রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুনে অন্তত ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে ভবনটিতে আগুন লাগে। আগুন নেভানোর পর হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।
রাত দুইটার দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মরদেহ এই দুই হাসপাতালে আছে। এর বাইরে আরও মৃত ব্যক্তি থাকতে পারে।
এ ঘটনায় গুরুতর আহত ৮ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে এবং ১৪ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, তাঁদের সবার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
এর আধা ঘণ্টা পর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালেও একজনের মরদেহ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন।
গতকাল রাতে বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেটি সাততলা। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও রয়েছে খাবারের দোকান। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভবনটি প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর তা ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ক্রেনের সাহায্যে ভবনের সপ্তম তলা ও ছাদে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের নামিয়ে আনতে থাকেন তাঁরা।
ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তখনো ভবনের ভেতরে ধোঁয়া ছিল। এরপর ভবনে তল্লাশি চালিয়ে অচেতন অবস্থায় অনেককে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
রাত সোয়া একটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভবন থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া অচেতন অবস্থায় ৪৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। যাঁদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ২১ জন নারী ও ৪ শিশু রয়েছে। এর বাইরে ১৫ জন নারীসহ ৭৫ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ভবনটির তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া অন্য সব তলায় রেস্তোরাঁ ছিল। এসব রেস্তোরাঁয় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জানান, এ ঘটনায় যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন। তাঁদের শরীরে পোড়ার ক্ষত তেমনটা দেখা যায়নি।
ভবনে উদ্ধারকাজে যুক্ত ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সিঁড়িতে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় লোকজন বের হতে পারেননি।
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত নিয়ে র্যাব-৩–এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসান রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, ওই ভবনের নিচতলায় একটি কফির দোকান রয়েছে। সেখানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন।
এ ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ওই ভবনে আর কোনো মৃতদেহ রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে আজ সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আরেকবার তল্লাশি চালাবেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। সেখানে আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের একজন সহকর্মীর কন্যা মারা গেছেন। পুলিশ হাসপাতালে আরও একজন মারা গেছেন। দোয়া করবেন যে ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের জীবন যেন রক্ষা পায়।’
ভবন থেকে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত একটার পর সেখানে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা যায়। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে হতাহত ব্যক্তিদের সেখানে আনা হয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীদের নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন নির্বিঘ্নে হাসপাতালে প্রবেশ করানো যায়, সে জন্য জরুরি বিভাগের ফটকে ট্রলি প্রস্তুত রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে আহত ব্যক্তিদের বের করে নেওয়া হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পর্যবেক্ষণকক্ষে। কক্ষের বাইরে স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
আগুন লাগার পর ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে বেশ কয়েকজন আহত হন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা বেশির ভাগই হাত–পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। আহত দ্বীন ইসলাম (২৮) ভবনের সপ্তম তলার একটি রেস্তোরাঁর বাবুর্চি। তিনি জানান, আগুন লাগার পর ইন্টারনেটের তার বেয়ে নিচে নামতে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তার ছিঁড়ে পড়ে গিয়ে আহত হন তিনি। আহত আরও কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন জুয়েল (৩০), জোবায়ের (২০), আরিফ (২০), ইকবাল (৩৫), উজ্জ্বল সরদার (২৩), রাকিব (২৫), শাকিল (২২), ওমর ফারুক (৪৩), সিজান (২৫), রাসেল (৩৫) ও ইমরান (১৪)।
সূত্র: প্রথমআলো