২০২২ সালের নোবেল বিজয়ী
আলাপচারিতা
২০২২ সালের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা ১০ অক্টোবর,সোমবার শেষ হয়েছে। প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার থেকে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, নোবেল ফাউন্ডেশন ২০২২ সালের বিজয়ীদের সঙ্গে ২০২০ ও ২০২১ সালের বিজয়ীদেরও আগামী ডিসেম্বরে সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল সপ্তাহে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে যারা নোবেল পুরস্কার পেলেন সাভান্তে, অ্যাসপেক্ট, ক্লজার, জেলিঙ্গার, এরনো, বিয়ালিয়াৎস্কি, বার্নানকে, ডায়মন্ড, ফিলিপ চিকিৎসাবিজ্ঞান
মানব বিবর্তনের জিনোম সম্পর্কিত আবিষ্কারের জন্য চলতি বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী সাভান্তে পাবো।গত সোমবার (৩ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ বছর বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে।নোবেল অ্যাসেম্বলি জানায়, বিলুপ্ত হোমিনিন এবং মানব বিবর্তনের জিনোম সম্পর্কিত আবিষ্কারের জন্য সাভান্তে পাবো এবার চিকিৎসায় নোবেল পেলেন।
পদার্থবিজ্ঞান
২০২২ সালে পদার্থে নোবেল পেয়েছেন ফ্রান্সের অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, আমেরিকার জন এফ ক্লজার ও অস্ট্রিয়ার অ্যান্টন জেলিঙ্গার।বেল ইনেকুয়ালিটির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ও কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট গবেষণায় অবদানের জন্য তাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয় বলে গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) নোবেল কমিটি জানায়।
বিবৃতিতে রয়েল সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ‘অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, জন এফ ক্লজার এবং অ্যান্টন জেলিঙ্গার প্রত্যেকেই বিজড়িত কোয়ান্টামের গতি ব্যবহার করে যুগান্তকারী পরীক্ষা চালিয়েছেন, যেখানে দুটি কণা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও একটি এককের মতো আচরণ করে। তাদের ফলাফল কোয়ান্টাম তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন প্রযুক্তির পথ উন্মোচন করেছে।’এতে আরও বলা হয়েছে, ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অবনর্ণীয় প্রভাবগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক এবং নিরাপদ কোয়ান্টাম এনক্রিপ্টেড যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার একটি বড় জায়গা রয়েছে। এই বিকাশের একটি মূল বিষয় হল কিভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুই বা ততোধিক কণাকে বিজড়িত করে সেখানে থাকতে দেয়। আটকানো জোড়ার একটি কণার কী হবে তা নির্ধারণ করে অন্য কণার কী হবে তার ওপর, এমনকি তারা দূরে থাকলেও।’
রসায়ন
রসায়নে নোবেল বিজয়ী
ক্যারোলিন আর বার্তোজি, মর্টেন মেলডাল এবং কে. ব্যারি শার্পলেস
২০২২ সালে রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন জন। ‘ক্লিক’ রসায়ন ও বায়োর্থোগোনাল রসায়নে অন্যন্য অবদানের জন্য গত বুধবার (৫ অক্টোবর) রয়েল সুইডিশ একাডেমি নোবেল বিজয়ী হিসেবে ক্যারোলিন আর বার্তোজি, মর্টেন মেলডাল এবং কে. ব্যারি শার্পলেসের নাম ঘোষণা করেছে।
নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ‘ক্লিক রসায়নকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন এবং জীবন্ত প্রাণীতে এটিকে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। কোষের স্বাভাবিক রসায়ন ব্যাহত না করেই জীবের বায়োর্থোগোনাল প্রতিক্রিয়া ঘটে।’
পুরস্কার বিজয়ীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শার্পলেস এবং মেলডাল রসায়নের একটি কার্যকরী ফর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছে ক্লিক রসায়ন- যেখানে আণবিক বিল্ডিং ব্লকগুলি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে একত্রিত হয়। বার্টোজি ক্লিক রসায়নকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন এবং জীবন্ত প্রাণীতে এর ব্যবহার শুরু করেছেন।’
ক্যারোলিন আর বার্তোজি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, মর্টেন মেলডাল ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কে. ব্যারি শার্পলেস যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ক্রিপস রিসার্চে কর্মরত রয়েছেন।
সাহিত্য
চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল ২০২২ পুরস্কার পেলেন ফরাসি নাগরিক আনি এরনো। স্টকহোমে সুইডিশ একাডেমি গত বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) ২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে।
আনি তার লেখায় ‘সাহস এবং তীব্র নির্লিপ্ততার’ সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং এর সাহায্যে ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড় থেকে জীবনবোধের বিচ্ছিন্নতা, সংযম এবং অন্যান্য বিষয় উন্মোচন করার জন্যই তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।
এছাড়া আনি তার লেখায় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লিঙ্গ, ভাষা এবং শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতে গভীর ভেদ চিহ্নিত করার মাধ্যমে জীবনকে দেখেছেন।
