১৯৭১ মার্চ- এপ্রিল মেহেরপুরের উত্তাল ৪৮ দিনের একটি ঐতিহাসিক দিন ১৭ এপ্রিল
বীর বাঙ্গালী প্রভাষক বাকের আলী তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত
ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কীসের সভা, কী উদ্দেশে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা…
আলাপচারিতা
বাকের আলী মেহেরপুর কলেজের ইন্টামিডিয়েট প্রথমবর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি বৈদ্যনাথতলা থেকে পৌনে এক মাইল দূরে মহিষনগর বর্তমানে গৌরিনগর দক্ষিণ পাড়া। বৈদ্যনাথতলায় যখন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়, তখন বাকেরও অন্যদের মতো জয় বাংলা ধ্বনি তুলে সরকার গঠনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী তাকে মাইক দিলেন কোরআন তিলাওয়াতের জন্য। সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করলেন বাকের আলী।
১৭ এপ্রিলের পর মুজিবনগর আক্রান্ত হয় পাকবাহিনীর হাতে। বাকের আলীকে পাকড়াও করে পাক সেনারা এরপর তাদের হাত থেকে তিনি মুক্ত হন তিনি কি ভাবে মুক্ত হন তিনি তাঁর মুখ থেকে শুনবো আলাপচারিতায় আগামী বুধবার ৩০ মার্চ ২০২২
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
আর সেই অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন ১৭ বছরের এক কিশোর মো. বাকের আলী। যিনি বেশ কয়েক বছর আগে কলেজ শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। সেদিন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি এই দায়িত্বটি পালন করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে।
বাকের আলী তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশ আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিহারী অধ্যুষিত দর্শনায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ১৬ এপ্রিল বিকেলে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে আসেন।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কীসের সভা, কি উদ্দেশ্যে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা। সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পায়ে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার স্কুল শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন স্যার সেখানে ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে এ অনুষ্ঠানে কুরআন পাঠ করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাকের আলীর শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন বলেন, ‘বাকের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুললিত কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতো। এ ছাড়াও সে ছিল ধর্মভীরু। তাই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাকেই টেনে নিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, সেই সময় তিনি দরিয়াপুর মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর ভবেরনগর, সোনাপুর, মানিকতলা, মাঝপাড়াসহ পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তিনি ছিলেন সেই সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। আর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় ছিল এই সংগ্রাম কমিটি।
বাকের আলী সেদিনের অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে বলেন, প্রথমে ভয় পেলেও স্যারের হাত ধরে মঞ্চের কাছে গিয়ে দেখেন সেখানে বসে আছেন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ক্যাপটেন এম মনসুর আলী এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাকেরের নাম একটি কাগজে লিখে বললেন, ‘বাবা তোমাকে কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। তুমি আমাদের সাথেই মঞ্চে উঠবে।’ একটু পরেই মাইকে ঘোষণা করা হয় বাকের আলীর কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হবে আজকের এই ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান।
সেই সময়ের অনুভূতি ব্যক্ত করে বাকের বলেন, আমি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছি, দেশ-বিদেশের শত শত সাংবাদিকের ক্যামেরার আলোকচ্ছটায় আমি উদ্ভাসিত।
বাকের আলী তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিহারিধ্যুত -অষিদর্শনায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে দীর্ঘ পথ হেঁটে ১৬ এপ্রিল বিকেলে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে আসি’
বাকের আলী আরও বলেন, “ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কীসের সভা, কী উদ্দেশে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা। সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার স্কুলশিক্ষক দোয়াজ উদ্দিন স্যার সেখানে ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে বলেন, ‘তোকে এ অনুষ্ঠানে কোরআন পাঠ করতে হবে’।”
এ প্রসঙ্গে বাকের আলীর শিক্ষক দোয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বাকের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করত। এ ছাড়া সে ছিল ধর্মভীরু। তাই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাকেই টেনে নিয়েছিলাম।’
সেদিন এই ভূমিকা রাখতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন বাকের। তিনি বলেন, প্রাণের টানে তিনি সেদিন মুজিবনগরে ছুটে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি জানান, মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে মুজিবনগরে যত অনুষ্ঠান হয়েছে তিনিই কুরআন তেলাওয়াত করেছেন।
মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর ২০১৩ সালে বাকের অবসরে যান।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাস করেন। তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে মো. আল মুরাদ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পিতা বাকের আলী কুরআন তেলাওয়াতের সুযোগ পাওয়ায় পুত্র মো. আল মুরাদও গর্বিত।
তবে বাকেরের খোঁজ-খবর কেউ না রাখলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে তাকে ১ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেছিলেন বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও ২০১১ সালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তিনি। গত শনিবার স্বাধীনতা দিবসে ফুলের তোড়াদিয়ে সম্মান জানিয়েছে মুজিবনগর উপজেলা প্রশাসন। – রুহুল কুদ্দুস টিটো