স্বামী নিগমানন্দ পরমহংস বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
নিগমানন্দ সরস্বতী হিন্দু ধর্মীয় গুরু ।
নিগমানন্দ সরস্বতী তার বাল্য নাম ছিল নলিনী কান্ত তার পিতার নাম ভুবন মোহন মাতার নাম মনিকা সুন্দরী দেবী নিগমানন্দ সরস্বতী মেহেরপুরের কুতুবপুর গ্রামে বাল্যকাল অতিবাহিত করেছেন।মাতা মনিকা সুন্দরী দেবীর মাতুলালয়ে রাধাকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন১২৮৬ সালে মতান্তরে ১২৮৭ । অপর এক তথ্যে পাওয়া যায় তাঁর জন্ম ১৮ ই আগস্ট ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ।
পরমহংস শ্রীমৎ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী দেব
নলীনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়
জন্ম১৮ আগস্ট ১৮৮০,কুতুবপুর, নদীয়া জেলা ভারত বর্তমানে মেহেরপুর জেলা বাংলাদেশ
মৃত্যু ২৯ নভেম্বর ১৯৩৫ (বয়স ৫৫)কোলকাতা
আখ্যা: পরমহংস, পরিব্রাজকাচার্য, সদগুরু
গুরু: বামাক্ষ্যাপা, সচ্চিদানন্দ সরস্বতী, সুমেরুদাসজী, গৌরী দেবী
দর্শন: তন্ত্র, জ্ঞান, বেদান্ত, যোগ, ভক্তি বা প্রেম
আলাপচারিতা
পিতা ভুবনমোহন চট্টোপাধ্যায় ও পিতার গুরু স্বামী ভাস্করানন্দ সরস্বতীর ইচ্ছানুসারে জন্মের পর নিগমানন্দের নাম রাখা হয়েছিল নলিনীকান্ত। ১৩০০ বঙ্গাব্দে যখন নলিনীকান্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছিল, তখন তার মাতা মাণিক্য সুন্দরী দেবী কলেরায় মারা যান যা তাকে বিষন্নতায় আচ্ছন্ন করেছিল।
১৩০১ বঙ্গাব্দে তিনি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাস করেন এবং মেহেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছু সময়ের জন্য পড়াশোনা করেন। ১৩০২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে তিনি জরিপ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। নলিনীকান্তের পিতা ১৩০৩ বঙ্গাব্দে হালিশহরের সুধাংশুবালা দেবী নামের এক ত্রয়োদশবর্ষীয়া বালিকার সাথে নলীনীকান্তের বিয়ে দেন।
১৩০৫ বঙ্গাব্দে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি রাণী রাসমণির এস্টেট দিনাজপুর জেলা বোর্ডে চাকরিতে যোগ দেন। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে ভাদ্র মাসের শেষে (বিয়ের প্রায় ৫ বছর পর) যখন তিনি নারায়নপুর এস্টেটে (জমিদারিতে) সুপারভাইজার পদে কাজ করছিলেন, তখন একদিন রাত্রে নলীনীকান্ত হঠাত্ টেবিলের নিকট সুধাংশুবালা দেবীর (যার সেই সময় কুতুবপুরে থাকার কথা) ক্রুদ্ধ ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকানো নীরব ছায়ামূর্তি দেখতে পান। তিনি তখনই কুতুবপুরে খোঁজ নিতে গেলেন এবং জানতে পারলেন যে নারায়নপুরে ছায়ামূর্তি দেখার ঠিক এক ঘণ্টা পূর্বে সুধাংশুবালা দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন; পুনরায় নলীনীকান্তের জন্য প্রচন্ড আঘাত। তিনি গুপ্ত/অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞানের (occult science) সাহায্যে তার সহধর্মিণীর নিকট পৌঁছানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন।
