‘বাংলা’ শব্দটির উৎপত্তি
‘বাংলা’ বা ‘বাংগালা’ শব্দটির সঠিক উৎপত্তিটি অজানা রয়েছে। সম্ভবত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এ অঞ্চলে বসবাসকারী দ্রাবিড় গোষ্ঠী ‘বঙ’ থেকে ‘বঙ্গ’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে ধারণা করা হয় যে অস্ট্রিক জাতির সূর্যদেবতা “বোঙ্গা” থেকে বঙ্গ কথাটির উদ্ভব হয়েছে। মহাভারত, ভারতীয় পুরাণ ও হরিবংশের মতে রাজা বলির বঙ্গ নামে এক ক্ষেত্রজ পুত্র ছিলেন যিনি প্রাচীন ‘বঙ্গ রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের নেসারী শিলালিপিতে প্রথম ‘বঙ্গলা’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে যেখানে ধর্মপালকে ‘বঙ্গলার রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একাদশ শতাব্দীতে বাংলা আক্রমণকারী চোল সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোলার নথি নিশ্চিত করে যে, সে সময় গোবিন্দচন্দ্র বাংলার শাসক ছিলেন। সেই নথিতে বাংলাকে “বাঙ্গালা-দেশ” বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাংলার বর্ষাকালের স্পষ্ট বর্ণনাস্বরূপ লিপিবদ্ধ রয়েছে যে,বাঙ্গালা-দেশ যেখানে কখনও বৃষ্টি থামেনা। সুলতান ইলিয়াস শাহ “শাহ-ই-বাঙ্গালাহ” নামক উপাধি গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকে সকল মুসলিম সূত্রেই বাংলাকে বাঙ্গালাহ বলা হয়েছে।
বর্তমান আধুনিক বাংলাদেশের কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশে বঙ্গ রাজ্য গঠিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের দুটি প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল বঙ্গ ও পুণ্ড্র।
প্রাক-ঐতিহাসিক বাংলা
অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে বাংলা সম্পর্কে কোন ধরণের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়; এ সময় বাংলায় ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েডদের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং তাদেরই মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের নাম ছিল বঙ্গ।
বাংলা বদ্বীপটি কয়েক সহস্রাব্দ ধরে ঘন জঙ্গল ও জলাভূমির দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলের একটি বড় অংশ সুদীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই স্থায়ী ছিল। এরপর মানুষের পদচারণায় জঙ্গলের ক্ষতি সাধিত হয়। তবে মানুষ ঠিক কবে প্রথম বাংলায় প্রবেশ করে সে ব্যপারে গবেষকদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। একদল গবেষক দাবি করেন যে, মানুষ ৬০,০০০ বছর আগে চীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছিল। অন্য আরেকটি দলের মতে; ১০০,০০০ বছর আগে এখানে একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ খুবই দুর্বল। এখানে নিওলিথিক ও ক্যালকোলিথিক যুগের মানুষের উপস্থিতির খুব একটা প্রমাণ মেলে না। ধারণা করা হয় যে, এই প্রমাণ না থাকার পেছনে নদীর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনই দায়ী। বাংলাদেশের জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান স্পৃশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশের জন্য উপযুক্ত নয়। পাথরের অভাবে প্রাচীন বাংলার মানুষ সম্ভবত কাঠ ও বাঁশের মতো উপকরণ ব্যবহার করত যা সময়ের সাথে সাথে টিকে থাকতে পারে নি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাংলাকে ব্যতিরেকে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের উপর চর্চা করছিলেন। আর যেসব প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাংলার ব্যপারে আগ্রহী ছিলেন, তারাও প্রাচীন নয়, বরং বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করেন।
বাংলা বদ্বীপে যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো পাওয়া গিয়েছে তার পুরোটাই এই বদ্বীপের চারপাশের পাহাড়গুলো থেকে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পূর্ব ভূখণ্ড বাংলার প্রাচীন লোকদের ব্যপারে তথ্য সরবরাহের সর্বোত্তম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। লালমাই, সীতাকুণ্ড এবং চাক্লাপুঞ্জিতে জীবাশ্ম কাঠ তৈরীর ব্লেড, স্ক্র্যাপার ও কুঠার আবিষ্কৃত হয়েছে যা বার্মা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত আবিষ্কারের অনুরূপ। এছাড়া উত্তর পূর্ব বাংলাদেশে বড় বড় প্রাগৈতিহাসিক পাথর পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রচলন