বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং ভূ-রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রভাবের গতিপথ: একটি বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ
বঙ্গোপসাগরে ২০২৫ সালের প্রভাবের সন্ধিক্ষণ
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান কৌশলগত “হেজিং” এবং “নন-অ্যালাইনমেন্ট” (অ-সংলগ্নতা) নীতির উপর নির্ভরশীল, যা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে । তবে, এই কৌশলগত নমনীয়তা ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাতীয় পর্যায়ে সুসংহত, দীর্ঘমেয়াদী পররাষ্ট্র নীতির অভাব দ্বারা গভীরভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ।
আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সামুদ্রিক ডোমেনে পরিলক্ষিত হয়। ভারত মংলা বন্দরে অপারেশনাল অধিকার সুরক্ষিত করার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক ট্রানজিট প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে তার আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব সুসংহত করেছে । একই সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বে টার্মিনাল গভীর সমুদ্র বন্দরে অর্থায়ন করে চীনা অবকাঠামোগত আধিপত্য এবং ভারতীয় বন্দর নিয়ন্ত্রণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে । অন্যদিকে, চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) মাধ্যমে ব্যাপক বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে, যা মূল খাতগুলিতে তার প্রভাব বজায় রাখতে সহায়ক ।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় পদ্ধতিগত দুর্বলতা হলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্পগুলির প্রধান শক্তির আর্থিক যুদ্ধের সরাসরি সংস্পর্শে আসা। বিশেষত, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলি রাশিয়ার নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (RNP) জন্য মারাত্মক আর্থিক ও লজিস্টিক বাধা সৃষ্টি করেছে , যা ঢাকাকে জটিল নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে বাধ্য করছে। একই সাথে, চীনা ঋণের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, যেমন পায়রা বন্দরের অর্থায়ন প্রক্রিয়া , একটি বিশেষায়িত, অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকি তৈরি করছে যা দীর্ঘমেয়াদী রাজস্ব স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশ
১.১ ভূ-রাজনৈতিক অগ্নিপরীক্ষা
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি কৌশলগত কেন্দ্রে অবস্থান করছে, যেখানে চারটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তির স্বার্থ একে অপরের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা করছে। ভারত বাংলাদেশকে তার আঞ্চলিক নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে, চীন এটিকে তার মেরিটাইম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের (IPS) মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, এবং রাশিয়া দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা ও শক্তি খাতে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর । বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বার এবং দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও নীতির ওপর এই বহুপাক্ষিক চাপ তীব্র হয়েছে।
১.২ ২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনীতি
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা । এই রাজনৈতিক রূপান্তর কালীন সময়ে, ঘরোয়া স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনার দিকে উচ্চ-পর্যায়ের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়, যা স্বভাবতই জটিল, দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয় ।
একটি অস্থির রাজনৈতিক রূপান্তরকালে, যখন সরকার তাৎক্ষণিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত থাকে, তখন উচ্চ-পর্যায়ের মনোযোগ দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন থেকে সরে যেতে পারে। এই সাময়িক শূন্যতা বা অনুভূত দুর্বলতা বহিরাগত শক্তিগুলোর জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ও সুশাসনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে , যার মাধ্যমে তারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি (যেমন ACSA/GSOMIA) বা চীনা অবকাঠামো (BRI) সংক্রান্ত স্বচ্ছতা পর্যালোচনার মতো বিষয়ে ছাড় দাবি করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের পক্ষে বহিরাগত চাপ সামলানো এবং দ্রুত কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।