৮২ বছরের আনি এরনো পাঁচ দশক ধরে লেখালেখি করেন। মূলত কথাসাহিত্য লেখেন। তার লেখা মূলত আত্মজীবনীমূলক। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি তার উপন্যাসকে নিজের জীবন থেকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুপ্রাণিত বলেছেন। নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন যাপিত জীবনের দ্বন্দ্বমুখর জীবন-কথা। তার ভাষায়—লেখালেখি একটি রাজনৈতিক কাজ, যা সামাজিক বৈষম্যের প্রতি আমাদের চোখ খুলে দেয়।
সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যরা তার লেখায় ‘সাহসিকতা ও তীক্ষ্ণ স্নায়বিক ধারা’ বিবেচনায় এনে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেন। সুইডিশ অ্যাকাডেমি আরও বলেছে, ‘আনি এরনো ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা এবং সম্মিলিত সংযম উন্মোচন করেছেন।’
শান্তি
শান্তিতে নোবেল পেলো দুই সংগঠন ও এক মানবাধিকার কর্মী
২০২২ সালে শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন বেলারুশের মানবাধিকারকর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি, রাশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়াল ও ইউক্রেনের মানবাধিকার সংগঠন সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস। গত শুক্রবার (৭ অক্টোবর) নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে।
পুরস্কার ঘোষণার সময় বলা হয়, বেলারুশ, রাশিয়া ও ইউক্রেনে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় তাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি বেলারুশের একজন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী। তিনি বর্তমানে বিনা বিচারে কারাগারে আটক রয়েছেন।
৬০ বছর বয়সী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি বেলারুশের ভিয়াসনা (বসন্ত) মানবাধিকার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৬ সালের গণবিক্ষোভের বিরুদ্ধে বেলারুশের স্বৈরাচারী নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর নৃশংস দমন অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ভিয়াসনা কারাবন্দী বিক্ষোভকারী ও তাদের পরিবারকে সহায়তা দেয় এবং রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর বেলারুশ সরকারের নির্যাতনের ঘটনা নথিবদ্ধ করে।
রাশিয়ার ‘মেমোরিয়াল’ সংগঠনটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সোভিয়েত আমলের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকারদের পরিণতি জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। রাশিয়ার বর্তমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও তুলে ধরছে এটি।
সংগঠনটিকে রুশ সরকার প্রথমে ২০০৬ সালে সতর্ক করে দিয়েছিল। ২০১৪ সালে একে ‘বিদেশি এজেন্টদের’ তালিকায় তোলা হয়। রাশিয়ার সরকারের দাবি, কথিত ওই এজেন্টরা হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তি যারা বিদেশ থেকে তহবিল পায়।
ইউক্রেনে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে কিয়েভে ‘সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংগঠনটি ইউক্রেনীয় নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করা এবং ইউক্রেনকে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করার জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে।
তাদের পুরস্কৃত করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বেরিট রাইস-এন্ডারসেন বলেন, ‘শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরা নিজ নিজ দেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা বহু বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে কাজ করছেন। তারা যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য নথিভুক্ত করার জন্য অসামান্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। একইসাথে তারা শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য নাগরিক সমাজকে পথ প্রদর্শন করেছেন।’
অর্থনীতি
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট নিয়ে গবেষণা করে ২০২২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বেন এস বার্নানকে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিলিপ এইচ ডিবভিগ।
গতকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স অর্থনীতিতে এ বছরের নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করে।
নোবেল কমিটি জানায়, ব্যাংকিংবিষয়ক আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, সংকটের সময় ব্যাংকব্যবস্থা কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হয়। আবার ব্যাংক ধসে পড়লে কীভাবে আর্থিক সংকট ঘনীভূত হয়, তা–ও দেখা গেছে গবেষণায়। আর ১৯৮০-এর দশকে এসব গবেষণার সূত্রপাত করেন এই তিন অর্থনীতিবিদ—বেন এস বার্নানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ।
প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেস কমিটির চেয়ারম্যান টোরে ইলিংসেন বলেছেন, এই তিন অর্থনীতিবিদ আমাদের গুরুতর সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি ব্যয়বহুল বেইলআউট এড়ানোর পথ বাতলে দিয়েছেন।
তথ্যসূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ, বিবিসি, সিএনএন