১৯৪৭ সালে মেহেরপুরকে ভেঙ্গে দু টুকরো করা হয়
রাজনীতি কেবল ভূখন্ডকেই যুক্ত ও বিভক্ত করেনা; যুক্ত ও বিভক্ত করে ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-রাষ্ট্র-সমাজ-সভ্যতাকে
১৯৪৭- এ দ্বিখন্ডিত হয় বাংলা ভাষার ভূখন্ড, দ্বিখন্ডিত হয় চৈত্য-লালনের নদীয়া; বিভক্ত হয় মেহেরপুর। রাজনীতি সব পারে; সব পেরেছে-চিরবন্ধুদের মধ্যে এনে দিতে পারে যুদ্ধের তান্ডব, শক্রদের মাঝে আনতে পারে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মিলনোৎসব। এই রাজনীতিই ১৯০৫ সালে হাজার বছরের বাঙালাকে দ্বিখন্ডিত করেছে; আবার এই রাজনীতিই ১৯১১ সালে দ্বিখন্ডিত বাঙলাকে এক ও ঐক্যবদ্ধ করেছে। রাজনীতি কেবল ভূখন্ডকেই যুক্ত ও বিভক্ত করেনা; যুক্ত ও বিভক্ত করে ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-রাষ্ট্র-সমাজ-সভ্যতাকে। সাতচল্লিশের দ্বিখন্ডন দুভাগে ভাগ করে দেয় মেহেরপুর এবং তার কয়েকশত বছরের দীর্ঘ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্রোতকে।
এই দু’স্রোত ভাগ করে দেয় মেহেরপুরকে এবং তার কয়েকশত বছরের দীর্ঘ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্রোতকে। এই দু’স্রোত ভাগ হেয় ঢোকে দুদিকেঃ মৃদু ক্ষীণ স্রোতটি প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গে আর পূর্ব বাঙলায় প্রবেশ করে ব্যাপক বিস্তৃত তরঙ্গসংকুল স্রোতটি। সাতচল্লিশের দ্বিখন্ডন এর বিভক্তি আমাদেরকে মেহেরপুরের অখন্ড ইতিহাস আবিষ্কার করতে দেয়নি; যা দিয়েছে তা কেবল খন্ডতার ইতিহাস। আর এই খন্ডতার কখনোই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ এই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জনপদের শুধু রাজনীতি নিয়ে নয়; শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি, ধর্ম, দর্শন নিয়ে রচিত হতে পারতো এক এক অন্যন্য ঐতিহাসিক উপাখ্যান। কারণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উজ্জ্বল অর্ভ্যূদয়ের মুহুর্তেই মেহেরপুর গৌরবময় ও সাহসী ভূমিকা পালন করেনি; এর রয়েছে কয়েকশত বছরের দীর্ঘ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি, ধর্ম, দর্শন এর আলোকিত ইতিহাস।
মেহের এক প্রাচীন জনপদের নাম। ইতিহাসের কোন সোনালী অতীতে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে তা জানা যায় না। তবে জনশ্র“তি আছে, রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলে এখানে জনপদ গড়ে ওঠে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। কুমুদনাথ মল্লিক এর নদীয়া কাহিনী তে মেহেরপুরকে বিখ্যাত রচনাকার মিহির ও খনার বাসস্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মিহিরের নাম থেকেই মিহিরপুর পরবর্তীতে অপভ্রংশ মেহেরপুর নামের উদ্ভব হয়েছে।
মেহেরপুর নামকরণ
