১৯৭১ চট্টগ্রাম থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ ছিল মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের
রুহুল কুদ্দুস টিটো
জাতীয় পরিষদ সদস্য ছহিউদ্দীন বিশ্বাসের পরামর্শ ক্রমে মহাকুমা প্রশাসকের পক্ষে ১৯৭১ এ ৫ই এপ্রিল মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের ভারত গিয়েছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে মেহেরপুর থেকে এডভোকেট আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল কলকাতা গিয়েছিলেন।।
জাতীয় পরিষদ সদস্য ছহিউদ্দীন বিশ্বাসের পরামর্শ ক্রমে মহাকুমা প্রশাসকের পক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমান একটি বিশেষ পত্র লিখে তো প্রতিনিধি দলের হাতে দেন। পত্রটি ভাষা ছিল
This is a request in the name of swadhin Bangladesh government that all sorts of facilities and help may kindly be extended to the under-mentioned persons who representatives swadhin of Bangladesh. They are authorised to negotiate any sort of material help for the Shad in Bangladesh in its struggle.
অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও নাট্য ব্যক্তিত্ব কামাল আহমেদ, অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান ও প্রকৌশলী আব্দুল সোবহান (তৎকালীন ওয়াপদা আবাসিক প্রকৌশলী)। এরা সকলেই মেহেরপুরের শক্তিশালী নাট্য অভিনেতা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
মেহেরপুরের মুসলিম লীগ নেতাদের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের নাট্যরূপ দিয়ে কামাল আহমেদ এদের সবাইকে নিয়ে প্রভাষ ভট্টাচার্যের বাড়িতে একটি নাটকের নিয়মিত মহড়া চালান। ‘ সংগ্রাম সংগ্রাম’ নামের সেই নাটক মঞ্চায়নের কথা ছিল ২৬ মার্চ। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হবার পরও অনিবার্য কারণেই সে নাটক মঞ্চস্থ হতে পারেনি। তারপর এই নাটকে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
কুষ্টিয়া যুদ্ধের সাফল্যের পর এই চারজন অন্যরকম কিছু একটা করার কথা ভাবেন ৫এপ্রিল কলকাতা যাবার পর জল্লাদের দরবারের খ্যাতিমান অভিনেতা বাবুয়া বোসের ভাই কাকুয়া বোসকে সঙ্গে নেন।
কাকুয়া বোস মেহেরপুরের এ কৃতি সন্তানের ততদিন কলকাতার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঢের পরিচিতি এসেছে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের এই প্রতিনিধি দলকে ৬ এপ্রিল নিয়ে যান আনন্দবাজার এবং অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে। সেখানে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ভারতীয় জনমত গঠন সাংবাদিকদের বিশেষ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। দুটি পত্রিকার পক্ষ থেকেই আন্তরিক আশ্বাস দেয়া হয় এবং ইতিমধ্যে তাদের কাগজে জয় বাংলার খবর বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছে বলে অবহিত করা হয়।
এরপর স্বাধীন বাংলার প্রতিনিধি দল হুগলিতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অবধূত- এর সঙ্গে দেখা করলে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে তার গুরুদেব সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরামর্শ দেন এবং সংক্ষিপ্ত একটি পত্র লিখে দেন-’গুরুদেব, জয় বাংলার ভাইদের প্রণাম গ্রহণ করবেন।’ পরদিন তারা সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশের অবস্থা অবহিত করেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য কামনা করে আশীর্বাদ জানান।
৮ এপ্রিল প্রতিনিধিদল কলকাতার উপকণ্ঠে বেহালায় গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে সবাইকে অর্ভথনা জানান। বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে তার সদ্য প্রকাশিত ’পদ্মা আমার গঙ্গা আমার’ কাব্যগ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে উৎকীর্ণ বাণী টুকু পাঠ করে শোনান। সেখানে লেখা রয়েছে:
রবীন্দ্রনাথকে নজরুলকে আমরা খন্ড করে ভাবতে পারিনা। দুই বাংলা নয়, এক বাংলায় আমাদের চিত্রলক্ষে প্রতিষ্ঠিত। বিবেকের সমস্ত প্রাচীর কে তুমি স্বাদ করতে, স্বার্থপর আমরা রাজনৈতিক দের লোক চরিতার্থতার সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে, বাংলা তারুণ্য আজ বদ্ধপরিকর।
সর্বশেষ পদ্মা আমার গঙ্গা আমার কাব্যের প্রথম পাতায় আমার বাংলাদেশের ভাইদের হাতে বাক্যটি লিখে তার নিচে স্বাক্ষর করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেন।
প্রতিনিধি দল সিপিআইএম অফিস গিয়ে জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নানাবিধ সাহায্য সহযোগিতার কথা তুলে ধরলে তিনি আশ্বাস দেন তবে এই যুদ্ধের ভিন্ন দিকের কথা উল্লেখ করে তিনি সাবধানের সকল পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
৯ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল কলকাতার ফিলিপস ইন্ডিয়া ঊর্ধ্বতনকর্মকর্তা ভাস্কর বাবুর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের তথ্য প্রচারের জন্য একটি ট্রান্সমিটারের আবেদন জানান। ভাস্কর বাবু দিল্লি সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটার দেয়ার আশ্বাস দেন এবং জানতে চান- এটি কোথায় স্থাপন হবে। প্রতিনিধি দল বলেন, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে এবং সেটা মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী কোন এলাকায়। অতঃপর ভাস্কর বাবু কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব এবং যোগাযোগ মাধ্যম উল্লেখ করে প্রস্তাবিত স্থানের একটি ম্যাপ সহ সপ্তাহখানেক পর পুনরায় যোগাযোগ করতে বলেন।
চট্টগ্রাম থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ।
ফিলিপস ইন্ডিয়া এর কাছ থেকে আশ্বাস লাভের পর এই প্রতিনিধি দল বেতার প্রতিষ্ঠার নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন রকম পরিকল্পনা আঁটেন, কিন্তু মেহেরপুরে ফিরতে তাদের আরো দুদিন বিলম্ব হয়।
পরদিন ১০ এপ্রিল জাতীয় জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান প্রতিনিধি দল। নির্বাক কবিকে পুষ্প-গুচ্ছ দিয়ে তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ধর্ষণের থেইকা সকলে মেহেরপুর থেকে এসেছেন জানতে পেরে কবিপত্রগুলো ওমা গাজী অত্যন্ত উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন। মেহেরপুরে কবি নজরুলের নামে একটি (স্কুল কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল, যেখানে পাঠশনের আস্তানা তৈরি করে অপবিত্র করেছে) প্রতিষ্ঠার পথ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য কবি পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং স্কুলটির খোঁজখবর জানতে চান।
১২ এপ্রিল প্রতিনিধি দল মেহেরপুর এসে দেখতে পান। পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। সর্বত্র থমথমে ভাব বিরাজ করছে।
জাতীয় পরিষদ সদস্য ছহিউদ্দীন বিশ্বাস এবং মহাকুমা প্রশাসক তৌফিক ইলাহী চৌধুরী প্রতিরোধ যুদ্ধ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। প্রতিনিধি দল ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমানকে সব খুলে বললেও সেই উদ্বেগ জনক সংকটময় সময় বেতার কেন্দ্রের জন্য স্থান নির্ধারণ বা এই সংক্রান্ত আর কোন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। মেহেরপুরের এই ছোট্ট সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে হয়তো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য ২৫ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।
তথ্যসূত্র:মেহেরপুর জেলার ইতিহাস-রফিকুর রশিদ