হিন্দুধর্ম
ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক স্থানীয় ধর্মমত একত্রে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, লৌহযুগ থেকে ঘটতে থাকা ভারতের ধর্মবিশ্বাসের নানা বিবর্তন এই ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই মতের উৎস আবার ব্রোঞ্জযুগীয় সিন্ধু সভ্যতা ও তৎপরবর্তী লৌহযুগীয় বৈদিক ধর্ম।
আলাপচারিতা
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর পর ধীরে ধীরে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটলে বৈদিক ধর্মের নবজাগরণের রূপে ধ্রুপদি হিন্দুধর্মের উত্থান ঘটে। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত – হিন্দু দর্শনের এই ছয়টি প্রধান শাখার উদ্ভব ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। প্রায় একই সময়ে ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্ভব ঘটে শৈবধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের মতো একেশ্বরবাদী মতবাদগুলির।
ধ্রুপদী পৌরাণিক হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠালাভ করে মধ্যযুগে। আদি শংকরের অদ্বৈত বেদান্ত মতবাদও এই সময় প্রচারিত হয়। উক্ত মতবাদ বৈষ্ণব ও শৈব মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং স্মার্তধর্মের উত্থান ঘটায়। এর ফলে দর্শনের অবৈদান্তিক শাখাগুলির অবলুপ্তি ঘটে।
বিংশ শতাব্দীতে অনাবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় সংগঠিত হয়। ১৯৮০-এর দশকে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সত্ত্বারূপে আত্মপ্রকাশ করে। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন থাকে এবং ২০০৬ সালে দক্ষিণ ভারতে (কর্ণাটক রাজ্যে) প্রথম রাজ্য সরকার গঠন করে।
হিন্দুধর্মের ভিত্তিমূল
যদিও পৌরাণিক কালপঞ্জি হাজার হাজার বছরের একটি বংশবৃত্তান্ত উপস্থাপন করে, পণ্ডিতরা হিন্দুধর্মকে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ বা সংশ্লেষণ হিসেবে বিবেচনা করেন। এর মধ্যে শিকড় হল ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্ম, নিজেই ইতিমধ্যেই “ইন্দো-আর্য এবং হরপ্পান সংস্কৃতি এবং সভ্যতার একটি সংমিশ্রণ” যা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও আদর্শে বিকশিত হয়েছে। লৌহ যুগের উত্তর ভারতের কুরু রাজ্য; কিন্তু এছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতের শ্রমণ বা ত্যাগকারী ঐতিহ্য এবং মেসোলিথিক এবং ভারতের নিওলিথিক সংস্কৃতি, যেমন সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম, দ্রাবিড় ঐতিহ্য, এবং স্থানীয় ঐতিহ্য এবং উপজাতীয় ধর্ম।
এই হিন্দু সংশ্লেষণের উদ্ভব ঘটে বৈদিক যুগের পরে, ৫০০-২০০ BCE এবং c. 300 CE, দ্বিতীয় নগরায়নের সময়কালে এবং হিন্দুধর্মের প্রাথমিক ধ্রুপদী যুগে, যখন মহাকাব্য এবং প্রথম পুরাণ রচিত হয়েছিল। এই ব্রাহ্মণ্য সংশ্লেষণ শ্রামণিক এবং বৌদ্ধ প্রভাব এবং উদীয়মান ভক্তি ঐতিহ্যকে স্মৃতি সাহিত্যের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাঁজে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাফল্যের চাপে এই সংশ্লেষণের আবির্ভাব ঘটে। গুপ্ত শাসনামলে প্রথম পুরাণ রচিত হয়েছিল, যা “প্রাক-শিক্ষিত ও উপজাতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মূলধারার ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।” ধর্মশাস্ত্র এবং স্মৃতিগুলির মধ্যে।
উত্তর ভারত থেকে এই “হিন্দু সংশ্লেষণ”, এবং এর সামাজিক বিভাজন, দক্ষিণ ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ে, কারণ আদালত এবং শাসকরা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় শাসকদের দেওয়া জমিতে ব্রাহ্মণদের বসতি স্থাপনের সাহায্যে, জনপ্রিয় অ-বৈদিক দেবতাদের অন্তর্ভুক্তি এবং আত্তীকরণ, এবং সংস্কৃতীকরণের প্রক্রিয়া, যাতে ” উপমহাদেশ জুড়ে সমাজের অনেক স্তরের মানুষ তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে ব্রাহ্মণ্য রীতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখায়”। ধারণাগত ঐক্যের একটি মলিন পোশাক।”
এলিয়ট ডয়েচের মতে, ব্রাহ্মণরা এই সংশ্লেষণের বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিল। তারা দ্বিভাষিক এবং দ্বি-সাংস্কৃতিক ছিল, তাদের স্থানীয় ভাষা এবং জনপ্রিয় সংস্কৃত উভয়ই কথা বলত, যা সংস্কৃতি এবং ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য অতিক্রম করেছিল। তারা “গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ সংস্কৃতির মূলধারা এবং গ্রামের সংস্কৃতিকে মূলধারার পরিপ্রেক্ষিতে অনুবাদ করতে” সক্ষম হয়েছিল, যার ফলে স্থানীয় সংস্কৃতিকে একটি বৃহত্তর সমগ্রের মধ্যে একীভূত করে। বৈদিক এবং, অল্প পরিমাণে, স্মার্টস, ঐতিহ্যগত বৈদিক বিদ্যার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার সময়, একটি নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদের উদ্ভব হয়েছিল যা স্থানীয় এবং আঞ্চলিক দেবতাদের জন্য লিটানি রচনা করেছিল এবং এই স্থানীয় ঐতিহ্যের মন্ত্রী হয়ে ওঠে।
উৎপত্তি
হিন্দুধর্ম কবে, কোথায়, কার হাতে প্রথম উৎপত্তি হয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে এ ধর্মের উৎপত্তি স্থল এশিয়ার মাইনর অর্থাৎ আজকের তুরস্ক, ইরান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, রাশিয়ার অংশ বিশেষ, কাজাকিন্তান এই অঞ্চলের কোন এক স্থানে আর্য জাতির মাধ্যমে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩০০০ সালের মধ্যে এ ধর্মের উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয়। [২] তবে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তির নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমতে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে বড় অংশই এশিয়া মাইনরে আর্য জাতির মাধ্যমে এ ধর্মের উৎপত্তি বলে মত দিয়েছেন। [৩] তবে উৎপত্তি যেখানেই হোক আজকের হিন্দু ধর্মের বিকাশ অর্থাৎ পূর্ণতা এসেছে ভারতের মাটিতে এ বিষয়ে সবাই একমত। আর উৎপত্তির সময় এ ধর্মের নাম হিন্দু ছিলো না বরং বৈদিক বা সনাতন নামেই এ ধর্মের উৎপত্তি হয়। কালক্রমে সিন্ধু নদীর তীরে স্থায়ী ঘাটি গাড়ায় এ ধর্মের নাম ক্রমে হিন্দুধর্ম হয়ে যায়।
ভারতে আগমণ
ইতিহাসবিদদের মতে আর্যরা এশিয়া মাইনর থেকে প্রথমে ইরান (পারস্য) এবং পরে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫শ থেকে ২ হাজার সালের কাছাকাছি সময়ে ভারতে প্রবেশ করে। মূলত এই আর্য জাতিরাই হিন্দু ধর্মের পূর্ব পুরুষ বলে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মত প্রকাশ করেছেন। তারা আসার সময় সঙ্গে করে বেদ নামক একটি ধর্মগ্রন্থ সঙ্গে আনেন। এ ধর্মগ্রন্থকে ঐশ্বরিক (যা ঈশ্বর কর্তৃক নাজিল হয়েছে) বলে হিন্দু ধর্মাবলিদের বিশ্বাস। হাজার হাজার বছর পূর্বের হলেও এ গ্রন্থে এমন সব উপমা এবং শ্লোক রয়েছে যা ওই সময়ের মানুষের দ্বারা লেখা বা আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। এ কারণে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করা হয়। বেদ নামক ধর্মগ্রন্থের কারণে আর্য জাতিকে বৈদিক জাতি এবং হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়।
তবে আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, আর্য জাতি ভারতে প্রবেশ করার পর এখানকার ভূমিপুত্র দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক, কোল, মুন্ডাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্ষে আসে। বিশেষ করে আর্য পুরুষরা নারী সঙ্গীর অভাবে অনার্য নারীদের সঙ্গে একত্রে বসবাস শুরু করার কারণে আর্যদের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। আর এ কারণে এখন ভারত বা এর কাছাকাছি অঞ্চলে বসবাস করাদেরকে মিশ্র জাতির মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২ হাজার সালের দিকে আর্যরা প্রথম উত্তর ভারত দিয়ে প্রবেশ শুরু করে। কালক্রমে তারা দক্ষিণ, উত্তর পূর্ব ভারত এমনকি থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ, উত্তর পূর্ব ভারত এমনকি থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৌছাতে আর্যদের সময় লাগে পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। অর্থাৎ উত্তর ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৌছাতে আর্যদের আড়াই হাজার বছর সময় লেগেছে বলে মনে করা হয়। আর এই আর্যদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মও এই আড়াই হাজার বছরে উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত, উত্তর পূর্ব ভারত, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