ছিল। পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী কৃষি সমাজের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে একটি স্থির সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ফলে একদিকে যেমন শহর-নগর গড়ে উঠে, অন্যদিকে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও প্রাচীন রাজনীতিরও উদ্ভব হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা উয়ারী-বটেশ্বরে একটি বন্দর আবিষ্কার করেছেন যা প্রাচীন রোম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করত। তারা সেখানে মুদ্রা, মৃৎশিল্প, লোহার তৈরী প্রত্নসম্পদ, ইটের রাস্তা ও একটি দুর্গ আবিষ্কার করেছেন। আবিষ্কারগুলো প্রমাণ করে যে, অঞ্চলটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র, যেখানে লোহা গলানো এবং মূল্যবান পাথরের পুঁতির মতো শিল্প ছিল। স্থানটিতে মাটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। মাটি ও ইট প্রাচীর নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত। মাটির তৈরি সবচেয়ে বিখ্যাত পোড়ামাটির ফলকগুলো চন্দ্রকেতুগড় থেকে এসেছে এবং তা দেবতা, প্রকৃতি ও সাধারণ জীবনের দৃশ্য চিত্রিত করেছে। উয়ারি-বটেশ্বর এবং চন্দ্রকেতুগড়ে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) আবিষ্কৃত প্রাচীন মুদ্রাগুলোয় নৌকা চিত্রিত রয়েছে।
বাংলাদেশে সংগঠিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের NBPW যুগের (৭০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিদর্শন প্রকাশ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে লৌহ যুগের সংস্কৃতি প্রায় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় এবং ৫০০-৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। উত্তর ভারতের ১৬টি মহা রাজ্য বা মহাজনপদের উত্থান এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে এই যুগ বিরাজমান ছিল। প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চল, বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ বা প্রাচীণ বঙ্গ রাজ্য এই মহাজনপদগুলির অংশ ছিল, যা ষষ্ঠ শতকে সমৃদ্ধ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), মহাস্থান এবং ময়নামতীর মতো উন্নত শহর গড়ে উঠে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান শহরগুলো সমুদ্রতীরের পরিবর্তে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠতে দেখা যায়। মহাস্থান থেকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম লেখা একটি পাথরের শিলালিপি আবিস্কৃত হয় যা থেকে বোঝা যায় যে, স্থানটি মৌর্য সাম্রাজোর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। মহাস্থান তখন একটি প্রাদেশিক কেন্দ্র ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাকৃত ভাষায় লেখা এই শিলালিপিতে জরুরী পরিস্থিতিতে সরবরাহ মজুত করার আদেশ রয়েছে। শিলালিপিটির নাম মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি। বাংলা ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলীপ্তি ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর।
বাংলার প্রাচীন অঞ্চলগুলো হচ্ছে ভাগীরথী-হুগলী অববাহিকা, হরিকেল, সমতট, বঙ্গ ও বরেন্দ্র। বঙ্গ ছিল বাংলার মধ্যাঞ্চল, হরিকেল ও সমতট বাংলার পূর্বাঞ্চল এবং বরেন্দ্র ছিল বাংলার উত্তরাঞ্চল। স্থানগুলোর নাম এই ইঙ্গিত দেয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তিব্বতী-বার্মান, অস্ট্রো-এশীয় এবং দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলতেন। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা লক্ষণীয় হয়ে উঠে।
ভাষাগতভাবে, এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী হয়তো দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলত যেমন কুরুক্স, বা সম্ভবত অস্ট্রো-এশীয় ভাষায় কথা বলত যেমন সাঁওতাল। পরবর্তীকালে, তিব্বতী-বার্মানের মতো অন্যান্য ভাষা পরিবারের লোকেরা বাংলায় বসতি স্থাপন করে। সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল মগধের অংশ হিসেবে ইন্দো-আর্য সভ্যতার অংশ হয়ে উঠেছিল। নন্দ রাজবংশ হচ্ছে প্রথম ঐতিহাসিক রাষ্ট্র যা ভারতী-আর্য শাসনের অধীনে বাংলাদেশকে একত্রিত করেছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের উত্থানের পর অনেক পুরোহিত ধর্ম বিস্তারের জন্য এখানে বসতি স্থাপন করেছিল এবং মহাস্থানগড়ের মতো অনেক স্তম্ভ স্থাপন করেছিল।
তথ্য সূত্র: উকিপিডিয়া