২ মার্চ, ১৯৭১ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন ।। ৭ই মার্চর ভাষণ।।১৯মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ
রুহুল কুদ্দুস টিটো
অসহযোগ আন্দোলনের মাস মার্চ, মুক্তিযুদ্ধের মাস মার্চ। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি বাংলাদেশ নামক মানচিত্র সৃষ্টির মাস এই মার্চ মাস। এ মাসেই বীর বাঙালি স্বাধীনতার নেশায় মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২ মার্চ, ১৯৭১ > সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন। বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ, গুলিবর্ষণ। পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের ডাক, ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ
১. ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন।
২. ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করতে হবে।
৩. রেডিও, টেলিভশন ও সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নাকচ করে দিতে হবে।
৪. আগামী ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণদান করবো। সেখানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করবো।
৫. সংগ্রাম সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে এবং গণবিরোধী শক্তি ও তাদের ভাড়াটিয়া চরদেরই স্বার্থোদ্ধার করবে।
১৯৭১ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদেশ সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে।
সকাল ১১ টার দিকে সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পর্ষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘যাই ঘটুক না কেন যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। আমি ১০ মার্চ রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করছি।’
পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।
লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করা দুঃখজনক।’
রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আমরা ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চাই।’
প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং কোনো রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই গভীর রাতে বৈঠক মুলতবি করা হয়।
এদিকে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরোধ জানিয়ে ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আমরা ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সাতই মার্চ রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ মুজিব কী বলবেন
১৯৭১ সালের নানা বর্ণনা জাহানারা ইমাম-এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে পাওয়া যায়। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশজুড়ে নানা গুঞ্জন তখন চলছিলেন।
জাহানারা ইমাম লিখেছেন, সাতই মার্চ রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বানীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের কর্মসূচীর ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন।
ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে। মিটিং, মিছিল ও কারফিউর তীব্রতা বেড়েছে। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন।
“এর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছেন, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে,” লিখেছেন জাহানারা ইমাম।
১৯৭১ সালে ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। সাথে সাথে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অফিস-আদালত, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অনেকে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য রাস্তায় নেমে আসে।
সেদিন শেখ মুজিবুর হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করছিলেন।
রেডিওতে ঘোষণা শোনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসলো। হোটেল পূর্বানীর চারপাশ তখন লোকে-লোকারণ্য। কারণ, অনেকই জানতো শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে বৈঠক করছেন।
মার্চ মাসের দুই তারিখে ঢাকায় এবং তিন তারিখে সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়া হলো। এছাড়া মার্চ মাসের চার তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত দেশজুড়ে স্বতঃ:স্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। মার্চ মাসের চার তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে।
এমন অবস্থায় দোসরা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্র নেতারা।
পরিস্থিতি তখন আর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি যা বলছিলেন, সেটাই ছিল শিরোধার্য।
অন্যদিকে মার্চ মাসের তিন ও চার তারিখ রাত আটটা থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। তখন কারফিউ অগ্রাহ্য করে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণকে ঘিরে পাকিস্তান সরকারের মধ্যেও নানা চিন্তা ও উদ্বেগ
সাতই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণকে ঘিরে পাকিস্তান সরকারের মধ্যেও নানা চিন্তা ও উদ্বেগ কাজ করছিল। তাদের ধারণা ছিল, সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসতে পারেন।
শেখ মুজিব যাতে সে রকম কিছু না করেন, সেজন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর দিক থেকে নানা প্রচেষ্টা ছিল।
তখন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। মি. সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে সে সময়কার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।
সিদ্দিক সালিকের বর্ণনা মতে ৭ই মার্চ যতই এগিয়ে আসতে থাকে, গুজব, ভয়, আতঙ্ক ও উদ্বেগ ততই জোরালো হতে থাকে।
“এটা ধারণা করা হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান একতরফাভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেবেন,” লিখেছেন মি. সালিক।
শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবার আগের দিন অর্থাৎ ৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণ দেবার আগে মি. খান শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিফোন করেছিলেন।
তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ছিলেন তার জামাতা ও শেখ হাসিনার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া।
সে সময়কার বিভিন্ন ঘটনা ড. মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ বইতে তুলে ধরেছেন।
ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান টেলিফোনে ইয়াহিয়া খানকে বলেন যে আন্দোলন চলার সময় যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন, সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের টেলিফোন আলাপের বিষয়টি দেখা যায় সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যেও।
সেখানে মি. সালিক লিখেছেন, শেখ মুজিবের সাথে টেলিফোনে আলাপের পর ইয়াহিয়া খান একটি টেলিপ্রিন্টার মেসেজ পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিবের জন্য।
সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য মতে, সেই মেসেজে ইয়াহিয়া খান লিখেছিলেন, দয়া করে তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শীঘ্রই ঢাকা আসবো এবং আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করবো। আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে জনগণের প্রতি আপনার যে প্রতিশ্রুতি এবং আকাঙ্ক্ষা সেটির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখানো হবে।
এই বার্তাটি সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার ব্যক্তিগতভাবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন বলে সিদ্দিক সালিক উল্লেখ উল্লেখ করেন।
তিনি আরও লিখেছেন, ৭ই মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জোসেফ সিম্পসন ফারল্যান্ড শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন।
মার্চ মাসের শুরু থেকে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যদের এনে ঢাকায় জড়ো করতে থাকে।
সাতই মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা।
