৫০ বছর পর রাশিয়ার কোনো
প্রসঙ্গ কথা
প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ২৩ নভেম্বর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। আর ২৪ নভেম্বর সকালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় যোগ দেবেন তিনি।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় যুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ থাকায় ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে রাশিয়ার কণ্ঠস্বর। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধারী পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের অন্যতম হওয়ার পরও রাশিয়া নানা বিষয় এখন সাধারণ পরিষদে তুলতে বাধ্য হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান সামনে আনতে প্রতিবেশী ভারতের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশকে জোরালোভাবে পাশে পেতে চাইছে রাশিয়া।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে সফরটি হলেও মূলত রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে মস্কো। ২৩টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত আইওআরএতে যুক্ততার বিষয়ে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল।-খবর প্রথম আলো
এবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সংলাপ অংশীদার হওয়ার সুযোগটিকে রাশিয়া রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসার আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ফলে আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে এলেও পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করার মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে থাকা ভারত মহাসাগর নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহের বিষয়টি সামনে চলে আসছে।
সোভিয়েত–বাংলাদেশি সম্পর্ক
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানায় এবং গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানায়। যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্তৃত সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নিকট প্রায় পরাজিত পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে প্রেরণ করে। এর প্রত্যুত্তরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর প্রতি সম্ভাব্য মার্কিন হুমকি প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর এবং ১৩ ডিসেম্বর ভ্লাডিভোস্তক থেকে সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের দুই স্কোয়াড্রন ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার এবং পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি পারমাণবিক ডুবোজাহাজ প্রেরণ করে।
সোভিয়েত নৌবহরটির নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির ক্রুগ্লিয়াকভ।
সোভিয়েত নৌবহরের আগমনের ফলে মার্কিন নৌবহর পাকিস্তানকে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত নৌবহর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহরকে তাড়া করে বেড়ায়। এছাড়া সোভিয়েত নৌবাহিনী গোপনে ভারতীয় নৌবাহিনীকে সহায়তা করে এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্ত অভিযান পরিচালনা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, এবং ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্ণফুলি নদীতে পাকিস্তানি বাহিনী অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখেছিল। তাছাড়া যুদ্ধের সময় অনেক নৌযান ডুবে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ বন্দরটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের পর সোভিয়েত নৌবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মাইন অপসারণ এবং বন্দরটির কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত হয়। সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ২২টি জাহাজ এ উদ্দেশ্য ১৯৭২ সালের মে মাসে দূর প্রাচ্যের ভ্লাদিভোস্তক বন্দর থেকে চট্টগ্রামে আসে। মাইন অপসারণের কাজটি সম্পন্ন করতে তাদের প্রায় এক বছর সময় লাগে, এবং ইউরি রেদকিন নামক একজন সোভিয়েত মেরিন এসময় মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি প্রাঙ্গণে তার কবর অবস্থিত।
সোভিয়েত সহযোগিতার ফলে চট্টগ্রাম শীঘ্রই একটি প্রধান বন্দর হিসেবে পূর্বের অবস্থান ফিরে পায় এবং ১৯৭৩ সালে এর ধারণক্ষমতা যুদ্ধপূর্ব ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে বিস্তৃত সহায়তা প্রদান করে। বিশেষত সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে ১০টি এক-আসনবিশিষ্ট মিগ-২১এমএফ এবং ২টি দুই-আসনবিশিষ্ট মিগ-২১ইউএম যুদ্ধবিমান উপহার প্রদান করে। ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মস্কো সফর করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তার জন্য সোভিয়েত সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান ও আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, ফলে স্বাভাবিকভাবে এসব রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। এসময় বাংলাদেশ সক্রিয় সোভিয়েত-বিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ কম্পুচিয়ায় ভিয়েতনামের আক্রমণে সোভিয়েত সমর্থনের নিন্দা জানায়, এবং ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে বাংলাদেশসহ আরো ৬৪টি রাষ্ট্র ১৯৮০ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস বয়কট করে। এছাড়া, ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ঢাকা থেকে ৯ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বহিষ্কার করে।
তবে তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করতে থাকে। সোভিয়েতরা বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল – এই তিনটি ক্ষেত্রের উন্নয়নে বাংলাদেশকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। সোভিয়েত অর্থায়নে বাংলাদেশের বৃহত্তম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে দাতা দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান ছিল ১৪তম। এছাড়া, এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
রুশ–বাংলাদেশি সম্পর্ক
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত রুশ দূতাবাসের সম্মুখভাগ
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাংলাদেশ রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল চলনসই। বসনীয় যুদ্ধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিতে এসময় বাংলাদেশ ও রাশিয়া ভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করে। পরবর্তীতে ২০০০-এর দশকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে উন্নতি ঘটে।
রাজনৈতিক সম্পর্ক
২০১৩ সালে মস্কোয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন সাক্ষাৎ করেন
২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্ট পিটার্সবার্গ সফর করেন এবং তৎকালীন রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা আবার মস্কোতে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া সঙ্কটের সময় বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের মতো রাশিয়ার বিরোধিতা না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে।
See insights and ads
Boost post
1
1 Share
Like
Comment
Share