১.৩ পরিধি এবং পদ্ধতি: প্রভাবের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ
এই প্রতিবেদনটি প্রধান শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়াকে তিনটি মূল মাত্রায় বিশ্লেষণ করে: (ক) অর্থনৈতিক/অবকাঠামোগত আকর্ষণ, (খ) নিরাপত্তা/প্রতিরক্ষা বিন্যাস, এবং (গ) শাসন/কূটনৈতিক শর্তারোপ। এই কাঠামোটি ২০২৫ সালের জন্য নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো মূল্যায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
২. বাংলাদেশের কৌশলগত হিসাব-নিকাশ: হেজিং রাষ্ট্র
২.১ ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির ধারণাগত দুর্বলতা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ এবং “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়” (“friendship to all, malice towards none”) ও “নন-অ্যালাইনমেন্ট” নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত । তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে কোনো সুসংগঠিত, দীর্ঘমেয়াদী পররাষ্ট্র বা নিরাপত্তা কৌশল নেই। পরিবর্তে, নীতি প্রায়শই দৈনন্দিন ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যা এটিকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে । একটি সংক্ষিপ্ত ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (Indo-Pacific Outlook) প্রকাশ করা হলেও, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মতো ব্যাপক বা সুনির্দিষ্ট নয়। এছাড়াও, দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল, সামরিক বা নৌ-মতবাদ তৈরি হয়নি ।
যেহেতু ঢাকায় পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জাতীয় ঐকমত্যের অভাব রয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত , তাই কৌশলগত হেজিং—অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় এবং ঝুঁকি কমানোর প্রক্রিয়া —একটি সক্রিয় কৌশল না হয়ে বরং একটি বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এই কৌশলটি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক শক্তি বজায় রাখার উপর নির্ভর করে । এই নীতিটি কার্যকরভাবে কাজ করলেও, এর প্রধান ঝুঁকি হলো, কৌশলগত সারিবদ্ধতার অভাব মিত্রদের কাছে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং একক কোনো শক্তি দ্বারা চাপের সৃষ্টি হলে কূটনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা কমে যেতে পারে।
২.২ হেজিং করার ক্ষমতা: অর্থনৈতিক শক্তি এবং অস্থিরতা
কার্যকর হেজিংয়ের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ । তবে এই সক্ষমতা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং কূটনৈতিক নমনীয়তার উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল । ২০২৫ সালে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা তারল্য সংকটে ভুগছে, এবং উচ্চ সরকারি ঋণ বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে ।
এই অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্বলতা ঢাকাকে বাহ্যিক আর্থিক প্রস্তাব, বিশেষত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ চীনা ঋণ প্রত্যাখ্যান করতে সীমিত করে তোলে। এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হতে যাওয়া ‘Prompt Corrective Action’ ফ্রেমওয়ার্ক এবং ঝুঁকি-ভিত্তিক তত্ত্বাবধান মডেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলায় নীতি সংস্কার শুরু হয়েছে ।
২.৩ ফোর্সেস গোল ২০৩০ এবং বহু-মাত্রিক প্রতিরক্ষা কূটনীতি
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা, ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’, তার হেজিং কৌশলের ভিত্তি। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সাথে সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে বহু-মাত্রিক প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে মনোনিবেশ করেছে, যা নয়াদিল্লিতে “ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি” সৃষ্টি করেছে ।
২০২৫ সালের মূল প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে চীনের কাছ থেকে প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চেংদু জে-১০সিই (Chengdu J-10CE) মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট সংগ্রহের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত । এছাড়াও, পুরনো রুশ এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ ও ওভারহোলিং অব্যাহত রয়েছে, যেমন মিগ-২৯, ইয়াক-১৩০, বেল-২১২ হেলিকপ্টার, এফএম-৯০ SHORAD সিস্টেম এবং RAT 31 DL রাডারের যন্ত্রাংশ । ২০২৫ সাল জুড়ে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে উচ্চ-পর্যায়ের সামরিক বিনিময় হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে যোগাযোগ চ্যানেলগুলি নীরবে পুনরায় খোলা হয়েছে ।
