যায়, যে এলাকা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে – বিশেষ করে আকাশ থেকে এবং বাংলাদেশের দিক বিবেচনা করলে একটু যেন দুর্গম হয়।
”লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী নামে বিএসএফের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৈদ্যনাথতলার আমবাগানটি বাছাই করা হলো। সেখানে আমবাগান থাকায় আকাশ থেকে সহজে দেখা যায় না। মেহেরপুর থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্বে হলেও রাস্তাঘাট নষ্ট থাকায় সহজে যাওয়া যায় না। আবার ভারত থেকে সহজেই সেখানে প্রবেশ করা যায়।”
তিনি বলেন, পুরো বিষয়টির আয়োজন করা হয়েছিল খুবই গোপনে। ”কী হবে সেটা কাউকে বলিনি। তখন আমাদের সীমান্ত এলাকায় রেগুলার ইপিআর নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে আনসারের একটি ছোট কন্টিনজেন্ট রেখেছিলাম – সীমান্তের প্রতীকী নিরাপত্তার জন্য।”
মি. চৌধুরী বলেন, ”তাদের কাছে গিয়ে আমরা বললাম যে, ভারতের দিক থেকে কয়েকজন লোক আসতে পারে। এখানে একটা জায়গায় অনুষ্ঠান হতে পারে, তোমরা তাদের সাথে যোগাযোগ রেখো এবং যা বলে করো। পরে খবর পাঠানো হলো যে ১৭ই এপ্রিল তোমরা প্রস্তুত থেকো।”
ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পিছু হটে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার কৃষ্ণনগরে পৌঁছেন মাগুরার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম *বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে* এবং পাবনার প্রশাসক নুরুল কাদের, *মোহাম্মদ নুরুল কাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব, উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশে শতভাগ-রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শিল্পের জনক ছিলেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের খবর তাদের কাছেও পৌঁছেছিল, বলছেন ওয়ালিউল ইসলাম।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন,”তখন মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গা থেকে তার হেডকোয়ার্টার মেহেরপুরে নিয়ে গেছেন। চুয়াডাঙ্গায় কিছু বোমাবর্ষণ হওয়ায় তারা জায়গা বদল করেছেন। ওখানে দুই দিন থাকার পরে আমরা যখন ভারতে প্রবেশ করি, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।”
”সেখান থেকে আমরা কৃষ্ণনগরে গেলাম – এটা ১৬ তারিখের কথা। নুরুল কাদের আমাকে বললেন, তুমি কাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চলে এসো, কিছু কাজ আছে।” ”আমি সাড়ে ৮টা-পৌনে ৯টার দিকে গেলে তিনি বললেন, নদীয়ার ডিএম (ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট) খুঁজছে, তুমি একটু কথা বলো। আমি ফোন করলে তিনি বললেন, দেখুন আমাদের কাছে খবর আছে, আমাদের কাছাকাছি বাংলাদেশের ভেতরে আপনাদের সরকার শপথ নেবে। তো, আপনারা যারা এখানে আছেন, তাদের পাঠিয়ে দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ পেয়েছি,” বলছেন মি. ইসলাম।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে সকালে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জানান, স্থান নির্বাচনের পর তাদের অনুষ্ঠান আয়োজনের যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হলো।
”সেখানে আমরা ছোট একটা মঞ্চের মতো ব্যবস্থা করলাম। কাছাকাছি ভবেরপাড়ার একটি মিশনারি হাসপাতাল থেকে কিছু চেয়ার টেবিল ধার করে নিয়ে আসলাম। ভারতীয় আর্মির কিছু লোককে যেতে দেয়া হলো, যাতে কোন বিমান হামলা হলে সেটাকে দমন করা যায়।”
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ”আমাদের লোকজনকে নিয়েও একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো, যাতে শত্রু আক্রমণ করলে প্রতিরোধ করে সবাই নিরাপদে চলে যেতে পারেন।ওই সময় যুদ্ধের পরিস্থিতিতে গ্রামেগঞ্জে খুবই সীমিতভাবে আয়োজন করতে হয়েছিল।”
সকাল ৯টার সময় থেকে অনুষ্ঠানস্থলে আমন্ত্রিত অতিথিদের আসা শুরু হয়।কৃষ্ণনগর থেকে সেখানে গিয়ে ওয়ালিউল ইসলাম দেখতে পান, বৈদ্যনাথতলায় একটি মঞ্চ বানানো হয়েছে। মঞ্চে সাতটি বা আটটি চেয়ার ছিল, যার একটি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য খালি ছিল।
