১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী
১৯৪৭-১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ পরিক্রমা
ভারতে ব্রিটেনের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে এক বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত ‘হোয়াইট পেপার’ বা ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন।
শ্বেতপত্রে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। ওই বৈঠকে সব দলের নেতৃবৃন্দ পরিকল্পনা মেনে নেন।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হয়- ভারত এবং পাকিস্তান।
করাচি, পাকিস্তান
মুসলিম লীগের প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হন, ১৭ই অগাস্ট পাকিস্তানের করাচিতে গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ নেন।
ঢাকায় বিভিন্ন সড়কে সেদিন আতশবাজি পোড়ানো হয়েছিল,।
পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পূর্ব পাকিস্তান সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়।
কিন্তু পরে মুসলিম লীগের রাজনীতির বিপরীতে ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি দল গঠনের আলোচনা, যার প্রেক্ষাপটে প্রথমে ছাত্রলীগ এবং পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
ঢাকা
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে নতুন প্রতিষ্ঠিত দলের নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৫৫ সালে এই নাম থেকে মুসলিম অংশটি বাদ দেয়া হয়েছিল।
কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ অনুষ্ঠানে জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্রদের একটি অংশ তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়।
রোজ গার্ডেন, ঢাকা
ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
ঢাকা
২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো।
সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করে; ঘটনাস্থলে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার- তিনজন মারা যান। হাসপাতালে মারা যান আব্দুস সালাম।
ঢাকা
আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে থাকেন।
হাজারো মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সরকার সেদিন সব সভা সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। এই দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শোকের প্রতীক হিসাবে কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন ঢাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে।
মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে।
মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০শে মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়।
পাকিস্তান পার্লামেন্ট
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হয়।
ঢাকা
ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অন্যতম দাবি ছিল বাংলা ভাষার প্রসার ও গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র একাডেমি স্থাপন করা। অবশেষে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলা একাডেমী।
ঢাকা
প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে বর্তমানে যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যা ১৯৬২ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু বৈষম্যমূলক বলে ওই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
হাইকোর্ট, ঢাকা
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪৪ ধারার মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর পূর্বপাকিস্তানে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। সেদিন ঢাকায় হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা এবং বাবুল।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।
লাহোর, পশ্চিম পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু সেটি তখন গৃহীত হয়নি।
পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এ দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ছয় দফা দাবি আনা হয়েছে।
ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের সামনে ছয় দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন।
ঢাকা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত মামলাটি দায়ের করা হয়। এ মামলার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার। মামলায় ৩৫জনকে আসামি করা হয়।
এদিন ২ জন সিএসপি অফিসারসহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ায়, প্রথমে আসামিদেরকে ‘দেশরক্ষা আইন’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়।
১৯৬৯ সালের শুরুতে পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
আসাদ গেট, ঢাকা
পুলিশের গুলিতে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ মৃত্যুবরণ করেন। সহযোদ্ধারা আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করে। পরে শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলে আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদগেট নামকরণ করা হয়।
ঢাকা সেনানিবাস
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দি থাকা অবস্থায় ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী একজন সৈনিকের ছোড়া রাইফেলের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ভোলা
ইতিহাসের অন্যতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভোলার সাইক্লোনকে মোটেও গুরুত্ব দেননি, আর বিষয়টি এ অঞ্চলের মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল, যা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল।
তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
কারফিউ ভেঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে আয়োজিত ছাত্র-জনতার বিশাল এক সমাবেশে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও ডাকসু নেতারা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।
রেসকোর্স ময়দান, ঢাকা
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিট ব্যাপী ভাষণ দেন। ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, সেখানেই শেখ মুজিব বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ঢাকা
পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার শুরু হয়েছিল ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে। ওই রাতে হামলার সামরিক নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, তেজগাঁও বিমানবন্দর, মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, আজিমপুর, জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
কালুরঘাট, চট্টগ্রাম
সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। এর আগে দুপুর বেলাতেও তিনি সেটি পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন।
পরদিন ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাতের অধিবেশনে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে লিখিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
তথ্য সূত্র: বিবিসি এবং ছবি: গেটি ইমেজেস, মুজিব১০০.গভ.বিডি