তবে সব সময় যে আর্য জাতির মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম বিস্তৃত হয়েছে এমনটা নয়। আর্য থেকে ক্রমে যে মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়েছে এমনকি অনার্যরাও হিন্দু ধর্মে দিক্ষিত হয়ে পরে তারাও এ ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অর্থাৎ আর্যদের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিলো তা ক্রমে স্থানীদের ধর্ম হয়ে ওঠে এবং স্থানীয়রাই পরে তার প্রসারে কাজ করেন।
এছাড়া আর্যদের ভারতে প্রথম আগমণের সময় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫শ থেকে ২ হাজার সালে সেটি আরো নিশ্চিত হওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস থেকে। ব্রঞ্জ যুগের দ্রাবিড় জাতির এক অনন্য সৃষ্টি ছিলো এই সিন্ধু সভ্যতা। এ সভ্যতা ধ্বংস হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫শ থেকে ২ হাজার সালের কাছাকাছি সময়ে বলে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হয়েছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত সিদ্ধু সভ্যতার শূন্যস্থান পূরণে অন্য কোন জাতির সন্ধান না পাওয়ার কারণেও মনে করা হয় দ্রাবিড়দের শুন্যস্থান পূরণ করেছে তৎকালিন আর্যরা।
সাধারণত একটি সভ্যতার বিলুপ্তির পর সেখানে নতুন যে সভ্যতা গড়ে ওঠে সেই নতুন সভ্যতায় পুরাতন সভ্যতার অনেক ছাপ থাকে। সিন্ধু সভ্যতার অনেক কিছুই আর্য তথা হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করে। যার অনেক কিছু এখনো বিদ্যমান। এটিও নির্দেশ করে যে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫শ থেকে ২ হাজার সালের দিকেই আর্য জাতি তথা হিন্দু ধর্ম ভারতের মাটিতে প্রথম প্রবেশ করে।
প্রাক-বৈদিক ধর্মসমূহ (আ. ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বের আগপর্যন্ত)
প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম
ব্রোঞ্জযুগীয় সিন্ধু সভ্যতায় ভারতের প্রাগৈতিহাসিক ধর্মের নানা নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। এই সভ্যতার ধর্মবিশ্বাসে হিন্দুধর্মের অনুরূপ কিছু ধর্মীয় প্রথার সন্ধান মেলে। যেমন ধর্মীয় স্নান, শিবলিঙ্গের ন্যায় প্রতীকোপাসনা। একটি স্বস্তিক চিহ্নের সন্ধানও এখানে পাওয়া গেছে।
সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলিতে একাধিক পুরুষ ও নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। নারীমূর্তিগুলিকে “মাতৃকা দেবী”-র মূর্তি বলে উল্লেখ করা হলেও, অনেকেই এই বিশ্বাসের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন।
মহেঞ্জোদাড়োয় খননকার্য চালানোর সময় একটি সিলমোহরে “যোগী” বা “আদি-শিব” মূর্তি পাওয়া যায়। এই “পশুপতি” সিলমোহরে একটি উপবিষ্ট পশুপরিবৃত দেবতার মূর্তি লক্ষিত হয়। কোনো কোনো গবেষক এই মূর্তিতে হাঁটু মুড়ে কোলের উপর হাত রেখে বসার ভঙ্গিটির সঙ্গে যোগভঙ্গিমার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। সিলমোহরটির আবিষ্কর্তা স্যার জন মার্শালও এটিকে শিবের এক আদিরূপ বলে বর্ণনা করেছেন।তাঁরা এই মূর্তির বসার ভঙ্গিটিকে বলেছেন “যোগভঙ্গিমা”।
বৈদিক যুগ
বৈদিক ধর্ম ছিল প্রাচীন সানতনীদের বেদনির্ভর পবিত্র একটি ধর্ম। এরা ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইরানীয় মালভূমি থেকে হিন্দুকুশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে যায়।
হিন্দুধর্মের আদিতম ধর্মগ্রন্থ চার বেদ – ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এই গ্রন্থগুলি রচিত হয়। পল্লব ও গুপ্তযুগ পর্যন্ত এগুলি গুরুশিষ্য পরম্পরায় মৌখিক প্রথার মাধ্যমে প্রচলিত ছিল। এর পর থেকে মৌখিক প্রথার সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করার প্রথাও চালু হয়।
সিন্ধু সভ্যতা (আ. ৩৩০০–১৭০০ খ্রিস্টপূর্ব)
সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা (৩৩০০ – ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ; পূর্ণবর্ধিত কাল ২৬০০ – ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদ অববাহিকা। প্রথম দিকে এই সভ্যতা পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায় বিকাশ লাভ করে। পরে তা প্রসারিত হয় ঘগ্গর-হকরা নদী উপত্যকা ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলি, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান এবং বালোচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ছিল।
পূর্ণবর্ধিত সময়কালে এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা ছিল এই সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত নগরগুলির অন্যতম। ১৯২০-এর দশকে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এই শহরটি আবিষ্কৃত হয়। ১৯২০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে খননকার্য চলছে। ১৯৯৯ সালেও এই সভ্যতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী ও আবিষ্কৃত হয়েছে। মহেঞ্জোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
হরপ্পা ভাষা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হয়নি এবং এই ভাষার উৎস অজ্ঞাত। যদিও ইরাবতম মহাদেবন, অস্কো পারপোলা, এফ জি বি কুইপার ও মাইকেল উইটজেল প্রমুখ বিশেষজ্ঞেরা এই ভাষার সঙ্গে প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, এলামো-দ্রাবিড়ীয় বা প্যারা-মুন্ডা সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
দ্রাবিড়ীয় লৌকিক ধর্ম
প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্ম হিন্দু ধর্মের একটি অ-বৈদিক রূপ গঠন করেছিল যে তারা ঐতিহাসিকভাবেই ছিল বা বর্তমানে আগমীয়। আগমসমূহ মূলত বৈদিক নয়, এবং তা বৈদিক-উত্তর পরবর্তী গ্রন্থ, বা প্রাক-বৈদিক রচনা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আগম হল তামিল ও সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থের একটি সংগ্রহ যা মূলত মন্দির নির্মাণ ও মূর্তি তৈরির পদ্ধতি, দেবদেবীদের উপাসনা, দার্শনিক মতবাদ, ধ্যানমূলক অনুশীলন, ছয়গুণ আকাঙ্ক্ষা অর্জন এবং চার ধরণের যোগব্যায়ামের গঠন। হিন্দু ধর্মে রক্ষাকারী দেবতা, পবিত্র উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের উপাসনা পূর্ব-বৈদিক দ্রাবিড় ধর্মের বেঁচে থাকার পন্থা হিসাবেও স্বীকৃত। প্রথম দিকের বৈদিক ধর্মে দ্রাবিড় ভাষাগত প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এর মধ্যে অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য ইতিমধ্যে প্রাচীনতম জ্ঞাত ইন্দো-আর্য ভাষায় উপস্থিত রয়েছে, ঋগ্বেদের ভাষা (আ. ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব), এতে দ্রাবিড় থেকে নেওয়া এক ডজনেরও বেশি শব্দও রয়েছে। দ্রাবিড় প্রভাবের জন্য ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী হয় যখন আমরা সংহিতা থেকে পরবর্তী বৈদিক রচনার মধ্য দিয়ে এবং শাস্ত্রীয়-বৈদিক পরবর্তী সাহিত্যে প্রবেশ করে। এটি প্রাচীন দ্রাবিড় এবং ইন্দো-আর্যদের মধ্যে একটি প্রাথমিক ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ বা সংশ্লেষণের প্রতিনিধিত্ব করে যা ভারতীয় সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল।
বৈদিক সময়কাল (আ. ১৭৫০–৫০০ খ্রিস্টপূর্ব)
উৎসসমূহ
ঋগ্বেদীয় ধর্ম
বেদ
বেদ (সংস্কৃত: वेद veda, “জ্ঞান”) হল প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ তত্ত্বজ্ঞান-সংক্রান্ত একাধিক গ্রন্থের একটি বৃহৎ সংকলন। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। সনাতনরা বেদকে “অপৌরুষেয়” (“পুরুষ” দ্বারা কৃত নয়, অলৌকিক) এবং “নৈর্বক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য” (যা সাকার নির্গুণ ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় এবং যার কোনও রচয়িতা নেই মনে করেন।