এই কৌশলগত সামরিক ভারসাম্য রক্ষার্থে, বাংলাদেশ চীন থেকে একটি প্রধান কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম (J-10CE) সংগ্রহ করার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লজিস্টিক চুক্তি (ACSA/GSOMIA) নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে । এর ফলে, উভয় শক্তিই ঢাকার নিরাপত্তা ভবিষ্যতে নিজেদের অংশীদার মনে করে। এই আন্তঃনির্ভরশীলতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে কোনো একক শক্তি দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়া বা জবরদস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
৩. চীনা প্রভাব: বিআরআই, অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক আকর্ষণ
৩.১ ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রেকর্ড ব্যস্ততা এবং কৌশলগত মনোযোগ
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী বিআরআই (BRI) প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যার পরিমাণ নির্মাণ চুক্তি এবং বিনিয়োগ মিলিয়ে মোট ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । এটি এই উদ্যোগের প্রতি বেইজিংয়ের অব্যাহত এবং দৃঢ় অঙ্গীকারের ইঙ্গিত দেয়।
২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে চীনা সম্পৃক্ততার স্থিতিশীলতা দেখা যায়, যেখানে নির্দিষ্ট কৌশলগত খাতগুলিতে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে: নতুন প্রযুক্তি (যেমন ব্যাটারি) উৎপাদন, নবায়নযোগ্য শক্তি, আইসিটি (ডেটা সেন্টার), এবং বাণিজ্য-সহায়ক অবকাঠামো (যেমন পাইপলাইন, সড়ক ও বন্দর) । চীন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের ঘোষণা দিলেও, বাংলাদেশের বরিশাল ২ এর মতো কিছু নির্দিষ্ট প্রকল্প এখনও চীনা অংশগ্রহণের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে । চীনের মূল উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিক বাণিজ্য অস্থিরতার মধ্যে সরবরাহ চেইনের স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করা এবং চীনা সংস্থাগুলির জন্য বিকল্প রফতানি বাজার তৈরি করা ।
৩.২ কৌশলগত সম্পদ দখল
বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলির মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চীনা প্রভাব দৃঢ় হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং কৌশলগত প্রবেশাধিকার তৈরি করে। বন্দর এবং রেলপথের মতো উচ্চ দৃশ্যমানতার কৌশলগত প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে । বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিআরআই পরিবহন করিডোরগুলি বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করার সম্ভাবনা রাখে, তবে এর জন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলিকে ঋণ স্বচ্ছতা, সরকারি সংগ্রহের উন্মুক্ততা এবং ঋণের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গভীর নীতি সংস্কার গ্রহণ করতে হবে ।
৩.৩ আর্থিক কাঠামো এবং ঋণ ঝুঁকির আত্মীকরণ
বিআরআই বিনিয়োগের সাথে যে আর্থিক ঝুঁকি জড়িত, তার একটি বিশেষ কাঠামো রয়েছে। পায়রা বন্দরের অর্থায়ন এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ । পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৬৪.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ পাবে, যা সরকার সোণালী ব্যাংকের মাধ্যমে সরবরাহ করবে এবং ৭ বছরে ২ শতাংশ সুদে পরিশোধ করতে হবে ।এই ঋণের কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক দিক নির্দেশ করে। এই ঋণটি সরাসরি সার্বভৌম-স্তরের বহিরাগত গ্যারান্টি দ্বারা সুরক্ষিত না হয়ে দেশীয় সরকারি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে চালিত হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, চীন এই ঋণটিকে সাধারণ আন্তর্জাতিক যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া থেকে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে। এর চূড়ান্ত ফলাফল হলো, ঋণটি কার্যত অভ্যন্তরীণ এবং সরকার-নির্ভর হয়ে যায়। যদি প্রকল্পটি প্রত্যাশিত আর্থিক ফলন অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং সাত বছরের কঠোর পরিশোধের সময়সূচী পূরণ করতে না পারে , তবে এই ব্যর্থতা সরাসরি দেশীয় আর্থিক কষ্টের সাথে যুক্ত হবে , যা ঋণ পুনর্গঠন আলোচনার সময় চীনা প্রভাবকে শক্তিশালী করবে।
৪. ভারতীয় প্রভাব: আঞ্চলিক সংহতি এবং নিরাপত্তা শ্রেষ্ঠত্ব
৪.১ কৌশলগত গভীরতা হিসেবে সংযোগ (Act East Policy)