দরবেশ মেহের আলীর নামানুসারে যে মেহেরপুরের নাম করণ করা হয়েছে তারও কোন ঐতিহাসিক সত্যতা খুঁজে যাওয়া যায় না। তবে মেহের আলীর নামেই মেহেরপুরের নামকরণ হয়েছে তা স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় বার বার উঠে এসেছে।দরবেশ মেহের আলী কবে কোথা থেকে এ জনপদে এসেছিলেন তারও সঠিক তথ্য প্রমানদি পায়া যায় না। তবে মেহের আলীর নামেই মেহেরপুরের নামকরণ হয়েছে তা স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় বার বার উঠে এসেছে।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় মেহেরপুরকে মহকুমা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। নদীয়া জেলার অন্তর্ভূক্ত এই মহকুমা চারটি থানা- করিমপুর, তেহট্ট, গাংনী, এবং মেহেরপুর নিয়ে গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ এর ভিত্তিতে মেহেরপুরকে ভেঙ্গে দু টুকরো করা হয়। শুরু হয় মেহেরপুরের নতুন ইতিহাস, তৈরী হয় নতুন ভুগোল। ১৯৮৪ সালে ২৪ ফের্রুয়ারি মেহেরপুর জেলার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
মেহেরপুর লড়াই সংগ্রামের বাতিঘর
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কোন আকম্মিক ঘটনার ফলশ্র“তি নয়। ইতিহাস এক অনিবার্য পরিনতিতেই আসে একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। কত লড়াই সংগ্রামের অগ্নিঝরা দিন পেরিয়েই এসেছে একাত্তর। তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা সুর্যসেনের চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ইলামিত্রের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে বাঙালি মুজিবনগর পৌছায়; অবশেষে বজ্রশপথ ও অগ্নিঝরা লড়াই এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজার বছরে স্বপ্নলালিত স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাঙালির সকল সংগ্রাম ও আন্দোলন মেহেরপুরের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ফকির মজনু শাহ, চেরাগ আলী শাহ্ ভবানী পাঠক দেবী চৌধুরানীদের নেতৃত্ব পরিচালিত ফকির সন্ন্যাসী (১৭৬০-১৮০০) মেহেরপুরের গাংনীর ইন্দুভুষন সন্ন্যাসীর গড়ে তোলে প্রতিরোধ সংগ্রাম। নীল বিদ্রোহের আগুনও জ্বলেছিল মেহেরপুরে। নদীয়া জেলার চৌগাছা, চুয়াডাঙ্গার শালঘর মধুয়ায় নীল বিদ্রোহের সূচনা হলে মেহেরপুরের কৃষকরাও সে বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করে এবং গড়ে তোলে প্রবল আন্দোলন।
নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্বে দেন স্থানীয় জমিদার মথুরানাথ মুখোপাধ্যায় ও নবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। নাটুদহের জমিদার নফর পাল চৌধুরী, স্থানীয় কৃষক ওসমান মন্ডল, গোলাম রব্বানী ও মীর আহম্মদের রয়েছে নীল বিদ্রোহ অসামান্য ভূমিকা। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিকাশ ও রাজনীতিকে গনমুখী করার ক্ষেত্রেও মেহেরপুর পালন করে উজ্জ্বলতর ভূমিকা। কংগ্রেস নেতা বল্লভপুরের আশুতোষ উকিল, দারিয়াপুরের প্রমথনাথ বিশ্বাস, গাড়াডোবের মনি স্যান্যাল, কমিউনিষ্ট নেতা মাধব মোহন্ত এবং মুসলিম লীগ নেতা আ্যাডভোকেট আবদুল হান্নান এর রয়েছে এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গনঅভ্যুথান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনেও এ জনপদের মানুষ পালন করে অনন্য ভূমিকা। একাত্তরে মেহেরপুর ছিল সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের কাছে বাতিঘর।
মেহেরপুর বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেখানে হিন্দুর চেয়ে খৃষ্টানের সংখ্যা বেশী
