১৯৭০ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী কড়চা
রুহুল কুদ্দুস টিটো
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকেই বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যবাদ দাবি করে আসছিল। তবে তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রী শাসকবর্গ নানাভাবে তাদেরকে দাবিয়ে রেখেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির সেই স্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয় ঘটে।
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপসহ আইনগত কাঠামাে আদেশ বা এল.এফ.ও (Legal Framework Order-LFO) জারি করে ছিলেন।
সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান :
- সর্বজনীন ভােটাধিকার;
- এক ব্যক্তি, এক ভােট’ নীতি;
- প্রত্যেক প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রের জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা বন্টন।
জাতীয় পরিষদের গঠন সংক্রান্ত বিধান :
- জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩ নির্ধারণ;
- এলাকাভিত্তিক সাধারণ আসন সংখ্যা ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৩ নির্ধারণ;
- জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রের আসন সংখ্যার বণ্টন :
পূর্ব পাকিস্তান | ১৬২+৭ =১৬৯ |
পাঞ্জাব | ৮২+৩ = ৮৫ |
সিন্ধু | ২৭+১ = ২৮ |
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল | ২৫+১ = ২৬ |
বেলুচিস্তান | ৪+১ = ০৫ |
১৯৭০ সালের নির্বাচনই স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদগুলাের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘােষণা করা হয়। কিন্তু উক্ত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় নি। পরে তা যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। ইতােমধ্যে ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে আকস্মিক এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে ঐ সব এলাকার নির্বাচন পিছিয়ে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১-এ নেওয়া হয় এবং যথারীতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বেশকিছু নির্দলীয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দু’ডজনের মতাে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক দলগুলাে হচ্ছে: আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পাটি (পিপিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াত-ই-ইসলামি, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, নিজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি (পি.ডি.পি.) ইত্যাদি।
এর মধ্যে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পাটি। তবে এ নির্বাচনের উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, কোন রাজনৈতিক দলই এলাকাভিত্তিক ৩০০টি আসনের সব কটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করেনি। উপরন্তু পূর্ব বাংলার এক সময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী) ‘ভােটে মুক্তি আসবে না’ শ্লোগান তুলে নির্বাচন বয়কট করে।
নির্বাচনী ফলাফল
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ টি জাতীয় পরিষদের এলাকা ভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন এবং প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৭২.৫৭ ভাগ ভােট লাভ করে। বাকি ২টি আসনের মধ্যে একটিতে জয়লাভ করেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন এবং অপরটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়।
জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনের সব কয়টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সর্বমােট ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের মােট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে।
প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৮৯ ভাগ আওয়ামী লীগের অনুকূলে যায়। অন্যান্য ১২টি আসনের ৯টিতে জয়লাভ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি এবং একটিতে জামায়ত-ই-ইসলামি জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের সব কয়টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। অপরদিকে, জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলাকা ভিত্তিক আসনের মধ্যে ৮৩টি আসনে জয়লাভ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি বা পিপিপি। হিসেব অনুযায়ী প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৪২.২ ভাগ ভােট পিপিপি-র অনুকূলে পড়ে। বাকী ৫৫টি আসনের ৯টিতে মুসলীম লীগ (কাইউম খান), ৭টিতে মুসলীম লীগ (কাউন্সিল), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-ইসলাম, ৬টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-ইসলাম, ৪টিতে জামায়াত-ই-ইসলামি, ২টিতে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এবং ১৩টিতে নির্দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করে।
পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের ৫টিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং ১টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান) জয়লাভ করে। মহিলা আসনসহ পাকিস্তান পিপলস পার্টির মােট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও পিপিপি আঞ্চলিক প্রাধান্য লাভ করে। ফলে উভয় দলই এককভাবে কোনো অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব করার বৈধতা হারায়। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তান শাসন অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়াকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যদি ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফল মেনে নিলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।
পাকিস্তানের শাসকদের মেনে না নেয়ায় তৎকালীন পাকিস্তানের কাঠামোয় অনুষ্ঠিত ’৭০-এর শেষ নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নির্বাচিত লোকদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে তাতে ১৯৭২-এর সংবিধান পাস করা হয়।
বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে আন্দোলন করে আসছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ দাবি অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায় বাঙালির ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সভা ও এটি এক কক্ষ বিশিষ্ট। এ আইন সভার জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৩০০ জন সংসদ সদস্যকে নির্বাচিত করা হয়। এছাড়াও ৫০ জন মহিলা সংসদ সদস্য সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যরূপে মনোনীত হন। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের প্রধানমন্ত্রীই হলেন সরকার প্রধান। রাষ্ট্রের প্রধান হলেন একজন রাষ্ট্রপতি যিনি জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পদ হলো আনুষ্ঠানিকতা, প্রকৃতপক্ষে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সরকার প্রধানের হাতে।
১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে দুই রাজনৈতিক দল কেন্দ্রিক নির্বাচন শুরু হয়েছে অর্থাৎ দুটি রাজনৈতিক দলই দেশের সকল প্রকার নির্বাচনের মূলে থাকে এবং বাকী দলগুলোর জন্য এককভাবে নির্বাচন করে সরকার গঠন করা অনেক কঠিন।
- প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৩, বাংলাদেশে ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
- দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯, বাংলাদেশে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
- তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৬, বাংলাদেশে ৭ই মে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
- চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৮ বাংলাদেশে ৩রা মার্চ ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
- পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯১, বাংলাদেশে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশে এ নির্বাচনের মাধ্যমেই একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা উপহার পায়।তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এটি ছিল প্রথম নির্বাচন।
- ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল।
- সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন জুন, ১৯৯৬, জুন ১২, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়।নির্বাচনে দুটি প্রধান দল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিল শেখ হাসিনা; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বে ছিল খালেদা জিয়া।
- অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১, অক্টোবর ১, ২০০১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দুটি প্রধান দল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিল শেখ হাসিনা; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বে ছিল খালেদা জিয়া।
বাংলাদেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮ সালে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ-এর নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের অধীনে। সামরিক সরকার ২০০৭ সালের শুরুর দিকে জরুরী অবস্থা জারি করে যা ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তুলে নেওয়া হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এবং এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ বাংলাদেশে ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনটি নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও সতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এছাড়াও নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটের মাধ্যমে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ বাংলাদেশে ৩০ শে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন লাভ করে বিজয় অর্জন করে।