ভারত বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির সাথে সংযোগকে তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে । শারীরিক (সড়ক, রেল, জলপথ), জন-যোগাযোগ (P2P), এবং ডিজিটাল সংযোগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে (NER) আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সুযোগের সাথে যুক্ত করার জন্য একটি কৌশলগত সেতু হিসেবে কাজ করছে ।
‘ডিজিটাল নর্থইস্ট ভিশন ২০২২’-এর মতো উদ্যোগগুলি, যা ২০২২-২০২৬ সাল পর্যন্ত PM-DevINE তহবিলের মাধ্যমে অর্থায়ন পাচ্ছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ডিজিটালভাবে সংযুক্ত করছে। এই উদ্যোগটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দ্রুত ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে ভারতের কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সীমান্তে পরিণত করেছে, যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের ভূ-কৌশলগত সম্পৃক্ততা বাড়াতে অত্যাবশ্যক ।
৪.২ বন্দর ব্যবহারের ব্যবহারিক রূপায়ণ: কৌশলগত অঞ্চলের সুরক্ষা
ভারত তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ট্রানজিট অধিকারের চেয়েও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে, যা বাংলাদেশের সামুদ্রিক অবকাঠামোতে সরাসরি পরিচালনাগত ভূমিকা নিশ্চিত করেছে ।
চট্টগ্রাম এবং মংলা: বাংলাদেশ ২০১৮ সালেই ট্রানজিট এবং কার্গো শিপিংয়ের জন্য ভারতকে পূর্ণ প্রবেশাধিকার প্রদান করে । আরও সমালোচনামূলকভাবে, নয়াদিল্লি ২০২৪ সালে মংলা বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার সুরক্ষিত করে । এই পদক্ষেপ ভারতকে বাংলাদেশের একটি মূল সামুদ্রিক সম্পদে সরাসরি ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ দেয়, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির (NER) লজিস্টিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এই কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্বের বাস্তবায়ন একটি খরচ তৈরি করেছে: ভারতীয় কার্গো পরিবহণের আকস্মিক বৃদ্ধি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে চাপের মুখে ফেলেছে, যার ফলে যানজট এবং বিলম্ব ঘটছে । যদি এই অবকাঠামোগত চাপ দ্রুত প্রশমিত করা না যায়, তবে ভারতীয় ট্রানজিট এবং অপারেশনাল অ্যাক্সেসের কারণে সৃষ্ট এই ব্যবহারিক সমস্যা দ্রুত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় পরিণত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে ভারতীয় অ্যাক্সেসের শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা বা সীমাবদ্ধতার দাবি উত্থাপন করতে পারে।
৪.৩ প্রতিরক্ষা বহুমুখীকরণের প্রতি ভারতের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে প্রসারিত হওয়ায় ভারত “অশান্ত” হয়ে উঠেছে । ২০২৫ সাল জুড়ে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে উচ্চ-পর্যায়ের সামরিক বিনিময়ের নীরব পুনরুজ্জীবন নয়াদিল্লির জন্য বিশেষভাবে সংবেদনশীল । এর তাৎপর্য হলো, ভারত তার নিজস্ব নিরাপত্তা সহযোগিতার দাবি তীব্র করবে এবং বাংলাদেশে তার পছন্দের নিরাপত্তা অবস্থান বজায় রাখতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রয় ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দ্রুত বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
৫. মার্কিন প্রভাব: নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব এবং শাসন শর্তারোপ
৫.১ শাসনের উপর ভূ-রাজনৈতিক মনোযোগের সময়কাল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অধীনে সুশাসন এবং গণতন্ত্রের উপর দৃঢ় মনোযোগ বজায় রেখেছে, বিশেষত ২০২৫/২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে । এই শাসন এজেন্ডা গভীরতর নিরাপত্তা সম্পর্কের জন্য একটি শর্ত বা পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করছে।
৫.২ আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংহতির জন্য চাপ
মার্কিন কৌশলের জন্য প্রয়োজন হলো বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অধীনে আন্তঃকার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আনুষ্ঠানিক সরবরাহ এবং যোগাযোগ চুক্তিগুলিকে চূড়ান্ত করুক।
ACSA এবং GSOMIA: অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (ACSA) এবং জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (GSOMIA) নিয়ে আলোচনা চলছে । এই চুক্তিগুলি লজিস্টিক সহযোগিতা, সুরক্ষিত যোগাযোগ এবং উন্নত মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার সহজ করবে ।