বেদকে শ্রুতি (যা শ্রুত হয়েছে) সাহিত্যও বলা হয়। এইখানেই সনাতন ধর্মের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলির সঙ্গে বেদের পার্থক্য। কারণ, সনাতন ধর্মের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় স্মৃতি (যা স্মরণধৃত হয়েছে) সাহিত্য। প্রচলিত মতে বিশ্বাসী সনাতন ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, বেদ প্রাচীন ঋষিদের গভীর ধ্যানে প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রাচীনকাল থেকেই এই শাস্ত্র অধিকতর যত্নসহকারে রক্ষিত হয়ে আসছে। সনাতন মহাকাব্য মহাভারতে ব্রহ্মাকে বেদের স্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বৈদিক স্তোত্রগুলিতে বলা হয়েছে, একজন সূত্রধর যেমন নিপূণভাবে রথ নির্মাণ করেন, ঠিক তেমনই ঋষিগণ দক্ষতার সঙ্গে বেদ গ্রন্থনা করেছেন।
বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ২০৪৩৪টি।
বেদের সংখ্যা চার: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ।[৫১] প্রত্যেকটি বেদ আবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: সংহিতা (মন্ত্র ও আশীর্বচন), আরণ্যক (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম, যজ্ঞ ও প্রতীকী যজ্ঞ), ব্রাহ্মণ (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির উপর টীকা) ও উপনিষদ্ (ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনা)। কোনও কোনও গবেষক উপাসনা (পূজা) নামে একটি পঞ্চম বিভাগের কথাও উল্লেখ করে থাকেন।
ঋগ্বেদে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিক ধর্ম ও জরাথুস্ট্রবাদের যেন্দ আবেস্তা নামক ধর্মগ্রন্থ সঙ্গে ধর্মীয় উপাদানের প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য করেছে, যেমনঃ অহুর থেকে অসুর, দেইব থেকে দেব, আহুরা মাজদা থেকে একেশ্বরবাদ, বরুণ, বিষ্ণু ও গরুদ, অগ্নিপুজা, হোম নামক পানীয় থেকে সোম নামক স্বর্গীয় সুধা, ভারতীয় ও পারসিকদের বাকযুদ্ধ থেকে দেবাসুরের যুদ্ধ, আর্য থেকে আর্য, মিত্রদেব, দিয়াউসপিত্র দেব (বৃহস্পতি দেব), ইয়াস্না থেকে ইয়যোনা বা যজ্ঞ, নারীয়সঙ্ঘ থেকে নরাশংস, অন্দ্র থেকে ইন্দ্র, গান্দারেওয়া থেকে গন্ধর্ব, বজ্র, বায়ু, মন্ত্র, যম, আহুতি, হুমাতা থেকে সুমতি ইত্যাদি।
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় বেদ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। ভারতীয় দর্শনের যে সকল শাখা বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে এবং বেদকেই তাদের শাস্ত্রের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে, সেগুলিকে “আস্তিক” শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত, চার্বাক, আজীবক, বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি অন্যান্য শ্রামণিক শাখায় বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকৃত নয়। এগুলিকে “নাস্তিক” শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মতপার্থক্য থাকলেও শ্রামণিক ধারার গ্রন্থগুলির মতো বেদের বিভিন্ন স্তরের বিভাগগুলিতেও একই চিন্তাভাবনা ও ধারণাগুলি আলোচিত হয়েছে।
মহাজাগতিক ধারা
উপনিষদ
উপনিষদ (সংস্কৃত: उपनिषद्) হিন্দুধর্মের এক বিশেষ ধরনের ধর্মগ্রন্থের সমষ্টি । এই বইগুলিতে হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি আলোচিত হয়েছে । উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত । ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, উপনিষদ্গুলিতে সর্বোচ্চ সত্য স্রষ্টা বা ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে । উপনিষদ্গুলি মূলত বেদ-পরবর্তী ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক অংশের শেষ অংশে পাওয়া যায় । এগুলি প্রাচীনকালে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
উপনিষদ্ সাধারণভাবে “বেদান্ত” নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যাত হয় “বেদের শেষ অধ্যায়সমূহ বা শেষাংশ” হিসেবে। আবার বিকল্প একটি অর্থও করা হয়ে থাকে। সেটি হল “বেদের বিধেয় বা সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য” এছাড়া উপনিষদ সংখ্যা হল ১০৮ টি তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপনিষদ ১২টি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঐতরেয়, কঠ, কেন, ছান্দোগ্য, ঈশ, বৃহদারণ্যক, শ্বেতাশ্বতর, তৈত্তিরীয়, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য উপনিষদ। ব্রহ্ম (পরম সত্য) ও আত্মা (ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্ত্বা) উপনিষদের মূল উপজীব্য বিষয় এবং “তুমিই যে সেই আত্মা, তা জানা”ই হল গ্রন্থাবলির মূল বক্তব্য। ভগবদ্গীতা ও ব্রহ্মসূত্রের সঙ্গে মুখ্য উপনিষদ্গুলি (এই তিন শাস্ত্র একত্রে প্রস্থানত্রয়ী নামে পরিচিত) পরবর্তীকালের একাধিক বৈদান্তিক দার্শনিক গোষ্ঠীর ভিত্তি স্থাপন করে। এগুলির মধ্যে হিন্দুধর্মের দু’টি প্রভাবশালী অদ্বয়বাদী ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিকদের মতে, মুখ্য উপনিষদ্গুলি প্রাক্-বৌদ্ধ যুগ থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালের বিভিন্ন পর্বে রচিত হয়। অপর দিকে অপ্রধান উপনিষদগুলি মধ্যযুগ ও প্রাক্-আধুনিক যুগের রচনা। অবশ্য প্রতিটি উপনিষদের সঠিক রচনাকাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ কবি মার্টিন সেমোর-স্মিথ উপনিষদ্গুলিকে “সর্বকালের ১০০টি সবচেয়ে প্রভাবশালী বই”-এর তালিকাভুক্ত করেছেন। আর্থার শোপেনহাওয়ার, রালফ ওয়াল্ডো এমারসন ও হেনরি ডেভিড থোরো সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপনিষদ্গুলির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। গবেষকেরা উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে প্লেটো ও কান্টের দর্শনের মিল খুঁজে পান।
ব্রাহ্মণ্যবাদ
বৈদিক যুগের ধর্ম (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ অব্দ অথবা বৈদিক ধর্ম, বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা প্রাচীন হিন্দুধর্ম বা, প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম হল আধুনিক হিন্দুধর্মের আদি রূপ। ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্ম ও আধুনিক হিন্দুধর্মের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়।
চার বেদের মন্ত্র অংশে বেদের অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডের পদ্ধতি রক্ষিত আছে। এই অংশটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন পুরোহিতেরা। পূজার পদ্ধতি আধুনিক হিন্দুধর্মে অনেকাংশে অপরিবর্তিত থাকলেও, রক্ষণশীল শ্রৌতদের একটি অংশ এখনও মৌখিকভাবে স্তোত্র শিক্ষার পরম্পরা বজায় রেখেছে।
দ্বিতীয় নগরায়ন ও ব্রাহ্মণ্যবাদের পতন (আ. ৬০০-২০০ খ্রিস্টপূর্ব)
উপনিষদ ও শ্রমণ আন্দোলন
মৌর্য সাম্রাজ্য
মৌর্য্য সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: मौर्यसाम्राज्यम्) প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের একটি বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য ছিল। মৌর্য্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই সাম্রাজ্য ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র।
মৌর্য্য সাম্রাজ্য তৎকালীন যুগের অন্ততম বৃহত্তম সাম্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত, শুধু তাই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য কখনো তৈরী হয়নি। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য নন্দ রাজবংশ উচ্ছেদ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারপর মহান আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর পশ্চাৎ অপসারণের সুযোগে নিজ সামরিক শক্তিবলে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে জয় করে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই গ্রীক সত্রপগুলিকে পরাজিত করে মৌর্য্য সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত হয়। বর্তমান যুগের মানচিত্রের নিরিখে এই সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়, পূর্বে অাসাম, পশ্চিমে বালুচিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও বিন্দুসার এই সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত করেন এবং অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। অশোকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে মগধে শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে।
ব্রাহ্মণ্যবাদের পতন
বৈদিক প্রথার পুনর্জাগরণ
হিন্দু সংশ্লেষণ এবং ধ্রুপদী হিন্দু ধর্ম (আ. ২০০ খ্রিস্টপূর্ব – ১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
