২০১৬ সালে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্ব ব্যাংকিং ইতিহাসে কুখ্যাত এক চুরির ঘটনা ঘটে ।।রিজার্ভ চুরির মূল হোতাদের বাদ দিতে সিআইডিকে ধমক দিয়েছিলেন সাবেক দুই মন্ত্রী
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।পরে বিভিন্ন সময় ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়। কিন্তু এখনো ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত ১৩ জনের গাফিলতি, অবহেলা ও দায় ছিল।রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির তথ্য ১ দিন পর জানতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা ২৪ দিন গোপন রাখে। ৩৩তম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, নিউইয়র্ক আদালত সেই মামলা চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলায় সারবস্তু আছে বলে মনে করছেন নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট। এই পরিস্থিতিতে আরসিবিসি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
ফিলিপাইনের স্টক এক্সচেঞ্জে দাখিল করা এক পত্রে আরসিবিসি বলেছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতের এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরেছে। ফিলিপাইনের গণমাধ্যম এনকোয়ারার ডট নেট এ খবর জানিয়েছে।
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ১৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের মধ্য থেকে ব্লুমবেরি ও ইস্টার্ন হাওয়াই নামে দুটি ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দিয়েছেন নিউইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু মামলা খারিজ হয়নি।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্তে নিউইয়র্ক রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, তিনটি ‘কজ অব অ্যাকশনের’ আইনি ভিত্তি নেই। আরসিবিসি ব্যাংক ও সব বিবাদীর বিরুদ্ধে অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ—এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা প্ররোচনা, জালিয়াতি (আরসিবিসির বিরুদ্ধে), জালিয়াতিতে সহায়তা বা প্ররোচনা—এসব অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।
এ ছাড়া ব্যক্তিগত এখতিয়ার না থাকায় আরও চারজন বিবাদীকে মামলা থেকে খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। তাঁরা হলেন ইসমায়েল রেয়েস, ব্রিজিত ক্যাপিনা, রোমুয়ালদো আগারাদো ও নেস্তর পিনেদা।
তবে নিউইয়র্কের আদালত জানিয়েছেন, আরসিবিসি ও অন্যান্য বিবাদীর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগে মামলা চলতে পারে, যেমন যে অর্থ আরসিবিসিতে গেছে, তা ফেরত দেওয়া। এ বিষয়ে আরসিবিসি জানিয়েছে, আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা ভেবে দেখা হচ্ছে।
১৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আসামি করে মামলাটি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা প্ররোচনা, জালিয়াতি (আরসিবিসির বিরুদ্ধে), জালিয়াতিতে সহায়তা বা প্ররোচনাসহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইফট ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ৩৫টি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালায় অপরাধীরা। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাট করতে সক্ষম হয় তারা। অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যায় দুই কোটি ডলার, যে অর্থ অবশ্য উদ্ধার হয়েছে। তবে বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসি ব্যাংক হয়ে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয় ঢুকে যায়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে; বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনো পাওয়া যায়নি।
২০১৯ সালে ফিলিপাইনের আরসিবিসি, দেশটির ক্যাসিনোসহ ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আর ৩ চীনা নাগরিককে আসামি করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। অভিযোগে বলা হয়, দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামিরা অর্থ চুরি করেছে। তবে মামলার বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট আদালতের এখতিয়ারের বাইরে—এই কথা বলে আরসিবিসিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাল্টা মামলা করেন। মামলাটি খারিজের আবেদনও করেন তাঁরা।
২০২০ সালের ২০ মার্চ দেওয়া রায়ে বলা হয়, মামলাটি টেকনিক্যাল হওয়ায় তা বিচারের জন্য গ্রহণ করা হয়নি, যদিও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা দায়েরের সুযোগ আছে বলেও রায়ে মতামত দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৭ মে নিউইয়র্কের কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টে আরেকটি মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মূল হোতাদের নাম বাদ দিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) চাপ দিয়েছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কিন্তু এতে রাজি না হওয়ায় মাশুল গুণতে হয় সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তাকে। বদলি করা হয় তাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাওয়া হয়ে যায় কর্পুরের মত। কিন্তু সে ঘটনার কোনো কুল কিনারা হয়নি ৮ বছরেও। তবে গেল ২০২০ সালে এই তদন্ত প্রতিবেদনে দেশিয় কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট চূড়ান্ত করে সিআইডি।
তখন তা আটকে দেন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী আনিসুল হক ও আসাদুজ্জামান খান কামাল। রিজার্ভ চুরি নিয়ে এক বৈঠক থেকে তদন্ত কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে বের করে দেয়া। সেই বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা এটি নিশ্চিত করেন।
কেন এভাবে দুই মন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত আটকে দেয়া হয় তা জানা দরকার বলে মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সিআিইডি তদন্ত করেছে। এখন পর্যন্ত ৭৯বার সময় নিয়েছে কিন্তু চার্জশিট দেয়া হয়নি। শোনা যায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাপ দিয়েছিল যেনো কোনো চার্জশিট না দেয়া হয় আর কোনো বাংলাদেশিকে যেনো এখানে যুক্ত না করা হয়।
সিনিয়র আইনজীবী আরও বলেন, চার্জশিট জমা না দেয়া কার স্বার্থে এটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের কাছেই জানতে হবে সিআইডি চার্জশিট তৈরির পরেও কেনা দিতে পারেনি আর তাদের কেনো চাপ দেয়া হয়েছে।
তবে সাধারণ আইনজীবীদের মত, সে সময় দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এ মামলায় আসামি করা উচিত। অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব টাকা ও ভোল্ট থেকে স্বর্ণ চুরি করেছে তা ফিরিয়ে আনা দরকার। আর যদি এটি ফিরিয়ে আনা না যায় তাহলে এসব চুরির সঙ্গে কারা জড়িত ছিল তাদের ধরা উচিত। এবং বিচার করা দরকার।
এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এর জন্য দায়বদ্ধ বাংলাদেশের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর। একটি তদন্ত কিন্তু হয়েছে এটি কিন্তু জনসম্মুখে দেখতে চাই। এবং অপরাধী যারা তাদের গ্রেপ্তার করে অতি শিগগিরিই বিচারের মুখোমুখি করা দরকার।
রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সবশেষ জুলাই মাসে যে বৈঠক হয় সেখানে দেশিয় যারা জড়িত তাদের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে। তবে সিআইডি তাতে রাজি হয়নি। তবে কবে নাগাদ চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসে সেটিতে নজর থাকবে সবার।
তথ্য সূত্র : প্রথম আলো, চ্যানেল 24