সেখানে ‘ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’ পাঠ করলেন গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। তিনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান।
”এরপর আমরা ভেবেছিলাম ইপিআরের লোকজনকে দিয়ে একটা গার্ড অব অনার দেয়া হবে। কিন্তু মেজর ওসমানসহ ইপিআরের লোকজন তখনো সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। তখন আমি বিকল্প সমাধান খুঁজতে বাধ্য হলাম,” বলছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
”সেখানে আনসারের যে লোকজন ছিল, তাদের একত্রিত করে আমার বন্ধু মাহবুব – যে ঝিনাইদহের এসডিও ছিল। যেহেতু তার গার্ড অব অনার দেয়ার প্রশিক্ষণ রয়েছে, তখন তাদের নিয়ে একটি রিহার্সাল দেয়া হলো। এরপরে তারাই গার্ড অব অনার দিলেন।”
তখন সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদেরও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং উপস্থিত অভ্যাগতদের সঙ্গে।
ওয়ালিউল ইসলাম বলছেন, ”গার্ড অব অনারের পর তৌফিক এসে বললো, ‘আপনারা যারা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই’। তখন আমরা সাত অথবা আটজন দাঁড়ালাম। বাকিরা সবাই সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বা ক্যাপ্টেন পদের কর্মকর্তা ছিলেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো যে আমি একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা।”
অনুষ্ঠানটি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন যে গোটা সময়টা জুড়ে তার মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছিল। ”সব সময়ে একটা ভয় ছিল কোন কারণে যদি পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করে বসে! তবে একটা আশার কথা ছিল যে, ওখানে আসতে হলে ভারতের আকাশসীমা হয়ে আসতে হয় – না হলে বিমান ঘুরতে পারে না। তাই একটা চেষ্টা ছিল যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু শেষ করে চলে যাওয়া। অনুষ্ঠানটি দীর্ঘায়িত করার কোন পরিকল্পনা ছিল না।”
আমবাগানের ঘন পাতার আচ্ছাদনে আড়াল করা ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ তার ভাষণে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ”আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্যে যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাওয়ার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।”
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সেদিন অনুষ্ঠানে অন্ততপক্ষে একশো’ সাংবাদিক উপস্থিত হয়েছিলেন, আর তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক বিদেশী সাংবাদিক।
ওয়ালিউল ইসলাম বলেন,
১০ই এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম বাংলাদেশের যে সরকার গঠন করা হয়েছিল, ১৭ই এপ্রিল সেই সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লড়াই একটা অঙ্গীকার পেয়েছিল।
”আমি সেখানে একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম, এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানিরা কখনোই এখানে জয়লাভ করতে পারবে না। সরকার গঠন হওয়ায় আমি এটাকে একটা পজিটিভ দিক হিসাবে দেখেছি যে এর ফলে আমরা আনুষ্ঠানিকতা পেলাম, একদিন স্বাধীন আমরা হবোই,” বলছিলেন ওয়ালিউল ইসলাম।
সেদিন ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলো মেহেরপুরের একটি অখ্যাত আমবাগান।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন,
”ওই আমবাগানটা খুব ঘন আমবাগান। অনেক পুরনো আমগাছ – গাছে গাছ লেগে ছাতার মতো হয়ে থাকে। দিনের আলো ঝিলমিল করছিল, আনন্দঘন উৎসবের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল প্রকৃতিও যেন এটাকে সমর্থন দিচ্ছে, আর রূপকথার মতো অনুষ্ঠানটা শেষ হলো।”
”অজপাড়াগায়ের একটি পল্লী – যে আমবাগানে কখনো কিছু হতো না – সেখানে একটা দেশের সরকারের প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আমারা সবাই যখন চলে গেলাম, তখন যেন রূপকথার রাজকন্যাকে সোনার কাঠি দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি, সমকাল, উইকিপিডিয়া