প্রাক-শাস্ত্রীয় হিন্দুধর্ম (খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ – ৩২০ খ্রিস্টাব্দ)
স্মৃতি
স্মৃতি (সংস্কৃত: स्मृति, IAST: Smṛti), বা সোজাসুজি ভাবে “যা মনে রাখা হয়”, হচ্ছে ঐতিহ্যগতভাবে রচিত কিন্তু ক্রমাগত সংশোধিত এক প্রকার হিন্দু শাস্ত্র যা একটি নির্দিষ্ট লেখক দারা রচিত হয়েছে বলে নির্দেশ করে এবং যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুখেমুখে প্রাচারিত এবং সংশোধিত হয়েছিলো। স্মৃতিকে সাধারণত অমৌলিক কাজ বলে ধরা হয় এবং হিন্দু দর্শনের মীমসঞ্জন শাখা বাদে অনান্য শাখায় স্মৃতিকে শ্রুতির তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়।
স্মৃতি সাহিত্য হচ্ছে বিভিন্ন বৈচিত্রময় গ্রন্থের এক বিশাল সংকলন। এই সংকলনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, যা ছয় বেদাঙ্গ (বেদের ঐচ্ছিক চর্চা) সীমাবদ্ধা নয়, মহাকাব্য ( মহাভারত ও রামায়ণ), ধর্মসূত্র এবং ধর্মশাস্ত্র (বা স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ), অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন পুরাণ, কাব্য বা কবি সাহিত্য, ব্যাপক ভাষ্য বা ব্যাখ্যা (বিভিন্ন শ্রুতি ও অ-শ্রুতি গ্রন্থের পর্যালোচনা ও মন্তব্য),এবং রাজনীতি, নৈতিকতা (নীতিশাস্ত্র), সংস্কৃতি, শিল্প ও সমাজ সম্পর্কে ব্যাপক নিবন্ধ(সারসংক্ষেপ)।
প্রত্যেক স্মৃতি পাঠকে বিভিন্ন সংস্করনে ও বিভিন্ন ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে স্মৃতিকে সবচেয়ে অবাধ বলে ধারণা করা হয় যা যে কেউ লিখতে বা পুনর্বিন্যস্ত করতে পারতো।
হিন্দু দর্শন
হিন্দু দর্শন বলতে বোঝায় প্রাচীন ভারতে উদ্ভূত একগুচ্ছ দর্শনের একটি সমষ্টি। মূল ধারার হিন্দু দর্শনের মধ্যে ছয়টি আস্তিক দার্শনিক শাখা (ষড়দর্শন) বিদ্যমান। এগুলি হল: সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত। প্রাচীন বেদকে জ্ঞানের প্রামাণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস রূপে সাধারণরূপে স্বীকার করা হয় ব’লে এ ষড়দর্শনকে আস্তিক দর্শনও বলা হয়।। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে আরও কয়েকটি দার্শনিক শাখার উদ্ভব ঘটেছিল যেগুলি বেদকে অস্বীকার করে কিছুটা একই ধরনের দার্শনিক ধারণা প্রচার করেছিল। এগুলিকে নাস্তিক দর্শন বলা হয়।ভারতীয় নাস্তিক দর্শনগুলি হল: বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, চার্বাক, আজীবক ও অন্যান্য।
সঙ্গম সাহিত্য
সঙ্গম সাহিত্য ধ্রুপদী তামিল সাহিত্যের একটি অংশ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত এই সাহিত্যধারা ৪৭৩ জন কবির রচিত ২৩৮১টি কবিতার এক সংকলন। এই কবিদের মধ্যে ১০২ জনের পরিচয় জানা যায় না। এই কবিতাগুলি যে সময়কালে রচিত হয় সেই সময়কালটিকে সাধারণভাবে সঙ্গম যুগ নামে অভিহিত করা হয়। সাহিত্য গবেষকদের মতে সহস্রাধিক বছর বিদ্যমান সঙ্গম কিংবদন্তির নামানুসারে এই সমগ্র সাহিত্যবর্গটি নামাঙ্কিত। সঙ্গম সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। এর উপজীব্য ছিল তামিল জাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা বিবরণ।
সঙ্গম সাহিত্যকারেরা ছিলেন তামিল কবি। তাদের মধ্যে ছিলেন সমাজের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির পুরুষ ও মহিলারাও। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংকলনে সংকলিত ও সম্পাদিত হয়ে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এই কবিতাগুলি। পরবর্তীকালে জনপ্রিয়তা হারালেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সি ডব্লিউ তামোতারামপিল্লাই ও ইউ ভি স্বামীনাথ আয়ার প্রমুখ পণ্ডিত কর্তৃক পুনরাবিষ্কৃত হয় এগুলি।
ভারতের “স্বর্ণযুগ” (গুপ্ত ও পল্লব সময়কাল) (আ. ৩২০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)
গুপ্ত ও পল্লব সাম্রাজ্য
গুপ্ত সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: गुप्त राजवंश, Gupta Rājavaṃśa) ছিল একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল। মহারাজ শ্রীগুপ্ত ধ্রুপদি সভ্যতা-র আদর্শে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গুপ্ত শাসকদের সময়/শাসনামলে ভারতে যে শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে দেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করতে সক্ষম হয়। গুপ্তযুগকে বলা হয় ভারতের স্বর্ণযুগ। এই যুগ ছিল আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, শিল্প, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম ও দর্শনের বিশেষ উৎকর্ষের যুগ; বর্তমান হিন্দু সংস্কৃতি মূলত এই যুগেরই ফসল।গুপ্ত যুুগের আমলে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা -এর অবির্ভাব হয়েছিলো। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ সম্রাট তার সাম্রাজ্য সীমা দক্ষিণ ভারতেও প্রসার লাভ করে।
পল্লব সাম্রাজ্য দক্ষিণ ভারতের একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য। খ্রিস্টীয় ২য় থেকে ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতনের পর পল্লবদের উত্থান ঘটে। পল্লব শাসকেরা আগে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সামন্ত রাজা ছিলেন। এদের উৎস সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
ধ্রুপদী-পরবর্তী হিন্দু ধর্ম – পৌরাণিক হিন্দু ধর্ম (আ. ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
পৌরাণিক হিন্দুধর্ম
পুরাণ (সংস্কৃত: पुराण purāṇa, “প্রাচীনযুগীয়”) হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয়। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধৃবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।[১১১] পুরাণে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো দেবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তাতে ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রাবল্যও লক্ষিত হয়। এই গ্রন্থগুলি প্রধানত আখ্যায়িকার আকারে রচিত, যা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
লোকমতে, মহাভারত-রচয়িতা ব্যাসদেব পুরাণসমূহের সংকলক। যদিও পুরাণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঠগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিক বা অন্যান্য সূত্রাণুযায়ী এই সময়কাল ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণগ্রন্থগুলি ভারতের নানা স্থানে রচিত হয়েছিল। পুরাণের সামগ্রিক পাঠে কিছু সাধারণ ধারণা লক্ষিত হয়; কিন্তু একটি পুরাণের উপর অপর আরেকটি পুরাণের প্রভাব অন্বেষণ দুঃসাধ্য। তাই সাধারণভাবে এগুলিকে সমসাময়িক বলেই ধরে নেওয়া হয়।
লিখিত পাঠ্যগুলির রচনাতারিখ পুরাণের প্রকৃত রচনাতারিখ নয়। কারণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পূর্ববর্তী এক সহস্রাব্দ কাল ধরে এই কাহিনিগুলি মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে আসে। এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এগুলির আকার ও রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।
কাশীর মহারাজা ডক্টর বিভূতি নারায়ণ সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে অল ইন্ডিয়া কাশীরাজ ট্রাস্ট গঠিত হলে পুরাণ নিয়ে সুসংহত গবেষণার কাজ শুরু হয়। এই সংস্থা থেকে পুরাণের সমালোচনামূলক সংস্করণ এবং পুরাণম্ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
ভক্তি আন্দোলন
ভক্তি আন্দোলন মধ্যযুগীয় হিন্দু ধর্মে বিস্তার লাভ করা আস্তিক্যবাদী ভক্তিমূলক প্রবণতাকে বোঝায় এবং পরবর্তীতে শিখ ধর্ম গঠনে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে।[ এটি অষ্টম শতাব্দীর দক্ষিণ ভারতে (বর্তমানে তামিলনাড়ু এবং কেরালা) থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ১৫শ শতাব্দীর পর থেকে পূর্ব এবং উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৫শ শতাব্দীর এবং ১৭শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে।
অদ্বৈত বেদান্ত
অদ্বৈত বেদান্ত (সংস্কৃত: अद्वैत वेदान्त) বা অদ্বৈতবাদ হল বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী ধর্মচর্চার সাধন-পদ্ধতিগত একটি ধারা ।সর্বেশ্বরবাদী এ মতে, মানুষের সত্যিকারের সত্ত্বা আত্মা হল শুদ্ধ চৈতন্য এবং পরম সত্য ব্রহ্মও শুদ্ধ চৈতন্য। এ মতে উপনিষদগুলির একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাকর্তা হলেন আদি শঙ্কর। তবে তিনি এই মতের প্রবর্তক নন। পূর্বপ্রচলচিত অদ্বৈতবাদী মতগুলিকে তিনি সুসংবদ্ধ করেছিলেন।