ACSA এবং GSOMIA-তে স্বাক্ষর করা বাংলাদেশের কৌশলগত হেজিং করার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে জটিল করে তুলবে, কারণ এই চুক্তিগুলি প্রায়শই উচ্চ স্তরের তথ্য সুরক্ষা এবং মার্কিন বাহিনীর সাথে লজিস্টিক সারিবদ্ধতা দাবি করে। যদিও তারা প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং পশ্চিমা প্ল্যাটফর্মগুলির সাথে আন্তঃকার্যকারিতা বাড়ায়, কিন্তু তারা ঢাকাকে একটি কঠোর বিন্যাসের দিকে ঠেলে দেয়, যা তার নন-অ্যালাইনমেন্ট নীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে । ঢাকার পক্ষ থেকে এই চুক্তিগুলির বিবেচনায় বিলম্ব এবং সতর্কতা তার কৌশলগত অস্পষ্টতা বজায় রাখার প্রচেষ্টার প্রতিফলন ।
৫.৩ কৌশলগত পাল্টা-অর্থায়ন: বে টার্মিনাল প্রকল্প
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রায়শই বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলির মাধ্যমে কাজ করে, চীনা বিআরআই অর্থায়নের সরাসরি, উচ্চ-মূল্যের বিকল্প সরবরাহ করে।
বিশ্বব্যাংকের হস্তক্ষেপ (এপ্রিল ২০২৫): ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ $৮৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মধ্যে $৬৫০ মিলিয়ন বিশেষভাবে বে টার্মিনাল মেরিন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয় । এই প্রকল্পটির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ৬ কিমি জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক ব্রেকওয়াটার এবং অ্যাক্সেস চ্যানেল সহ অপরিহার্য বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করা হবে ।
আঞ্চলিক অনিবার্যতা: এই প্রকল্পটি সরাসরি চীনা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে, যার লক্ষ্য বাংলাদেশের রফতানি প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং বড় জাহাজগুলিকে স্থান দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা । এছাড়াও, গণমাধ্যমের খবরে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে মার্কিন কর্মকর্তারা কৌশলগতভাবে চীনের ক্রমবর্ধমান ভারত মহাসাগরীয় উপস্থিতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য চট্টগ্রামে একটি সম্ভাব্য “পদচিহ্ন” নিয়ে উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা করছেন । এই মার্কিন আগ্রহ ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত অপারেশনাল অ্যাক্সেসের সাথে ওভারল্যাপ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে নতুন কৌশলগত ঘর্ষণের জন্ম দিতে পারে ।
৬. রুশ প্রভাব: কৌশলগত শক্তি নির্ভরতা এবং নিষেধাজ্ঞার দুর্বলতা
৬.১ রূপপুর পারমাণবিক নোঙর (RNP)
রাশিয়ার প্রাথমিক কৌশলগত সম্পদ হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (RNP), যা রাশিয়ার সহায়তায় ($১২.৬৫ বিলিয়ন) নির্মিত হয়েছে। প্রথম ইউনিটের (১,২০০ মেগাওয়াট) ট্রায়াল রান ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্ধারিত হয়েছে, যদিও মূল লক্ষ্য ছিল এর আগে ।
কৌশলগত তাৎপর্য: একবার সম্পূর্ণ চালু হলে, ২,৪০০ মেগাওয়াটের এই প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান, স্থিতিশীল বেস-লোড শক্তি উৎস সরবরাহ করবে, যা জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার জন্য রাশিয়ার উপর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নির্ভরতা নিশ্চিত করবে।
৬.২ নিষেধাজ্ঞার স্ব-বিরোধী নীতি: প্রক্সি আর্থিক যুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার উপর আধিপত্য ব্যবহার করে RNP প্রকল্পকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না করেই তার প্রভাব বজায় রাখছে।
অবরোধ: রাশিয়ার সত্ত্বাগুলির (যেমন রোসাটমের সহায়ক সংস্থা অ্যাটমস্ট্রোয়এক্সপোর্ট) উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে, করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকগুলির (নিউইয়র্কের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক) মাধ্যমে লেনদেনগুলি অবরুদ্ধ হচ্ছে ।
কার্যকরী প্রভাব: এই আর্থিক ব্লক অ্যাটমস্ট্রোয়এক্সপোর্টকে বিদেশী উপ-ঠিকাদারদের কাছে তহবিল স্থানান্তর বা ঋণের সুদ পরিশোধ করতে বাধা দেয়। এমনকি বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা একটি “পরীক্ষামূলক” ভিত্তিতে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন, যা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দ্বারা অবরুদ্ধ করা হয় । এই লেনদেন অবরোধের অর্থ হলো, বাংলাদেশকে অ-ডলার/অ-সুইফট পেমেন্ট সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, যা লেনদেনের খরচ এবং জটিলতা বাড়িয়ে তুলবে এবং ঢাকাকে কার্যত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর আর্থিক বোঝা গ্রহণে বাধ্য করবে। এই সমস্যাটি বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংক ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে ।