পরমহংস উপাধি প্রসংগ কথা
সিদ্ধি লাভের পর নিগমানন্দ এলাহাবাদে কুম্ভমেলা দেখতে গেলেন এবং জানতে পারলেন যে তার গুরু সচিদানন্দ শৃঙ্গেরী মঠের শঙ্করাচর্যের সাথে ঐ জায়গাতেই ছিলেন। গুরু সচিদানন্দকে দেখতে উদ্বিগ্ন নিগমানন্দ শঙ্করাচর্যের তাবুতে গেলেন যেখানে নিগমানন্দ গুরু সচিদানন্দসহ আরো ১২৫ জন সাধু পরিবেষ্টিত অবস্থায় মঠের অধ্যক্ষকে একটি উচ্চাসনে আসীন অবস্থায় দেখতে পেলেন। গুরুকে দেখে নিগমানন্দ প্রথমে তার গুরুকে শ্রদ্ধা জানালেন এবং পরে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন অধ্যক্ষকে সম্মান জানালেন।
সাধুগন প্রথমে অধ্যক্ষকে সম্মান না জানানোয় অসন্তুষ্ট হলেন কিন্তু প্রতি উত্তরে নিগমানন্দ এই শ্লোক উদ্ধৃত করেন: “মনাথরো শ্রী জগন্নাথ মদগুরু শ্রী জগদগুরু মহাত্মা সর্বভূতাত্মা তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ”। – “আমার স্রষ্টা মহাবিশ্বের স্রষ্টা। আমার গুরু সমগ্র বিশ্বের গুরু। স্বীয় সত্তা সকল সত্তার সত্তা, সেই হেতু আমি বশ্যতা স্বীকার করি আমার গুরুর যিনি আমাকে এটি দেখিয়েছেন।” এই উক্তি আরো ব্যাখ্যা করে যে বেদান্ত দর্শনানুসারে “গুরু” (শ্রী সচিদানন্দ সরস্বতী) এবং “জগদগুরু” (শ্রী জগদগুরু শঙ্করাচর্য) এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । নিগমানন্দ আরো পরিষ্কার করেন যে, যদি তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকতো তার অর্থ হতো এই যে আমাদের মধ্যে স্বীকৃত আধ্যাত্ম দর্শনে কোন বিশ্বাস নেই এবং এটি যদি বিবেচনা করা হতো যে একজন অন্যজন থেকে বড় তাহলে তা আরো বড় উপসংহারে নিয়ে যেত যে পরবর্তী জনের চেয়ে আরো বড় কেউ থেকে থাকবেন । এভাবে অন্তহীন বাদানুবাদ চলতেই থাকতো। এই ধরনের সিদ্ধান্ত সর্বদাই বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী । আমার গুরু জগদগুরুর সাথে এক হয়ে গিয়েছিলেন যখন জগদগুরু কর্তৃক তাঁর উপর “গুরুগিরি” অর্পিত হয়েছিল; সেই হেতু তাদের মধ্যে পার্থক্য করা উচিত নয় । জগদগুরু এই উত্তর অনুমোদন করলেন এবং নিগমানন্দ আলোকপ্রাপ্ত অবস্থা অর্জন করেছেন বলে স্বীকৃতি দিলেন। জগদগুরু শঙ্করাচার্য সচিদানন্দকে ডাকলেন এবং তাকে বললেন যে তার শিষ্য ইতোমধ্যেই পরমহংস এর অবস্থা অর্জন করেছেন এবং তাকে এই উপাধি দেয়া উচিত। সচিদানন্দ তখন এই প্রস্তাব সাধু সম্মেলনে উথ্থাপন করলেন এবং নিগমানন্দকে পরমহংস উপাধিতে ভূষিত করলেন। এভাবে তার নাম হলো পরিব্রাজকাচার্য শ্রীমদ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী দেব।