পাশ্চাত্য প্রাচ্যবাদ ও দীর্ঘস্থায়ী দর্শন মতের প্রভাব, এবং ভারতের নব্য-বেদান্ত মত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর অদ্বৈত বেদান্তের প্রভাবের জন্য অদ্বৈত মতকে হিন্দু দর্শনের বেদান্ত শাখা ও সেগুলির সাধনপদ্ধতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালীমত মনে করা হয়। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে অদ্বৈতবাদী শিক্ষার প্রভাব দেখা যায়। ভারতীয় সংস্কৃতির বাইরেও অদ্বৈত বেদান্ত হিন্দু অধ্যাত্মবিদ্যার একটি সাধারণ উদাহরণ বলে বিবেচিত হয়।
বেদান্তের প্রতিটি শাখারই প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল প্রস্থানত্রয়ী (উপনিষদ্, ভগবদ্গীতা ও ব্রহ্মসূত্র)। অদ্বৈত মতে, এই বইগুলির দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
অদ্বৈত অনুগামীরা আত্মা ও ব্রহ্ম জ্ঞান সংক্রান্ত বিদ্যাবা জ্ঞানের সাহায্যে মোক্ষ লাভ করতে চান। এই মোক্ষ লাভ একটি দীর্ঘকালীন প্রয়াস। গুরুর অধীনে থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি লাভ করা সম্ভব।
আদি শঙ্কর (সংস্কৃত: आदिशङ्करः) (৭৮৮-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন একজন ভারতীয় দার্শনিক। ভারতীয় দর্শনের অদ্বৈত বেদান্ত নামের শাখাটিকে তিনি সুসংহত রূপ দেন। তার শিক্ষার মূল কথা ছিল আত্ম ও ব্রহ্মের সম্মিলন। তার মতে ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ।
আদি শঙ্কর অধুনা কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য বহুলাংশে দায়ী। শঙ্কর নিজে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত।এছাড়া তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের দশনামী সম্প্রদায় ও হিন্দুদের পূজার সন্মত নামক পদ্ধতির প্রবর্তক।
সংস্কৃত ভাষায় লেখা আদি শঙ্করের রচনাবলির প্রধান লক্ষ্য ছিল অদ্বৈত তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। সেযুগে হিন্দু দর্শনের মীমাংসা শাখাটি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতার উপর জোর দিত এবং সন্ন্যাসের আদর্শকে উপহাস করত। আদি শঙ্কর উপনিষদ্ ও ব্রহ্মসূত্র অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র ও ভগবদ্গীতার ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ মীমাংসা শাখার পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের সাংখ্য শাখা ও বৌদ্ধ দর্শনের মতও খণ্ডন করেন।
মধ্যযুগীয় এবং প্রথম দিকে আধুনিক সময়কাল (আ. ১২০০-১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)
মুসলিম শাসন
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম বিজয় শুরু হয় প্রধানত ১২শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে। তবে ৮ম শতাব্দীতে মুসলমানেরা রাজপুত সাম্রাজ্যে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে) কিছু কিছু হামলা চালিয়েছিল। দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম উপমহাদেশের বড় অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন যা ছিল তৎকালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে উত্তর প্রান্ত।
১৪ শতকে খিলজি বংশের, আলাউদ্দিন খিলজি তার সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণে গুজরাত,রাজস্থান ও দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং তুগলক রাজবংশ তাদের সীমানা তামিলনাড়ু পর্যন্ত বাড়ায়। কিন্তু দিল্লি সালতানাত ভেংগে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে অনেক গুলো নতুন সালতানাতে আবির্ভাব ঘটে, যার মধ্যে গুজরাত সালতানাত, মালওয়া সালতানাত, তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পথের অধিকারী বাংলা সালতানাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বে মুসলিম মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের অধিকাংশ রাজ্যকে দখল বা দমন করতে সক্ষম হয়। তবে কিছু প্রান্তিক রাজ্য তারা দখল করতে পারেনি, যেমন – হিমালয়ের উপরাংশে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরখণ্ড, সিকিম, নেপাল ও ভুটান; দক্ষিণ ভারতে ট্রাভাঙ্কর ও তামিলনাড়ু এবং পূর্বে আসামের আহোম সাম্রাজ্য।
হিন্দু ধর্ম একীকরণ
চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ খ্রিঃ – ১৫৩৩ খ্রিঃ) ছিলেন পূর্ব এবং উত্তরভারতের এক বহু লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। তিনি গৌড়বঙ্গের নদিয়া অন্তর্গত নবদ্বীপে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা) হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রীজগন্নাথমিশ্র ও শ্রীমতী শচীদেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বৈষ্ণব সমাজে তাঁকে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুুুগল প্রেমাবতার বলে মনে করা হয়। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছিলেন শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে ভক্তিযোগ ভাগবত দর্শনের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা ও প্রচারক। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণের রূপে পরম সত্ত্বার উপাসনা প্রচার করেন এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পর্যন্ত শ্রীহরি নাম ও ভক্তি এবং হরেকৃষ্ণ হরেরাম মহামন্ত্র যাহা শ্রীকলিসন্তরন উপনিষদের ও শ্রীপদ্মপুরাণের হরপার্বতী সংবাদে উল্লেখিত মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন।
মহামন্ত্র
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
রামানুজ (১০১৭-১১৩৭) ছিলেন একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক। তিনি শ্রী রামানুচার্য, উপাধ্যায়, লক্ষ্মণ মুনি নামেও পরিচিত। সাধারণভাবে হিন্দুরা তাকে হিন্দু দর্শনের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে দেখেন।
বৈষ্ণব আচার্য রামানুজাচার্যের শিষ্য রামানন্দ । যার শিষ্য ছিলেন কবির ও সুরদাস। রামানুজ বেদান্ত দর্শনের উপর ভিত্তি করে তাঁর নতুন দর্শন বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত রচনা করেছিলেন।বেদান্ত ছাড়াও রামানুজাচার্য সপ্তম-দশম শতকের মরমী ও ভক্ত আলওয়ার সাধুদের ভক্তি দর্শনের এবং দক্ষিণের পঞ্চরাত্র ঐতিহ্যের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন।
মধ্ব (সংস্কৃত: मध्वाचार्यः; সংস্কৃত উচ্চারণ: [məd̪ʱʋɑːˈtʃɑːrjə]) বা আনন্দতীর্থ বা পূর্ণ প্রাজ্ঞ (১২৩৮-১৩১৭) ছিলেন হিন্দু দর্শনের তত্ত্ববাদ দ্বৈত বেদান্তের প্রধান প্রবক্তা। তিনি ভক্তি আন্দোলনের সময়কালীন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিলেন।
পূর্ব গঙ্গা এবং সূর্য রাজ্য
পূর্ব গঙ্গা ও সূর্য ছিল হিন্দু ধর্ম-শাসিত অঞ্চল, যা বর্তমান ওড়িশার বেশিরভাগ রাজত্ব করেছিল (ঐতিহাসিকভাবে কলিঙ্গ নামে পরিচিত) একাদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১৬শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত শাসন করে। ১৩শ এবং ১৪শ শতাব্দীর সময়কালে, যখন ভারতের বিশাল অংশগুলি মুসলিম শক্তির অধীনে ছিল, তখন একটি স্বাধীন কলিঙ্গ রাজ্য হিন্দু ধর্ম, দর্শন, শিল্প এবং স্থাপত্যের একটি শক্তিশালী দুর্গে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব গঙ্গার শাসকরা ধর্ম ও কলা শিল্পের দুর্দান্ত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তারা যে মন্দিরগুলো তৈরি করেছিলেন তা হিন্দু স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাথমিক আধুনিক সময়কাল (আ. ১৫০০-১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)
বিজয়নগর সাম্রাজ্য