মেহেরপুর বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেখানে হিন্দুর চেয়ে খৃষ্টানের সংখ্যা বেশী। উনিশ শতকের তিন দশকের শেষের দিকে মিশনারীরা খৃস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্য মেহেরপুর অঞ্চলে আসেন। খৃষ্টধর্মের মানবকল্যাণমূলক কর্মকান্ড, সাম্য-মৈত্রীর বাণী নিম্নবর্গীয় হিন্দু মুসলমানদের আকৃষ্ট করে এবং ভবরপাড়া, রতনপুর, বল্লভপুর, নিত্যনন্দপুর; জুগিন্দা, পাকুড়িয়ার মানুষ দলে দলে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। উনিশ শতকের মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রগন্য পুরুষ ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক মুন্সী জমিরুদ্দীন এক সময় (২৫ডিসেম্বর ১৮৮৭) খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, ইসলাম ধর্ম প্রচারক যশোরের মুন্সী মেহেরউ্ল্লাহ, মোজাম্মেল হক, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখের সাথে তাঁর ছিল আন্তরিক সখ্যতা। মুন্সী জমিরুদ্দীন কেবল খৃষ্ট ও ইসলাম ধর্মের পন্ডিত ছিলেন না; ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে ও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। হিন্দু ধর্মের মহান সংস্কারক নিগমানন্দ সরস্বতীর জন্ম ১২৮৭ বঙ্গাব্দে রাধাগোবিন্দপুর গ্রামে। তার পৈতৃক নিবাস মেহেরপুরের কুতুবপুর গ্রামে। শ্রী চৈতন্য ও শংকরের দর্শনের সমম্বয়ে এক নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী নিগমানন্দ গৃহী হয়েও ছিলেন সন্ন্যাসী আশ্রমিক মর্ত্য ও মানবের প্রেমে ব্যাকুল এক সত্ত্বিক পুরুষ তিনি বলেন সংসার আশ্রম কঠোর এবং ভীষণতর জানি তথাপি সংসার আশ্রম জীবের উন্নতির সোপান। ক্রোধের বসে দুঃখে বা অভিমানে কাপুরুষের ন্যায় সংসার ত্যাগ সন্ন্যাসের সাধনা নং স্বার্থ সাধনের নামান্তর। নিগমানন্দের ধর্ম দর্শন ও আধ্যাত্মিক ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে তার জ্ঞানীগুরু (১৩১৫) প্রেমিক গুরু ও তান্ত্রিকগুরু (১৩১৮) যোগী গুরু (১৩১২) প্রভৃতি গ্রন্থে।
ইসলাম ধর্মের প্রসার ও পুনর্জাগরণের রয়েছে মেহেরপুরের দরবেশ ও সাধকদের অগ্রনী ভূমিকা। উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম পুনর্জাগরনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন মেহেরপুরের মুন্সী জমিরুদ্দীন। এ দেশের মুসলমানরা যখন ইতিহাস ঐতিহ্য বিস্মৃত অর্থনৈতিক ভাবে দারিদ্র ক্লিষ্ট তখন খৃষ্টান মিশনারীরা তাদেরকে নানাভাবে বিপথগামী করতে চেয়েছিল। মুন্সী জমিরুদ্দীন বক্তৃতা ও লেখালেখির মাধ্যমে মুসলমানদের বিপথগামিতা ও ধর্মান্তরকরণের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতি চর্চায় মেহেরপুর
জ্ঞান দর্শন পন্ডিতের শাস্ত্র চর্চা শিল্প সাহিত্য চর্চার পীঠস্থান নদীয়া। অখন্ড নদীয়ার মহকুমা হিসেবে মেহেরপুরের রয়েছে শিল্প সাহিত্যের গৌরবময় ও আলোকিত অতীত। কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী, বৈষ্ণব পদকর্তা জগদীশ্বর গুপ্ত, কবি রমনীমোহন মল্লিক, দীনেন্দ্র কুমার রায় (১৮৫৯-১৯৪৩), আব্দুল হামিদ, কাব্য বিনোদন উজীউদ্দিন আহমদ, মুহাম্মদ আব্দুল আজীজ সাহিত্যিক,মুন্সী জমিরুদ্দীন রেয়াজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের মত সাহিত্যিক মেহেরপুরে জন্মগ্রহণ এবং একানেই সাহিত্য চর্চা করেছেন। এদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন রমনীমোহন মল্লিক ও দীনেন্দ্র কুমার রায়। রমনীমোহন মল্লিক মেহেরপুরের বিখ্যাত মল্লিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্য পন্ডিত, দীনেন্দ্র রায় ছিলেন সাংবাদিক ও লেখক এবং কলকাতার বসুমতি (১৯০০) পত্রিকার সহ সম্পাদক। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশনার তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার লেখা পল্লীচিত্র, পল্লীকথা, পল্লীবধূ, পল্লী বৈচিত্র গ্রন্থগুলিতে মেহেরপুর অঞ্চলের মানুষের সমাজ জীবন সংস্কৃতির গভীর ছাপ রয়েছে। জগদীশ্বর গুপ্ত, মুন্সী জমিরুদ্দীন, রেয়াজউদ্দীন আহম্দ প্রমুখের সাহিত্য ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক, শিল্প সৃষ্টির জন্য নয় বরং ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্যই তারা সাহিত্য চর্চা করেছেন। মুন্সী জমিরুদ্দীনের সাহিত্যে ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য শিক্ষা সংস্কৃতি বীরত্ব গাঁথা স্থান পেয়েছে। তার কবিতা গজল অনুবাদ সাহিত্য ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এষড়ৎু ড়ভ রংষধস (১৯২৯) মেহের চরিত (১৩১৫) শোকানল (১৩১৬) কোথা চলি গেলে (১৩০৮) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ১৯ শতকের মুসলিম পুনর্জাগরণের এই অগ্রগন্য মনীষির ছিল প্রখর কাব্য জ্ঞান। নিগমানন্দ সরস্বতী (১৮৮০-১৩৩৭) ধর্ম ও দর্শন চর্চার পাশাপাশি কখনও কখনও সাহিত্য চর্চা করেছেন। সুধাংশুবালা তার বিখ্যাত আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
প্রকশনা শিল্পের উন্মেষকাল সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে মেহেরপুরের দারিয়পুর গ্রাম থেকে নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনী, মুখপাত্র হিসেবে সতীশচন্দ্র বিশ্বাসের সম্পাদনায় শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা সাধক প্রকাশিত হয়। মেহেরপুরে শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রগন্য ভূমিকা রেখে চলেছে ভৈরব সাংস্কৃতিক চত্বর এর মুখপাত্র স্রোত (১৯৭৮)।
মেহেরপুরের কবিগান ও ভাবরসের অমৃতকথা:
বাঙলা সাহিত্য ইতিহাস (১৭৬০-১৮৩০) কবিগান ও পালাগানকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় অন্ধকারের পদাবলী’। এ অধ্যায়ে বাঙালীর জীবনে নেমে আসে অবক্ষয় আর ভ্রষ্টতার গভীর অন্ধকার। আর এ অন্ধকারের যুগে কবিয়ালরা অযংযত ভাবালুতা, খিস্তি খেউড়, শ্লীল-অশ্লীল ভাবরস পরিবেশনের মাধ্যমে যে সাহিত্যধারা সৃষ্টি করেন তা কবিগান নামে পরিচিত। কবিগান সাঙ্গিতিক কুশলতা ও নৈপুন্য দেখিয়ে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, কেষ্টমুচি, হরিঠাকুর অন্যতম। বাঙলা সাহিত্যের সে যুগকে কবিয়াল ও পালাকারদের যুগ বলা হয়। যেযুগে মেহেরপুর অঞ্চলে অসংখ্য কবিয়াল ও পালাকারদের আর্বিভাব হয় যারা আসরে আসরে গান গেয়ে বেড়াতো। এদের গানের খাতা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়নি; করা হলে মেহেরপুরের লোক সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হতো। মেহেরপুর পালাগান ও কবিগানকে করার ক্ষেত্রে যে সকল চারণ কবি ও গায়েন অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা হলেনঃ গোফুর মুন্সী (১৮৮১-১৯৪০), ওলিদাদ মুন্সী (১৯০৪-১৯৮৬), আকালী বিশ্বাস (১২৯০-১৩৫৫ বঙ্গাব্দ), রামেশ্বর দাস (১২০৫-১৩০০ বঙ্গাব্দ), দায়েম বিশ্বাস (১৩০৪-১৩৯৪) প্রমুখ। এদের মধ্যে সুগায়ক ছিলেন আকালী বিশ্বাস, ওলিদাদ মুন্সী ও দায়েম বিশ্বাস। এ কবিয়াল ও পালাকারদের গান আজও মেহেরপুরের গ্রামে-গঞ্জে মুখে মুখে ফেরে।