২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সরকারের অধীনে স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এই নির্বাচনে ১৪টি দলের এক হাজার ৯১ জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ শুরুতেই ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। বাকি ২৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক কোটি ৯৩ লাখ বা ৫৫ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে এক কোটি ৩৮ লাখ বা ৭৩ শতাংশ ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ ২৮২ আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ ভেঙে সিরাজুল আলম খানের তৈরি করা জাসদ ২৩৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সোয়া ১২ লাখ বা ৬.৫২ শতাংশ ভোট আর একটি আসন পায়। আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ পায় একটি আসন। ১২০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ৫ শতাংশ ভোট ও পাঁচটি আসন লাভ করে।স্বাধীন দেশে প্রথম সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনেই ১৯৭৩ সালে ভোট কারচুপির ব্যাপক অভিযোগ ছিল।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি টেকনিক্যালগণভোটে তার ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য জনসমর্থন চান। টেকনিক্যাল গণভোটে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে বলে সরকারি বার্তা সংস্থা প্রচার করে। ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসন থেকে সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রপতি পদে উত্তরণের জন্য জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের হয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থপতি জেনারেল (অব:) ওসমানী এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে। এ নির্বাচনে ভোটার হাজির হয় ৫৪ শতাংশ। জিয়াউর রহমান নিজ পক্ষে দেয়া ৭৭ শতাংশ ভোট পান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পর জিয়াউর রহমান রাজনীতিক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন।
বিরোধী দল সজ্জিত সংসদ
১৯৭৯ সালের এ নির্বাচনে তিন কোটি ৮৩ লাখ ভোটারের মধ্যে এক কোটি ৯৭ লাখ ভোটার বা ৫০ শতাংশ ভোট দিয়েছিল বলে হিসাব আছে।২৯টি দলের দুই হাজার ১১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি লাভ করে ২০৭টি।
আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৯টি আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ (মিজান) শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দু’টি আসন পায়, মুসলিম লীগ ও আইডিএল ২৬৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১০ শতাংশ ভোট এবং ২০টি আসন পায়।
জাসদ ২৪০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫ শতাংশ ভোট ও আটটি আসন পায়। ন্যাপ (মো:) কুঁড়েঘর নিয়ে সোয়া ২ শতাংশ ভোট ও একটি আসন, একতা পার্টি একটি আসন লাভ করে।৪২২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০ শতাংশ ভোট ও ১৬টি আসন পান। সব মিলিয়ে এটাই ছিল প্রথম বড় বিরোধী দল সজ্জিত সংসদ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা হত্যা করে। জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়।
১৯৮১ সালের নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে। এ ভোটের সাড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাত পোহাতেই সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতার আসনে বসেন ।
এরশাদ তার ক্ষমতার বৈধতার জন্য নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ভোট কারচুপিতে ধীমান এ প্রেসিডেন্ট সব রেকর্ড ভঙ্গ করেন। তিনি ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিলেন ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। তাতে তার সরকারের বিরুদ্ধে তেজি রাজনৈতিক বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। তিনি এই বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্যও নির্বাচনের ভাবনা জোরদার করেন। ধরে নিলেন বিক্ষোভের একাংশ তাকে সংসদ নির্বাচন করতে বলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তখন বড় দুই রাজনৈতিক দল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন চাইলেন। এরশাদ কিছু কনসেশন দিয়ে ২৬ এপ্রিল নির্বাচনের দিন স্থির করলেন।
রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, এমন ঘোষণা প্রকাশ্যে দিলো। কিন্তু হঠাৎ করে এক রাতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে । নির্বাচনে অংশ নিলো জামায়াত। বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও বাম ধারার পাঁচ দল ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জন করে।
এ নির্বাচন এরশাদের ক্ষমতার জন্য কাল হয়ে উঠে। সুখের সংসদ ছেড়ে বিরোধী দল বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় ১৯৮৭ সালে। বেরিয়ে আসার আগে একটা পার্লামেন্টারি ক্যু ঘটানোর চেষ্টা চলে। ১৯৮৭ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে।
১৯৮৭ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে হরতাল, অবরোধ ও বিক্ষোভের মুখে এরশাদ বিরোধী দলের দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে স্বগৃহে অন্তরীণ করেন। ১৯৮৭ সালের ২৭ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দিয়ে এরশাদ সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগ বন্ধ করেন। এ সময় ঘোষিত হয়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এবার এরশাদের কৌশল ব্যর্থ হয়। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।