বিজয়নগর সাম্রাজ্য (কন্নড়: ವಿಜಯನಗರ ಸಾಮ್ರಾಜ್ಯ, Vijayanagara Sāmrājya; তেলুগু: విజయనగర సామ్రాజ్యము, Vijayanagara Sāmrājyamu) ছিল দক্ষিণ ভারতের একটি মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য। পর্তুগিজরা এই সাম্রাজ্যকে বিসনাগা রাজ্য নামে অভিহিত করে। ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে (প্রথম) হরিহর ও তার ভ্রাতা (প্রথম) বুক্কা রায় এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে ইসলামি আক্রমণ প্রতিহত করে এই সাম্রাজ্য নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।১৬৪৬ সাল পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। তবে ১৫৬৫ সালে দাক্ষিণাত্য সুলতানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত ঘটে। এই সাম্রাজ্য তার রাজধানী বিজয়নগরের নামে চিহ্নিত। বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পিতে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একটি বিশ্বঐতিহ্য স্থল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় পর্যটক ডোমিনগো পেজ, ফার্নাও নানস[১৫৪] ও নিকোলো ডি কন্টি প্রমুখের রচনা এবং স্থানীয় সাহিত্য থেকে এই সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। বিজয়নগরের শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে।
এই সাম্রাজ্যের নিদর্শন স্বরূপ নানা স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র দক্ষিণ ভারত জুড়ে। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবশ্যই হাম্পি। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন মন্দির নির্মাণশৈলীগুলির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল বিজয়নগর স্থাপত্য। এর হিন্দু নির্মাণশৈলীর মধ্যে সকল ধর্মবিশ্বাস ও স্থানীয় শৈলীগুলির মিলন ঘটেছিল। স্থানীয় গ্র্যানাইট পাথরে এই শৈলী গড়ে ওঠে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজকীয় স্থাপত্য নিদর্শনগুলিতে উত্তর দাক্ষিণাত্য সুলতানির প্রভাব সুস্পষ্ট। দক্ষ প্রশাসন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে এই সাম্রাজ্যে জলসেচের নতুন প্রযুক্তি আমদানি করা সম্ভব হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্য শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিল। কন্নড়, তেলুগু, তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যে এই সাম্রাজ্যের পৃষ্টপোষকতায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়। কর্ণাটকী সংগীত এই সাম্রাজ্যের রাজত্বকালেই তার বর্তমান রূপটি লাভ করে। দক্ষিণ ভারতে ইতিহাসে হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় সংহতি সাধনের মাধ্যমে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
মারাঠা সাম্রাজ্য
মারাঠা সাম্রাজ্য (মারাঠি: मराठा साम्राज्य) হল একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য, যা খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী হতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত (১৬৭৪ – ১৮১৮) ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র অংশ জুড়ে বিদ্যমান ছিলো। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্য পেশওয়ার অধীনে বহুগুণ বিস্তৃত হয়।বিস্তারের সর্বোচ্চ সময়ে এটি উত্তরে পেশোয়ার থেকে দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হলে ভারতে শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য হিসেবে মারাঠা সাম্রাজ্যকেই বিবেচনা করা হয়। ১৭৬১ সালে মারাঠারা পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হয় যা উত্তর দিকে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধ করে।এর ফলে উত্তরভারত কার্যত কিছুদিন মারাঠা সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও ১৭৭০ সালে উত্তরভারত আবার মারাঠাসাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পরবর্তীতে মারাঠা সাম্রাজ্য সম্রাটের অধীনে কেন্দ্রীয় ভাবে শাসিত হওয়ার পরিবর্তে পেশোয়াদের অধীনে বিভক্ত হয়ে যায় ও কনফেডারেসি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।১৮১৮ সালের মধ্যে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে মারাঠা সাম্রাজ্য চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করে।এর ফলেই কার্যত ভারতের উপর ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্রাজ্যের একটি বৃহৎ অংশ ছিল সমুদ্রবেষ্টিত এবং কানোজি আংরের মতো দক্ষ সেনাপতির অধীনস্থ শক্তিশালী নৌ-বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত। তিনি প্রতিপক্ষের, বিশেষত পর্তুগিজ ও ব্রিটিশদের নৌ-আক্রমণ সাফল্যের সাথেই প্রতিহত করেন।[১৫৫] সুরক্ষিত সমুদ্রসীমা এবং শক্তিশালী দুর্গব্যবস্থা মারাঠাদের সামরিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আধুনিক হিন্দু ধর্ম (১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে)
হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ, যা বাংলার নবজাগরণ হিসেবেও পরিচিত, এটি বলতে বোঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাবকে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সময়ে, যদিও এর পরেও বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অন্যন্য সমাহার যা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে।
স্বামী বিবেকানন্দ (বাংলা: [ʃami bibekanɒnɖo] , Shāmi Bibekānondo; ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ – ৪ জুলাই ১৯০২) নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত (বাংলা: [nɔrend̪ro nat̪ʰ d̪ɔt̪t̪o]), ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[১৫৬] অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন। ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, “আমেরিকার ভাই ও বোনেরা …,” ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।
ফ্রিডরিখ মাক্স মুলার (জার্মান: Friedrich Max Müller) (জন্ম: ৬ই ডিসেম্বর, ১৮২৩ – মৃত্যু: ২৮শে অক্টোবর, ১৯০০) ছিলেন বিখ্যাত ভারতবিশারদ, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক, সংস্কৃত ভাষায় সুপ্রসিদ্ধ জার্মান পণ্ডিত ও অনুবাদক। রুশ দার্শনিক আফ্রিকান আলেকসান্দ্রোভিচ স্পিরের ডেংকেন উন্ট ভির্কলিশকাইট (“চিন্তা ও বাস্তবতা”) শিরোনামের লেখা তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল।
শ্রী অরবিন্দ বা অরবিন্দ ঘোষ (১৫ আগস্ট ১৮৭২ – ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০) ভারতীয় বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, আধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক। তার পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ এবং মাতামহ রাজনারায়ণ বসু। অরবিন্দ ঘোষ বাল্যকালে ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ট্রাইপস পাস করেন। দেশে ফিরে এসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসের চরমপন্থী গ্রুপের নেতৃত্বে থাকাকালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে (১৯০৫–১৯১১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (তেলুগু ভাষায়: సర్వేపల్లి రాధాకృష్ణ; তামিল ভাষায়: சர்வேபள்ளி ராதாகிருஷ்ணன்), (৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ – ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭৫) স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘The Reign of Religion in Contemporary Philosophy’প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে।
হিন্দু পুনর্জাগরণ
অধিকাংশ হিন্দু সংস্কার আন্দোলনেরই সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। এই সকল আন্দোলনে প্রাচীন উপনিষদ ও বেদান্ত শাস্ত্রের এক নূতনতর ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয় এবং মনোযোগ দেওয়া হয় সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে। এই সকল আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতের তদনীন্তন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যের ধারণাকে খর্ব করা। এবং এই চেতনা থেকেই একটি দেশাত্মবোধক চেতনার সৃষ্টি হয়; যা থেকে জন্ম নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদর্শের।
স্বামীনারায়ণ ( ৩ এপ্রিল ১৭৮১ – ১ জুন ১৮৩০), সাহাজানন্দ স্বামী হিসাবেও পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন যোগী এবং একজন সন্ন্যাসী, যার জীবন ও শিক্ষা কেন্দ্রীয় হিন্দু প্রথাগুলির ধর্ম, অহিংসা এবং ব্রহ্মচর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি তার অনুসারীরা তাকে ঈশ্বরের পাঠানো দূত বলে বিশ্বাস করত।