‘অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ বইতে মি. রাজা তার বইতে এর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ৬ই মার্চ আওয়ামী লীগের দুই ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে এসেছিল।
জেনারেল রাজা দাবি করেন, সেই ব্যক্তিদের তিনি বলেছিলেন, ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যরা অস্ত্র ও ট্যাঙ্ক নিয়ে তৈরি আছে। রেসকোর্স ময়দান থেকে তিনি সরাসরি শেখ মুজিবের ভাষণ শোনার ব্যবস্থাও রেখেছেন। শেখ মুজিব যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে আক্রমণ করে এবং একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাহলে সৈন্যরা সাথে সাথে জনসভার দিকে অগ্রসর হবে এবং সেখানে হামলা চালাবে।
“প্রয়োজনে ঢাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে,” এমন কথা জেনারেল রাজা উল্লেখ করেছেন তার বইতে।
৭ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ছিল লোকে-লোকারণ্য
সাতই মার্চ সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ছিল লোকে-লোকারণ্য । এ অবস্থা এর আগে থেকেই অবশ্য চলমান ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই সেখানে জমায়েত হতে থাকেন। জনসভার বিষয় নিয়ে তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন।
এরপর তিনি সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে একটি বৈঠক করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এই.এম. কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন।
বৈঠক শেষে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বলেন যে, তারা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – রেসকোর্সের জনসভায় চার দফা ঘোষণা দেয়া হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সংহতি রেখে এ ঘোষণা দেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এরপর এই চার-দফার একটি খসড়া প্রস্তুত করে ড. কামাল হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন নেন। তার অনুমোদনের পর সেটি টাইপ করা হয়।
ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, টাইপ করা কপির সাথে হাতে লেখা খসড়া কপি মিলিয়ে দেখার দায়িত্ব শেখ মুজিব তাকে দিয়েছিলেন।
“এক পর্যায়ে খন্দকার মোশতাক কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ইশতেহারে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিনা।”
“তিনি (খন্দকার মোশতাক) বলেন যে, সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারীকৃত আইনগত কাঠামো-এর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা লঙ্ঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং এই ব্যাপারটা এই ইশতেহারে লেখা হয়নি,” লিখেছেন ড. ওয়াজেদ মিয়া।
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে নৌকা আকৃতির মতো করে জনসভার মঞ্চ করা হয়েছিল। সকাল থেকেই লাখো মানুষ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে যেতে থাকে। পুরো রেসকোর্স ময়দান ও তার আশপাশের এলাকা একবারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিকেল চারটার পর শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে আসেন। সে ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন আরও জোরদার করার আহবান জানান।
একই সাথে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি চারটি দাবি তুলে ধরেন।
১. অবিলম্বে মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে
২. জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে
৩. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে
৪. সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণ ও মানুষ হত্যার ঘটনা তদন্ত করতে হবে
তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চারটি শর্তের ব্যাপারেই শুধু বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছিলেন।”
“ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন – তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিলো না।”
রেসকোর্সে ৭ই মার্চের বহু প্রত্যাশিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন – “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সে বিশাল সমাবেশ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোভাব দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে যায় পাকিস্তান সরকার। একই সাথে তারা বুঝতে পারে শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্চ রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সে ভাষণ শোনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে এসেছিলেন।
জাহানারা ইমামের বর্ণনায় – কত দূর-দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে – তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর ডেমরা – এসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।
সাতই মার্চ ভাষণের পর শেখ মুজিবুর রহমান আশঙ্কা করছিলেন যে তার ওপর যে কোন সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পদক্ষেপ আসতে আসতে পারে। এ বিষয়টি তিনি পারিবারিক মহলেও বলেছিলেন।
“ ৭ই মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল, শেখ শহীদ, শাশুড়ি ও আমাকে নিয়ে খাওয়ার সময় গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার যা বলার ছিল তা আজকের জনসভায় প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে,” লিখেছেন ওয়াজেদ মিয়া।
সিদ্দিক সালিকের বর্ণনায় – রেসকোর্স ময়দানে মানুষের যে জোয়ার এসেছিল সেটি জনসভা শেষে ভাটার মতো মিলিয়ে গেল। মানুষজনকে দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন কোন মসজিদ বা চার্চের ধর্মীয় জমায়েত থেকে ফিরছে, যেখানে তারা সন্তুষ্টির বাণী শুনেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ ভাষণের পর তাঁর নির্দেশে শুরু হয় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। এরপর থেকে শেখ মুজিবুর রহামনের নির্দেশে চলতে থাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।
১৯ মার্চ এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় গাজীপুরের জয়দেবপুরে।
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। দেশ যখন অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল তখন গাজীপুরের শান্তিকামী জনতা স্বাধীনতার জন্য পাক হানাদারদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গাজীপুরের তৎকালীন নাম ছিল জয়দেবপুর। ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর সেনানিবাসের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যালয় ছিল। সেখানে ২৫-৩০ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানিরা বাঙালি দমনের নীল নকশা অনুযায়ী ১৫ মার্চের মধ্যে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়।
বাঙালি সৈন্যরা রাজি না হলে ১৯ মার্চ সকালে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিতে জয়দেবপুর সেনানিবাসে আসেন। এ খবর জানাজানি হলে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে জনতা, লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে জয়দেবপুর বটতলায় জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে মনু খলিফা, কিশোর নিয়ামত, ফুটবলার হুরমত আলী ও কানু মিয়া শহীদ হন। আহত হন আরও অনেকে। জয়দেবপুরে পাক হানাদারদের সঙ্গে এ সম্মুখ যুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান ছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
বীর বাঙালির এই সশস্ত্র প্রতিরোধের কারণেই ব্যর্থ হয় জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা। জয়দেবপুরের ‘সংঘর্ষের’ খবর বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশে। এদিন সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলির তীব্র নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যারা বুলেট ও শক্তি দিয়ে গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করবেন বলে ভেবেছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়োগে ভয় পায়।’
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা, বাংলা ট্রিবিউন, ইনসাইডার বাংলা