স্বামী নিগমানন্দ ভারতীয় এবং বিদেশী উভয় ধরনের বিরাজমান বিভিন্ন আধ্যাত্মিক মতবাদ বা দর্শনের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ছিলেন এবং বিবেচনা করতেন যে সেগুলির প্রত্যেকটিই একটি উদ্দেশ্যকে পূরণ করে এবং স্তরীভূত আধ্যাত্মিক উপলব্ধির পুরা প্রকল্পের সাথে খাপ খায়। তিনি দেখান যে যদিও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মতবাদ পরম বাস্তবতাকে ব্যক্তি-চেতনা ও সার্বজনীন চেতনার অভেদের নিরিখে বিবেচনা করে, এটি বস্ত্তুগত সৃষ্টির গঠনকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যাখ্যা করে না যেটি, পক্ষান্তরে, সাংখ্য দর্শনের দ্বারা ব্যাখ্যাপ্রাপ্ত হয়। কিন্ত্তু পরে উল্লেখিতটি পরম বাস্তবতাকে বিবেচনা করে না। একইভাবে খ্রীষ্টধর্ম যেখানে ঈশ্বর সাধনার উপায় হিসেবে সেবা ও সমর্পণের উপর জোর দেয়, পূর্ব মীমাংসার ভারতীয় দর্শন সেখানে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সুখ লাভের জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের পরামর্শ দেয়।
জ্ঞানচক্র
স্বামী নিগমানন্দের দর্শনকৃত ও ছবির আকারে উপস্থাপনকৃত জ্ঞানচক্র ছক (আধ্যাত্মিক সৃষ্টিতত্ত্বের গোলক/বলয়) দিয়ে তিনি ক্ষুদ্র সৃষ্টি/মানুষ (দেহ) এবং মহাবিশ্বের মধ্যে খচিত/আন্তঃবোনা মানব চেতনার বিভিন্ন স্তর চিহ্নিত করেন এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিন্যাস/ক্রমের এবং উপদলের অভিকাঙ্খী শেষ পর্যন্ত কোন স্তরে পৌঁছতে পারেন তা নির্দেশ করেন। এই ছকে তিনি শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধাকে নির্গুণ ব্রহ্ম ও সগুণ ব্রহ্মের মধ্যবর্তী ক্রান্তিকালে রাখেন যেটিকে তিনি বলেন নিত্য বা ভবলোক।(যোগমায়া এক ধরনের দৈব শক্তি, যা পৃথিবীতে আবদ্ধ আত্মাসমূহকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আকর্ষণ করে এবং তাদেরকে সত্যিকারের পরম সুখময় প্রকৃতি উপলব্ধি এবং স্বর্গীয় ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করে।) এই ধারণাকে বিবেচনা করা হয় স্বামী নিগমানন্দের নিজের অন্তর্দৃষ্টি এবং অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার ক্রমবিকাশের দিকে তার এক অনন্য অবদান হিসেবে।
স্বামী নিগমানন্দ পরমহংস অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
আধ্যাত্মিকভাবে মুক্ত হওয়ার জন্য একজন মুক্ত মানুষ (একজন সৎগুরু বা শুধু গুরু) এর সাহায্য প্রয়োজন। হিন্দু শাস্ত্রসমূহে সেই ব্যক্তিকে সৎগুরু হিসেবে পরিচিত। তার অনুগ্রহ বা আনুকূল্য ব্যতীত কেউ মুক্তির পথে কোনো অগ্রগতি করতে পারে না। আবার যিনি পরম বাস্তবতাকে (পরমাত্মা বা ব্রহ্ম) নিজের (আত্মা) সাথে একাত্ম হিসেবে অধিগত হয়েছেন তিনি গুরু।
গুরু যিনি কাউকে মুক্ত হতে সাহায্য করেন তাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, তীর্থ বা দেবত্বের গুরুত্বের সাথে সমান বিবেচনা করা যেতে পারে না। যদি আমরা তার নিকট গভীর ভক্তি এবং প্রেম নিবেদন না করি, তবে অন্য আর কে আমাদের পরম সম্মান পাওয়ার যোগ্য?