মেহেরপুর স্থাপত্য শিল্প ও পুরাকীতিঃ
মেহেরপুর জেলায় হিন্দু বৌদ্ধযুগের প্রতœনির্দশন না থাকলেও জেলায় বিভিন্ন স্থানে পাল-সেন যুগের প্রতœনিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। মেহেরপুর শহর থেকে ৮ কিঃমি দক্ষিণে আমদহ গ্রামের স্থাপত্য কীর্তির ধ্বংস বিশেষ হিন্দুরা বৌদ্ধযুগের বলে বাঙলাদেশের প্রতœসম্পদ গ্রন্থের লেখক আবুল কালাম মোঃ জাকারিয়া মনে করেন। প্রায় এক বর্গ কিঃ মিঃ আয়তনের এই প্রতœস্থানের চারিদিকে এক সময় পরিখা ছিল। কিন্তু পরিখার বেস্টনীতে কোন প্রাচীর ছিল না। আমদহের এই স্থাপত্যকীর্তি ধ্বংসাবিশেষকে গোয়লা চৌধুরীদের সাথে বর্গী দস্যুদের যুদ্ধেধ্বংস প্রাপ্ত বাসগৃহ বলে মাসিক পত্রিকা সাধক এর ১৩২০ (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামে নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬-১৬০৭ সালে সাতটি শিবমন্দির ও তার কাছেই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৭২৮ সালে প্রকাশিত ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিতং পুঁথিতে মন্দিরটি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। বল্লভপুর গ্রামের মধ্য পাড়া একবিষা পরিমাণ অপেক্ষাকৃত উঁচু জমির উপর সাতটি শিবমন্দির ছিল। এই মন্দিরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানটি এখন পোড়ামাটির টালি ইটে পরিপূর্ণ। এক সময়এর চারিদিকে প্রাচীর ছিল; কিন্তু এখন তা আর নেই। আবুল কালাম যাকারিয়া’র বাংলাদেশের প্রতœ সম্পদ গ্রন্থে বলা হয়েছে। মন্দিরটি এমনভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যে, এর আকার ও আয়তন সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে ধারনা করা হয় বর্গাকৃতি এ মন্দিরের আয়তন ছিল ১৬ ফুট দ্ধ ১৬ ফুট। এর চারিদিকে ছিল বারান্দা’। শ. ম. শওকত আলী কুষ্টিয়ার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেনঃ বল্লভপুর মন্দির নানা আকারে টেরাকোটা ইট দ্বারা তৈরী। অধিকাংশ ইটে সিংহ; বাঘ; হাতি; প্রভৃতি জীব জন্তু এবং পদ্ম নৃত্যরতা যুবতী প্রভৃতি চিত্র অংকিত। প্রতœতত্ববিদ ও ইতিহাসবেত্তারা বল্লভপুরের এ মন্দিরকে শিবমন্দির হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন;এটি বৌদ্ধ মন্দির কিংবা নাথ যোগি সম্প্রদায়ের উপাসনালয় নয়; এটি ছিল হিন্দু শিবমন্দির। ক্রিশ্চিয়ান অধ্যুষিত বল্লভপুর গ্রামে একটি গীর্জা রয়েছে এ গীর্জাটি ১৮৩২ সালে জার্মান ধর্মযাজক জিগিং জিনস্কি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। গীজার সামনে সমাহিত করা হয় মিসনের পাদরী হেনরী উইলিয়াম কে। সমাধি এপিটাফে লেখা আছে ওহ ঃযব সবসড়ৎু ড়ভ ঐবহৎু ডরষষরধসং/অ ঝবৎাধহঃ ড়ভ লবংঁং পযৎরংঃ/ ধহফ নৎড়ঃযবৎ ড়ভ ঃযব.