১৯৮৮ সালের বন্যা এরশাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরশাদ-পতন আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ৯ বছরের মহান শাসন ত্যাগ করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০-এ পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে সামরিক সরকার, রাজনৈতিক সরকারের পর বিচারপতি-অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীদের একটা সরকার দৃশ্যপটে আসে। যদিও সেটি পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ছিল না। শুধু নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ও প্রশাসক সাহাবুদ্দীন আহমদের দক্ষ প্রশাসনের অধীনে সম্পন্ন হয় ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রকৃতপক্ষে এ নির্বাচনে কেয়ারটেকারের আবির্ভাব ঘটে এবং ১৯৯৬ সালের একতরফা সংসদ তাকে স্থায়ী করে যায়।
১৯৯১ সালের সংসদে ৭৬টি দল দুই হাজার ৩৫০ জন প্রার্থী দাঁড় করায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪২৪ জন। ৩০টি মহিলা আসন থাকায় জামায়াত দুই আসনের বিনিময়ে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৫টি আসন পায়। এরশাদ ও খালেদা পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ফল আসে নিম্নরূপ- বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাপা ৩৫, জামায়াত ১৮, সিপিবি ৫, বাকশাল ৫, স্বতন্ত্র ৩, ন্যাপ (মো:) ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, জাসদ সিরাজ ১, ইসলামী ঐক্যজোট ১ ও এনডিপি ১।
মোট ভোটের ১৭ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে বিএনপি ৪৭ শতাংশ আসন পায়। মোট ভোটের সাড়ে ১৬ ভাগ, প্রদত্ত ভোটের ৩০ ভাগ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশের কিছু কম আসন পায়। মোট ভোটের সাড়ে ৬ ভাগ এবং প্রদত্ত ভোটের ১২ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে জামায়াত ছয়টি আসন পায়। এ নির্বাচনে ৫৫ ভাগ ভোটার ভোট দেয়। ছয় কোটি ২২ লাখ ভোটের মধ্যে বৈধ প্রদত্ত ভোট দাঁড়ায় তিন কোটি ৪১ লাখ। বিএনপি পায় এক কোটি পাঁচ লাখ ভোট; আওয়ামী লীগ এক কোটি দুই লাখ ভোট; জাতীয় পার্টি সাড়ে ৪০ লাখ এবং জামায়াত সাড়ে ৪১ লাখ ভোট পায়।
১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে পাস হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়। জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তির ভোট বিভাজন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ অনেকটা সহজ করে দেয়। এ নির্বাচনে আমলা-কামলা-এনজিও সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, সেকুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এরা সবাই আওয়ামী লীগকে সহায়তা প্রদান করে।
ভোটের ফল আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬ আসন, বিএনপি ৩৩.৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১১৬ আসন, জাতীয় পার্টি ২৯৩ আসনে নির্বাচন করে ১৬.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২ এবং জামায়াত ৮.৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩ আসন পায়।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২৫২ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬২ আসন, জাতীয় পার্টি ২৮১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৭.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪ আসন, জামায়াত ৩১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭ আসনে বিজয়ী।
কেয়ারটেকার সরকার এ নিয়ে যখন মারামারি, রক্তারক্তি, দেশী-বিদেশী একটি মহল রাজনীতি নির্বাসনে পাঠানোর আয়োজন করে। বাতিল হয়ে যায় ২২ জানুয়ারির নির্বাচন। নির্বাচিত শাসক, সামরিক শাসক, তত্ত্বাবধায়ক শাসকের পর বাংলাদেশের মানুষের সামনে এবার আসে সেনাসমর্থিত অভিনব শাসক। এ সরকার চেয়েছিল হাসিনা-খালেদাদু’জনই চলে যাক।
হাসিনা-খালেদা গ্রেফতার হয়েছিলেন। খালেদার ছেলেদেরও ধরা হয়। হাড়হাড্ডি ভাঙার অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে।সেনাসমর্থিত অভিনব শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে।আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নির্বাচনের চাপ আসতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক শাসকদের উপর।
আন্তর্জাতিক চাপে অবশেষে ঘোষণা আসে বছরের একেবারে শেষে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন।
জোট আর মহাজোটের এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছিল আওয়ামী লীগের জোট শরিক। অপর দিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। খালেদা জিয়া প্রথমে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি ছিলেন না। জোটসঙ্গী জামায়াতের চাপে রাজি হন। কারণ, তার দল ছিল তখন পর্যুদস্ত। দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা দল ছেড়ে সংস্কারপন্থী বনে যান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৫৯ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির ভাগ্যে জোটে ৩০ আসন। ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টি ২৭ আসন। ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াত দুই আসনে বিজয়ী হয়। রাজনৈতিক আহসানুল হক ইনু ও বাদলের মশাল মার্কা নিয়ে তিন আসনে জয়লাভ করে।২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার আদালতের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে শেখ হাসিনা সরকার। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কৌশল নেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে এরশাদও ছিলেন।
এই সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।