বেদান্ত যা শিক্ষা দেয় গুরু প্রকৃতপক্ষে তার মূর্ত প্রকাশ – আত্মা এবং পরমাত্মা বা ব্রহ্ম একই।
একজন সৎগুরু কখনই কাউকে অভিশাপ দেন না। যদি তাকে রাগান্বিত বলে মনেও হয়, তবে তাও শিষ্যের মঙ্গলের জন্য। সৎগুরু উপর নির্ভরতার উপকারিতা অনন্য। এমনকি ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিও সমান উপকারিতা পান না কারণ ঈশ্বর কখনই নির্দেশনা দিতে বাস্তবে মূর্ত হন না। গুরু বাস্তবে শিষ্যকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
এক দিক দিয়ে গুরু এবং শিষ্য অবিচ্ছেদ্য। একজন সত্যিকারের শিষ্যের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের অংশ না হয়ে গুরু থাকতে পারেন না।
আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের দুটি পথ আছে: একটি হচ্ছে সন্ন্যাস যোগে দীক্ষাগ্রহণের ও কঠোরতা পালনের মাধ্যমে এবং অন্যটি – ব্রহ্ম উপলব্ধি লাভ করা সৎগুরুর প্রতি সেবা নিবেদনের মাধ্যমে। পূর্বোক্তটি অত্যন্ত দুঃসাধ্য/কষ্টকর একটি পথ – শিষ্যটিকে এক অর্থে দেহে থাকা অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। অন্য ভাবে বললে তাকে তার দেহ চেতনা ছেড়ে যেতে হবে। কিন্ত্তু কেউ যদি গুরুকে আন্তরিকভাবে সেবা নিবেদনের মাধ্যমে শর্তহীনভাবে তাকে ভালবাসে, তবে তার পক্ষে তুলনামূলকভাবে সহজে আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
গুরুর অনুগ্রহ ব্যতীত সারগর্ভ কিছুই অর্জন সম্ভব নয়। আমি আহত কণ্ঠস্বরওয়ালা পাখির মত ইতস্তত সর্বত্র ঘুরছিলাম কিন্ত্তু ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করতে আসছিলেন না। কিন্তু যেদিন আমি গুরুর (যিনি মানব রুপে ঈশ্বর) অনুগ্রহ কিংবা কৃপা লাভে সমর্থ হলাম, সেদিন আমি প্রকৃত উন্নতি করতে শুরু করলাম।
গুরু, দীক্ষাগ্রহণের সময় তার দেয়া ‘মন্ত্র’, এবং শিষ্যের পছন্দকৃত দেবতা (বা ইষ্ট) এক। যদি গুরু পছন্দকৃত দেবতা/ইষ্টে পরিণত না হন, তবে তার থেকে পাওয়া মন্ত্র এর শক্তি হারিয়ে ফেলে।
দীক্ষাদানের মাধ্যমে শিষ্য অর্জন গুরুর পেশা নয়; এটি তার হৃদয়ের অনুপ্রেরণা। গুরু শিষ্যকে দীক্ষা দেন, যত্ন নেন এবং তাকে পথ দেখান এই আশায় যে শিষ্য আধ্যাত্মিকভাবে আলোকপ্রাপ্ত বা অজ্ঞতামুক্ত হবে।
সাহিত্যে নিগমানন্দ সরস্বতী
প্রকাশিত বই সমূহ: নিগমানন্দ সরস্বতী ‘সুধাংশু বালা’ একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায় হিন্দু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে লেখা ‘ব্রহ্মচর্য সাধন’ জ্ঞানী গুরু প্রথম প্রকাশকাল ১৩১৫ সাল, প্রেমিক গুরু ও তান্ত্রিক গুরু প্রথম প্রকাশকাল ১৩১৮, যোগী গুরু প্রথম প্রকাশকাল ১৩১২ সাল।