কবি ভারতচন্দ্র রন্তনাকর অন্নদামঙ্গলে লিখেছেনঃ
ধন্য ধন্য পরগনা বাগোয়ান গ্রাম
গাঙ্গিনীর পুর্বেকুলে আন্দুলিয়া গ্রাম
তাহার পশ্চিম পারে বড় গাছি গ্রাম
যাহে অন্নদার দাস হরিহোর নাম।
এই গ্রামে দরবেশ জাহান আলী সমসময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ ফরিদের দরগাহ। এ ছাড়া রয়েছে জমিদার হরেকৃষ্ণ সামাদার নির্র্মিত আটচলা ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য মন্ডিত মন্দির। মন্দিরটি সম্পর্কে ড. ইরফান হাবিব ুাঁর ধহ ধঃষধং ড়ভ সঁমযধষ বসঢ়রৎব; ঢ়ড়ষরঃরপধষ ধহফ বপড়হসরপ সধঢ়ধ রিঃয ফবঃধরষবফ হড়ঃবং, নরনষরড়মৎধঢ়যু ধহফ রহফবী. গ্রন্থে অনেক তথ্য প্রদান করেছে।
মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায় ভৈবর নদীর তীরে বলরাম হাড়ি প্রবর্তিত লৌকিক গৌর্ম বলরামি সম্প্রদায়ের প্রাণকেন্দ্র। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে লালন শাহের সমসাময়িক এই লৌকিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এই ধর্মের প্রাণ পুরুষ অন্ত্যজ নেতা বলরাম হাড়ির ভাবাদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বিপুল সংখ্যক অন্ত্যজ, ব্রাত্য-মন্ত্রহীন মানুষ দীক্ষা গ্রহণ করেন। যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাযার্যের ‘ঐরহফঁ ঈধংঃষবং ধহফ ঝবপঃং’(১৮৯৬খ্রিঃ) গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বলরামী সম্প্রদায়ের অনুসারীদের সংখ্যা বিশ হাজার।
১২৫৭ বঙ্গাব্দের ৩১ শে অগ্রহায়ণ তিরোধানের পর বলরামের তার মালোপাড়ার আখড়ায় সমাহিত করা হয় এবং ৩৫ শতক জমির উপর নির্মাণ করা হয় অংকরণহীন আটচালা সমাধিমন্দির। সিমেন্ট দ্বারা নির্মিত বগাকৃতির (১৫ফুট ী ১৫ফুট) এই মন্দিরের গর্ভগৃহের আয়তন ৮ফুট ী ৮ফুট। এই মন্দির প্রাঙ্গনে বারুণী তিথিতে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মেহেরপুর শহরে রয়েছে রাজা গোয়ালা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ১৮ শতকের আটচালা শিবমন্দির। মন্দিরটি বর্তমানে নিগমানন্দ সরস্বতী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত সারস্বত আশ্রম হিসেবে কাজ করছে।
পাল-সেন, মোঘল এবং ইংরেজ আমলে স্থানীয় ভূস্বামী, অমাত্যবর্গ, রাজকর্মচারী, ফকির দরবেশ এবং খৃষ্টান মিশনারীদের উদ্যোগে মেহেরপুরের গ্রামে গঞ্জে স্থাপত্যশিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। স্টাইল, অলংকরণে এ অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্যের সাথে হিন্দু স্থাপত্য শিল্পের পার্থক্য রয়েছে বিস্তর, তথাপী মিল রয়েছে অনেক। মসজিদের সাথে মন্দিরের সাদৃশ্য এড়ানোর জন্য মন্দির নির্মাতার গম্বুজবর্জন করলেও বাংলা চালাঘরের স্টাইলকে বর্জন করেননি। মুসলিম ও হিন্দু স্থপতিরা বাংলা চালাঘরের আদলেই মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ করেছেন। একারণে মেহেরপুর বাজারের শাহ ভালাইয়ের দ্বিতীয় দরগাহ এবং পুরাতন পোষ্ট অফিস পাড়ার মা বরকতের দরগাহকে কাঠামো ও আয়তনগত দিক দিয়ে মন্দির থেকে আলাদা কিছু ভাবা যায় না। বঙ্গীয় অলংকরণ ও স্টাইল হিন্দু স্থাপত্যের মত মুসলিম স্থাপত্যকেও প্রভাবিত করেছে। ইংরেজ আমলে নির্মিত বল্লভপুর চার্চ (১৮৪৭খ্রিঃ), ভবরপাড়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ (১৯২৪ খ্রিঃ) এর নির্মাণশৈলীতেও পাশ্চ্যতারীতি অনুসরণ করা হয়নি। এতে দেশীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়। তবে প্রযুক্তি ও স্টাইলে ইউরোপীয় স্থাপত্য শিল্পের প্রভাব ছিল।
মরমি ভাবনায় মঙ্গল প্রদীপ ও মেহেরপুরঃ
নদীয়া আউল বাউল, ফকির-বৈষ্ণবদের দেশ। এই অঞ্চল মরমী সাধনার তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। পন্ডিতদের অভিমত বাউল মতাদর্শের উৎপত্তি এ অঞ্চলেই। বৃহত্তর নদীয়ার মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার বাউল-বৈষ্ণবদের সংখ্যা উল্লেখ করার মত। লালন শাহ, গগন শাহ, গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল এর সাধন ক্ষেত্র কুষ্টিয়া। আর চাঁদপতি, আরজান শাহ, আজাদ শাহ, আজমত শাহ, ঝড়– শাহ, গবীবুল্লাহ শাহ, কলিমুদ্দিন শাহ, আতাহার শাহ’র মত বাউল সাধকদের নিবাস ও সাধনক্ষেত্র হল মেহেরপুর। কুষ্টিয়া মেহেরপুর থেকেই বাউলের প্রেম ও ভক্তিময়তার বাণী পার্শ্ববতী জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বাউল মতবাদের বিকাশ ঘটে। আমাদের সংস্কৃতি ও জাতি সত্তার স্বরূপ এবং আতœপরিচয়ের সন্ধান পেতে লালন-হাসন-গগনদের যেমন চিনতে হবে তেমনি জানতে হবে মেহেরপুরের বাউল- বৈষ্ণবও পালাকারদের। কারণ শত শত বছর ধরে তারাই জ্বেলেছেন আমাদের শিল্প সংস্কৃতি ও ভাবুকতার সহস্র প্রদীপ।
মেহেরপুরকে আবিষ্কার করতে হলে অখন্ড নদীয়ার রাজনীতি, সমাজনীতি, প্রাচীন ইতিবৃত্ত শিল্প সাহিত্য চর্চা, ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কারণ নদীয়ার নবদ্বীপে সরস্বতীর সিংহাসন। এখানেই একদিন জ্বলেছিল ধর্ম, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য ও জ্যেতিষশাস্ত্রের মঙ্গলপ্রদীপ, আর তা আলোকিত করেছিল মেহেরপুরকে। নবদ্বীপের সাথে মেহেরপুরের সস্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। নবদ্বীপ একদিন বাঙালীকে প্রেম ও ভক্তিরসে সিক্ত করেছিল আর একাত্তরে মেহেরপুরের মুজিবনগর, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালীকে সংগঠিত করেছিল মেহেরপুরের শিল্প সাহিত্য ইতিহাস ঐতিহ্যের উৎস সন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অখন্ড নদীয়ার গৌরবময় ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায়ে। কারণ নদীয়ার সাথে মেহেরপুরের রয়েছে নাড়ীর সম্পর্ক।
আবদুল্লাহ আল-আমিনের লেখা থেকে সংগৃহীত