১৭৮১ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের ছাপাইয়া গ্রামে স্বামীনারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৯২ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি নীলকান্ত বর্নি নামটি গ্রহণ করে ১১ বছর বয়সে সাত বছরের তীর্থযাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রার সময় তিনি নানা কল্যাণমূলক কার্যক্রম করেন এবং এই যাত্রার ৯ বছর ১১ মাস পর তিনি ১৭৯৯ সালে গুজরাত রাজ্যে বসতি স্থাপন করেন। ১৮০০ সালে তিনি তার গুরু স্বামী রমানন্দ দ্বারা উদ্ভাব সম্প্রদায়ের সূচনা করেন এবং তাকে নাম দেওয়া হয় সাহাজানন্দ স্বামী। ১৮০২ সালে তার গুরু তার মৃত্যুর পূর্বে উদ্ভাব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। সাহাজানন্দ স্বামী একটি আয়োজন করেন এবং “স্বামীনারায়ণ মন্ত্র” শিক্ষা দেন। এদিক থেকে তিনি স্বামীনারায়ণ নামে পরিচিত ছিলেন। উদ্ভাব সম্প্রদায় পরে স্বামীণারায়ন সম্প্রদায় নামে পরিচিতি পায়।
ব্রিটিশ রাজ্যের সাথে স্বামীনারায়ণ একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তার কেবল হিন্দু সম্প্রদায়েরই নয় বরং ইসলাম ও জরোস্ট্রিয়ানিজম এর অনেক অনুসারী ছিল। তিনি তার জীবদ্দশায় ছয়টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং তার দর্শন বিস্তারের জন্য ৫০০ পরমহংস নিযুক্ত করেছিলেন। ১৮২৬ সালে, স্বামীনারায়ণ সামাজিক নীতির উপর একটি বই শিক্ষাপত্রি লিখেছিলেন। ১৮৩০ সালের ১ জুন তার মৃত্যু হয় এবং গুজরাতের গাধারায় হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর পূর্বে, স্বামীনারায়ণ তার স্বামীনারায়ণ সমপ্রদায়ের দুটি অংশের দায়িত্ব পরিচালনা করার জন্য গৃহীত ভাতিজাদেরকে আচার্য হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। নারী ও দরিদ্রদের জন্য সংস্কারের জন্য এবং ব্যাপকভাবে অহিংস (অগ্নি উৎসর্গ) সম্পাদন করার জন্যও সমাজের মধ্যে স্বামীমারায়নকে স্মরণ করা হয়।
ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্মসভা ১৯ শতকে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন যা বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে পরিচিত। কলকাতায় ২০ আগস্ট, ১৮২৮ সালে হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও তার বন্ধুবর্গ মিলে এক সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ শুরু করেন। তাদের উপাস্য ছিল “নিরাকার ব্রহ্ম”, তাই থেকেই নিজেদের ধর্মের নাম রাখেন ব্রাহ্ম।
রামকৃষ্ণ পরমহংস রামকৃষ্ণ পরমহংস (সাহায্য·তথ্য) (১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬ – ১৬ই আগস্ট, ১৮৮৬; পূর্বাশ্রমের নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায় ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। তার প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তারা উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণের এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর হিন্দু নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। তার শিষ্যসমাজে, এমনকি তার আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন।
রামকৃষ্ণ পরমহংস গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি কালীর আরাধনা শুরু করেন।তার প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যাঁরা ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তার কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ তার ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের জনসমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্বমানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করে তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু দর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এরপর প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণের ধর্মীয় সমন্বয়বাদ ও “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্য স্থাপনা করেন রামকৃষ্ণ মিশন নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা। রামকৃষ্ণ আন্দোলন ভারতের অন্যতম নবজাগরণ আন্দোলনরূপে বিবেচিত হয়।২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠে অবস্থিত।
আর্য সমাজ (Sanskrit: आर्य समाज, ইংরেজি: ārya samāja “Noble Society”) বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য স্বামী দয়ানন্দ কর্তৃক ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি হিন্দু সংগঠন ও সংস্কার আন্দোলন। তিনি একজন বেদ প্রচারক সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। এই আদর্শের উপর জোর দিয়েছিলেন। আর্য সমাজের সদস্যগণ এই নীতিই মেনে চলেন। তারা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী অর্থাৎ তারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং মূর্তিপূজার বিরোধী।তাদের বিশ্বাস বেদোক্ত ব্রহ্মের উপর ।
পশ্চিমে অভ্যর্থনা
সমসাময়িক হিন্দু ধর্ম
হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের অধিকাংশেরই সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। এই সকল আন্দোলনে প্রাচীন উপনিষদ ও বেদান্ত শাস্ত্রের এক নূতনতর ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয় এবং মনোযোগ দেওয়া হয় সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে। এই সকল আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতের তদনীন্তন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যের ধারণাকে খর্ব করা। এবং এই চেতনা থেকেই একটি দেশাত্মবোধক চেতনার সৃষ্টি হয়; যা থেকে জন্ম নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদর্শের।
পশ্চিমে নব্য-হিন্দু আন্দোলন
পরমহংস যোগানন্দ (Pôromohôngsho Joganondo, সংস্কৃত : परमहंस योगानंद Paramahaṃsa Yogānaṃda; জন্ম: জানূয়ারি ৫, ১৮৯৩ – মৃত্যূ: মার্চ ৭ ১৯৫২) একজন ভারতীয় যোগী এবং গুরু। তিনি তার রচিত বই অটোবায়োগ্রাফি অফ এ যোগীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সমাজকে ধ্যান এবং ক্রিয়া যোগের শিক্ষা দিয়েছিলেন।
অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (ইংরেজি: Abhay Charanaravinda Bhaktivedanta Swami Prabhupada, সংস্কৃত: अभय चरणारविन्द भक्तिवेदान्त स्वामी प्रभुपादः, IAST: abhaya-caraṇāravinda bhakti-vedānta svāmī prabhupāda) (১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬ – ১৪ নভেম্বর, ১৯৭৭) ছিলেন একজন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগুরু এবং ইসকন বা হরেকৃষ্ণ আন্দোলনেরপ্রতিষ্ঠাতা-আচার্য। তিনি নিজে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর শিষ্য ছিলেন। হিন্দুধর্মের গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তার জীবনের উদ্দেশ্য।
হিন্দুত্ব (দেবনগরী: हिन्दुत्व, “Hinduness”) হল হিন্দুদের কর্তৃত্ব এবং জীবন ধারণে হিন্দু রীতিনীতি অবলম্বনের লক্ষ্যে পদক্ষেপসমূহ। হিন্দুত্ব শব্দে কোন উপাসনা পদ্ধতি কে বোঝায় না। এটি একটি জীবনশৈলী। একটি সংস্কৃতি যা এদেশে যুগ যুগান্তর ধরে প্রচলিত আছে।।হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক বিনায়ক দামোদর সাভারকর, ’হিন্দুত্ব’ শব্দটির উদ্ভাবন করেন একথা সর্বৈব ভ্রান্ত। ভারতের প্রতিটি সন্তান রাষ্ট্রীয়তার দৃষ্টিতে হিন্দু। তাই ভারত হিন্দুরাষ্ট্র। এদেশের জনগনের মধ্যে রাষ্ট্রভক্তি, নৈতিকতা, সচ্চরিত্রতা, সদাচার, ধর্মনিষ্ঠাতা (চিরন্তন সত্যনিষ্ঠতা) ও প্রতিকারপরায়ণতা ইত্যাদি গুণাবলির বিকাশকরে; সংগঠিত সশক্ত জাগ্রত সমাজের দ্বারা এদেশের রাষ্ট্রোত্থান সম্ভব। এবং তার দ্বারা জগৎ কল্যাণ সাধিত হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও বিশ্বাস করে যে এদেশের মানুষের নিজস্ব উপাসনা পদ্ধতির স্বতন্ত্রতা, খাদ্যাভ্যাস ও প্রধানের স্বতন্ত্রতা, বিচার ও চিন্তন এর স্বতন্ত্রতা ইত্যাদির বিবিধতার মধ্যে এদেবের চিরন্তন একাত্মতাই হিন্দুত্ব। এদেশের পবিত্রতার ধারনার সাথে যুক্ত তিনিই হিন্দু। যিনি এদেশের ভূমি, নদ নদী, পাহাড় পর্বত, প্রাণ ও উদ্ভিদ সকল কে, তীর্থরাজি, পতিত্র গ্রন্থরাজিকে সম্মান করেন ভালো বা এন নিজের মনে করেন তিনিই হিন্দু। এই হিন্দুত্ব পারে বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে। সমগ্রবিশ্বকে লালন করতে পালন করতে।
৪ মন্তব্য
Магазин дорогой элитной мебелиСалон элитной мебели – мы откроем для Вас двери в мир доступной роскоши!