৬.৩ প্রতিরক্ষা সংগ্রহের উপর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের একটি প্রধান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী । RNP-তে নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থ প্রদানের জটিলতা রাশিয়ার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এই অনিশ্চয়তা বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য রাশিয়া থেকে চীন, তুরস্ক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (যদি ACSA/GSOMIA চুক্তি হয়) দিকে বহুমুখীকরণকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
৭. সংশ্লেষণ এবং ২০২৫-২০২৬ সালের ভূ-রাজনৈতিক পূর্বাভাস
২০২৫ সালে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের বিশ্লেষণ চারটি প্রধান শক্তির জটিল এবং ওভারল্যাপিং প্রভাবকে তুলে ধরে। প্রতিটি শক্তিই বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং নীতিতে একটি নির্দিষ্ট ধরণের সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করছে। এই বহুমাত্রিক চাপটি নিচের সারণি ১-এ সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হলো।
সারণি ১: বাংলাদেশে প্রধান শক্তিগুলোর প্রভাবের প্রক্রিয়া এবং পরিধি (২০২৫)
প্রধান শক্তি | প্রভাব বিস্তারের প্রাথমিক প্রক্রিয়া | মূল কৌশলগত সম্পদ/প্রকল্প | প্রভাব বিস্তারের প্রধান ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র | নিরাপত্তা সহযোগিতা ও শাসন শর্তারোপ | ACSA/GSOMIA আলোচনা , বিশ্বব্যাংক/বে টার্মিনাল অর্থায়ন , গণতন্ত্র প্রচার | চীনকে প্রতিহত করা; লজিস্টিক অ্যাক্সেস সুরক্ষিত করা; ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা। |
ভারত | সংযোগ এবং আঞ্চলিক প্রবেশাধিকার | মংলা বন্দর টার্মিনাল পরিচালনা , উত্তর-পূর্ব সংযোগ (শারীরিক/ডিজিটাল) , বাণিজ্য প্রোটোকল পুনর্নবীকরণ | আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা; উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির জন্য কৌশলগত গভীরতা নিশ্চিত করা; চীন/পাকিস্তানের সাথে প্রতিরক্ষা বিন্যাস রোধ করা |
৭.১ ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ স্থান: আঞ্চলিক অনিবার্যতা
বন্দর: আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ স্থান হলো সামুদ্রিক খাত। ভারত অ্যাক্সেস ও অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করেছে (মংলা), চীনের অর্থায়নের সুবিধা রয়েছে (পায়রা), এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বচ্ছ উন্নয়ন অর্থায়ন (বে টার্মিনাল) এবং চট্টগ্রামে কৌশলগত আগ্রহ প্রকাশ করেছে । এই বন্দর প্রতিযোগিতার ফলাফল বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রাথমিক সারিবদ্ধতাকে সংজ্ঞায়িত করবে।
শক্তি: RNP রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী, স্থির নোঙর হিসাবে রয়ে গেছে, কিন্তু এর কার্যক্রম এখন মার্কিন আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে ।
৭.২ হেজিং কৌশলের গতিপথ এবং ঝুঁকি
বাংলাদেশের হেজিং কৌশল উচ্চ মাত্রার বাহ্যিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকিগুলি মূলত দেশের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রকল্পগুলির উপর প্রভাব ফেলে।
সারণি ২: বাংলাদেশের মূল কৌশলগত প্রকল্প ২০২৫: অবস্থা ও সংশ্লিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি
প্রকল্পের নাম | প্রধান পৃষ্ঠপোষক(গণ) | ২০২৫ সালের অবস্থা/মাইলফলক | সংশ্লিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক/আর্থিক ঝুঁকি |
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (RNP) | রাশিয়া (রোসাটম) | ট্রায়াল রান ডিসেম্বরের জন্য নির্ধারিত | মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঋণ পরিশোধ/ভেন্ডর ট্রান্সফার আটকে দিচ্ছে ; নিষেধাজ্ঞার এড়ানোর খরচ সার্বভৌমভাবে শোষণের ঝুঁকি। |
বে টার্মিনাল গভীর সমুদ্র বন্দর | বিশ্বব্যাংক/মার্কিন প্রভাব | $৬৫০ মিলিয়ন অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত (এপ্রিল ২০২৫) | চীনা/ভারতীয় বন্দর স্বার্থের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা; তহবিলের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে শক্তিশালী শাসনের প্রয়োজন। |
মংলা বন্দর টার্মিনাল পরিচালনা | ভারত/বাংলাদেশ | ভারত অপারেশনাল অধিকার সুরক্ষিত করেছে (২০২৪); ট্রানজিট ব্যবহারের কারণে সক্ষমতায় চাপ | বন্দর যানজটের কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘর্ষণের ঝুঁকি; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি একই সাথে প্রবেশাধিকার চায় তবে সম্ভাব্য কৌশলগত ঘর্ষণ । |