Мы уже 10 лет занимаемся реализацией добротной, экологически чистой и безопасной мебели в России https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/d1-1.html
Каждый посетитель нашего сайта найдет для себя подходящий вариант, соответствующий его вкусовым предпочтениям и финансовым возможностям https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/stol-model-s-1.html
Профессионализм https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/komodi-i-tualetnie-stoliki-ot-15-000-rub/kts-18.html
Наша компания на рынке более 12 лет https://www.legnostyle.ru/proizvodstvo/dveri-iz-dereva/mejkomnatnie/?PAGEN_1=5
Работает с 20 https://www.legnostyle.ru/catalog/lestnici/na-vtoroy-etazh/lestnica-l8-10.html
02 https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/arka-a11.html
2002 года https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/diverso/mejkomnatnaya-dver-d42.html
Мы не интернет магазин, мы Компания http://www.legnostyle.ru/catalog/lestnici/derevannie-marsevie-lestnici-s-plohadkami/lestnica-l1-3.html
У нас свой отдел инженеров, мы решаем многоцелевые задачи, по оснащению объектов разными видами слаботочного оборудования, а также разными видами связи (интернет, тв, сигнализация, усиление связи, видеонаблюдение, телефония, и т https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/d-peregorodki/arka-a2.html
д https://www.legnostyle.ru/catalog/inter-eri/peregorodki/arka-a22.html
)
Выбор материалы для производства кухонь такого класса широк: массив дерева ценных и экзотических пород, нержавеющая сталь, закаленное стекло и др https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/diverso/mejkomnatnaa-dver-d31.html
Технологии, используемые при производстве, гарантируют не только исключительный внешний вид, но и надежность https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/mebel-dla-domasnei-biblioteki/b-1.html
Об этом сообщает агентство Синьхуа, ссылаясь на Синьцзянский институт археологии и культурных реликвий https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/komodi-i-tualetnie-stoliki-ot-15-000-rub/kts-1.html
Площадь участка, на котором добывали бирюзу, составляет более 8 квадратных километров http://www.legnostyle.ru/catalog/lestnici/?PAGEN_1=3
Российские импортёры сельскохозяйственной продукции активно закупают овощи и фрукты в Китае https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/iz-dyba/?PAGEN_1=20
Ожидается, что объём сделок в ближайшее время достигнет 7,25 млн долларов https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/d-peregorodki/a-40.html
Самые читаемые записи
Оригинальный дизайнерский проект https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/mejkomnatnaa-dver-d11.html
У моделей всегда присутствует новая идея https://www.legnostyle.ru/catalog/inter-eri/potolki/pt-31.html
Дизайнерская мебель всегда разрабатывается с учётом дизайн-проекта всего интерьера в целом, это обеспечивает единство стиля и гармонию https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/nestandarnye/
Современные тенденции показали нам, что элитная мебель из дерева стоит дорого, но зато она выполнена полностью из натурального экологически чистого дерева и имеет очень много преимуществ перед другими материалами https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/diverso/mejkomnatnaya-dver-d52.html
Такая мебель обеспечит нам комфорт, будет очень удобной и многофункциональной, и, будет иметь неповторимый дизайн http://www.legnostyle.ru/catalog/lestnici/?PAGEN_1=4
Все эти свойства вместила в себя элитная мебель из дерева https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/diverso/mejkomnatnaa-dver-d20.html
Такая мебель великолепно вписывается в любой роскошный интерьер, и, безусловно, будет выглядеть дорого, выделяя ваш изысканный вкус https://www.legnostyle.ru/lestnicy-iz-duba.html
Кухни из пластика — это, пожалуй, самый практичный вариант https://www.legnostyle.ru/catalog/lestnici/na-vtoroy-etazh/lestnica-l8-15.html
Судите сами: пластик без проблем моется, не выгорает, сохраняет свой первоначальный вид и сочные расцветки долгие годы, не выцветает https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/iz-massiva/
Рекомендуем!
Мы уже 10 лет занимаемся реализацией добротной, экологически чистой и безопасной мебели в России https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/arka-a36.html
Каждый посетитель нашего сайта найдет для себя подходящий вариант, соответствующий его вкусовым предпочтениям и финансовым возможностям https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/?PAGEN_1=21
Премиальные материалы https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/ottimo/mejkomnatnaa-dver-o2.html
В производстве изделий используются дорогие материалы: массив ценных пород дерева, алюминий, декоративное ударопрочное стекло, обивка мягких элементов выполняется из натуральной кожи https://www.legnostyle.ru/catalog/mebel/gostinnie/g-7.html
Готовые изделия отличаются прочностью и долговечностью, формируют вокруг себя атмосферу солидности и надежности https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/d-peregorodki/arka-a39.html
Достоинства мебели, представленной в салонах , несомненно, отметит тот, кто обладает тонким благородным вкусом и ценит совокупность стильного дизайна и необычайного комфорта https://www.legnostyle.ru/catalog/mejkomnatnie-dveri/perfetto/dver-p7.html
Услуги грузчиков для переезда офиса https://gruzchik-profi.ru/pereezdsklada
Всё отлично ! Ребятам, спасибо, что оперативно сработали https://gruzchik-profi.ru/takelajnieuslugi
Около часа до разгрузки оставалось, начал искать грузчиков https://gruzchik-profi.ru/takelajnieuslugi
Всё получилось https://gruzchik-profi.ru/kvartirnypereezfd
Успел https://gruzchik-profi.ru/
Это ооочень хорошо!
Узнать цену https://gruzchik-profi.ru/
Безопасность и сохранность имущества https://gruzchik-profi.ru/pereezdsklada
Никаких скрытых доплат после окончания https://gruzchik-profi.ru/kvartirnypereezfd
Мы полностью отвечаем за ваше имущество и мебель, что указано в договоре, который мы пришлем вам заранее https://gruzchik-profi.ru/
Перестановка мебели https://gruzchik-profi.ru/kvartirnypereezfd
Хакасия (15)
Кемеровская область (52)
Рейтинг в России https://www.vettorg.net/pharmacy/19/744/
Клиент приобрел базу : стоматологии https://www.vettorg.net/pharmacy/14/
Вызов врача 24/7 https://vettorg.net/pharmacy/96/1985/
Кошки https://www.vettorg.net/pharmacy/48/2085/