চেংদু জে-১০সিই সংগ্রহ | চীন/বাংলাদেশ | পরিকল্পিত প্রধান প্রতিরক্ষা সংগ্রহ | ভারতের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি; প্রযুক্তিগত লক-ইন এবং সম্ভাব্য পশ্চিমা অংশীদারদের সাথে আন্তঃকার্যকারিতা হ্রাসের ঝুঁকি। |
পায়রা বন্দর অর্থায়ন | চীন/বাংলাদেশ | $৫৬৪.৮৮ মিলিয়ন ঋণ সোনালী ব্যাংক/সরকারের মাধ্যমে চালিত | ঋণ ঝুঁকি অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে আত্মীকৃত; যদি প্রকল্পের আয় কঠোর সাত বছরের পরিশোধের সময়সূচী পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তবে উচ্চ দুর্বলতা। |
১. সারিবদ্ধতা বিচ্যুতি (Alignment Drift): মার্কিন নিরাপত্তা চুক্তি (ACSA/GSOMIA) চূড়ান্ত করার চাপ এবং ভারতীয় লজিস্টিকসের গভীর আঞ্চলিক উপস্থিতি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বহুমুখীকরণ সত্ত্বেও তার নন-অ্যালাইনড আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য করতে পারে।
২. নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ: RNP-তে ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি বজায় রাখার জন্য ঢাকাকে শক্তিশালী, নিষেধাজ্ঞা-প্রতিরোধী আর্থিক প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতের সম্পদকে সরিয়ে দেবে 1 ।
৩. নির্বাচন-পরবর্তী পুনর্মূল্যায়ন: আসন্ন ২০২৫/২০২৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে যে নতুন প্রশাসন পূর্ববর্তী চুক্তিগুলি (বিশেষ করে সার্বভৌমত্ব-compromise বলে বিবেচিত যেমন বন্দর অ্যাক্সেস বা উচ্চ-ঝুঁকি ঋণ) মেনে চলবে, নাকি একটি মৌলিক পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করবে ।
৮. উপসংহার এবং সুপারিশমালা
৮.১ পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ ২০২৫ সালে নিজেকে এমন একটি অবস্থানে খুঁজে পেয়েছে যেখানে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সক্রিয় কৌশলগত বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আঞ্চলিক শক্তি (ভারত) এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন) প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করায়, হেজিং কৌশলটি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য, কিন্তু এটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা দ্বারা মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কৌশলগত অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি এবং মার্কিন আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সার্বভৌম ঋণ শোষণের চাপ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনকে সংকুচিত করছে। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বহুপাক্ষিক বন্দর প্রতিযোগিতা এবং শক্তির উৎসগুলির উপর রাশিয়ান নির্ভরতা এখন মার্কিন আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অধীন।
৮.২ নীতিগত সুপারিশমালা: স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার জন্য পরামর্শ
১. আর্থিক ঝুঁকি প্রশমন এবং RNP সুরক্ষা: RNP-এর জন্য রাশিয়ার সাথে লেনদেন সম্পন্ন করতে নিরপেক্ষ মুদ্রায় (যেমন চীনা ইউয়ান বা ভারতীয় রুপি, বা তৃতীয় পক্ষের দেশের মুদ্রা) একটি নিবেদিত, অ-সুইফট পেমেন্ট মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এটি রাশিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখে মার্কিন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা থেকে প্রকল্পটিকে আইনিভাবে সুরক্ষিত করবে ।
২. অবকাঠামো অগ্রাধিকার এবং ঘর্ষণ হ্রাস: ভারতীয় ট্রানজিট কার্গোর কারণে সৃষ্ট যানজট কমাতে চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবিলম্বে বিনিয়োগ করা উচিত । এটি নিশ্চিত করবে যে কৌশলগত সহযোগিতা যেন অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ঘর্ষণের উৎস না হয়ে ওঠে।
৩. নীতিগত সমন্বয় এবং স্বচ্ছতা: অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সুসংহত জাতীয় নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি কৌশল তৈরি করা অপরিহার্য । এই দীর্ঘমেয়াদী কৌশলটি অংশীদারদের কাছে স্পষ্টতা এবং বাজারে পূর্বাভাসযোগ্যতা নিশ্চিত করবে। চীনা অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঋণ স্বচ্ছতা এবং কঠোর পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার (যেমন বিশ্বব্যাংক) সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করা উচিত ।
৪. কৌশলগত সংযম বজায় রাখা: যদিও ACSA এবং GSOMIA পশ্চিমা প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রদান করে, তবে এই চুক্তিগুলির শর্তাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা উচিত যাতে লজিস্টিক এবং তথ্য সুরক্ষার শর্তাবলী বাংলাদেশের অ-সংলগ্ন নীতিকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত না করে । কৌশলগত স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখার জন্য সামরিক বহুমুখীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র:
1. Deciphering Hedging: A Comparative Analysis of the Foreign Policy Behaviour of Bangladesh, Nepal, and Sri Lanka – The Lakshman Kadirgamar Institute, https://lki.lk/publication/deciphering-hedging-a-comparative-analysis-of-the-foreign-policy-behaviour-of-bangladesh-nepal-and-sri-lanka/ 2. Bangladesh’s Foreign Policy Mistakes Since 1971: A Reappraisal – OpEd – Eurasia Review, https://www.eurasiareview.com/26022025-bangladeshs-foreign-policy-mistakes-since-1971-a-reappraisal-oped/ 3. Chittagong Port and the Great Game: U.S. Expansionist Strategy Targeting India’s Backyard., https://medium.com/@maan.jasbir/chittagong-port-and-the-great-game-u-s-expansionist-strategy-targeting-indias-backyard-c8087ca08ffb 4. World Bank, Bangladesh Sign $850 million Financing Package to Create Jobs, Boost Trade, Modernize Social Protection System, https://www.worldbank.org/en/news/press-release/2025/04/23/world-bank-bangladesh-sign-850-million-financing-package-to-create-jobs-boost-trade-modernize-social-protection-system 5. China Belt and Road Initiative (BRI) investment report 2025 H1, https://greenfdc.org/china-belt-and-road-initiative-bri-investment-report-2025-h1/ 6. Rooppur plant payment hurdle sticks with it | The Business Standard, https://www.tbsnews.net/economy/rooppur-plant-payment-hurdle-sticks-it-1097121 7. Experts raise concern over volatile performance of China-backed projects in Bangladesh, https://m.economictimes.com/news/international/world-news/experts-raise-concern-over-volatile-performance-of-china-backed-projects-in-bangladesh/articleshow/102695174.cms 8. Rooppur Nuclear Power Plant: How far along is Bangladesh’s biggest energy project?, https://www.tbsnews.net/explainer/explainer-what-you-need-know-about-rooppur-nuclear-plant-trial-run-1250566 9. China, India, and the United States in a Multipolar World, https://uscnpm.org/2025/09/17/chia-india-us-in-a-multipolar-world/ 10. India on Edge as Bangladesh Expands Global Defence Ties, https://www.bdmilitary.com/analysis/geopolitics-diplomacy/india-on-edge-as-bangladesh-expands-global-defence-ties/2972/ 11. Bangladesh: The Dilemmas of a Democratic Transition | International Crisis Group, https://www.crisisgroup.org/asia-pacific/bangladesh/bangladesh-dilemmas-democratic-transition 12. Bangladesh in 2025: Political and Economic Landscape Analysis – J.S. Held, https://www.jsheld.com/insights/articles/bangladesh-in-2025-political-and-economic-landscape-analysis 13. DGDP, https://dgdp.gov.bd/ 14. Pakistan’s DG Joint Staff Lt Gen Tabassum Habib Arrives in Bangladesh for High-Level Defence Visit, https://www.bdmilitary.com/analysis/geopolitics-diplomacy/pakistans-dg-joint-staff-lt-gen-tabassum-habib-arrives-in-bangladesh-for-high-level-defence-visit/2935/ 15. Belt and Road Economics: Opportunities and Risks of Transport Corridors – World Bank, https://www.worldbank.org/en/topic/regional-integration/publication/belt-and-road-economics-opportunities-and-risks-of-transport-corridors 16. Digital Connectivity in the Northeast: A Pillar of India’s Act East Policy, https://www.orfonline.org/expert-speak/digital-connectivity-in-the-northeast-a-pillar-of-india-s-act-east-policy 17. Strategic Analysis: India-Bangladesh Transportation Links – Columbia International Affairs Online, https://ciaotest.cc.columbia.edu/olj/sa/sa_99ths01.html 18. Chattogram Port sees dramatic surge in India trade as land routes dry up, https://www.hellenicshippingnews.com/chattogram-port-sees-dramatic-surge-in-india-trade-as-land-routes-dry-up/ 19. About Us – Office of Security Negotiations and Agreements – State Department, https://2021-2025.state.gov/bureau-of-political-military-affairs-office-of-security-negotiations-and-agreements-pm-sna/