বাক্য ও বানানে বাক্য সতর্কতা
-মুন্সি আবু সাইফ
ভাষার সকল দিক পর্যালোচনা করে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন যে, বাংলা ভাষাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা। কারণ এ ভাষার রয়েছে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সুনিয়ন্ত্রিত কাঠামো। মহান ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে বাংলা বানান এবং বাক্যের প্রায়োগিক দিকটার প্রতি বিশেষ খেয়াল ও গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরী।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বাংলা বানান এবং বাক্য প্রয়োগে আমরা সীমাহীন উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের ভাষার উপর অশনি সংকেত নেমে আসতে পারে।বাংলা বানানের কিছু মৌলিক বিষয়ে এমন ভয়াবহ ভুল বানান লেখা হচ্ছে যা ভাবতে গেলেও হতবুদ্ধি হয়ে পড়তে হয়। বাংলা একাডেমি ১৯৯১ সালে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নির্ধারণ করে দিয়েছে। একই সাথে প্রতিষ্ঠানটি ‘বাংলা বানান-অভিধান’ প্রকাশ করেছে। আমার জানা মতে, বানান নির্ধারণে এমন ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস বিশ্বে কোথাও পরিলক্ষ হয় না। তারপরও আমাদের উদাসীনতা আমাদেরকে আত্মঘাতি করে তুলছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, বানান যাই হোক আমরা যদি বাক্য বুঝাতে সক্ষম হয় তাহলে ক্ষতি কোথায়? সমস্যা আছে। কারণ, বাংলা ভাষায় অসখ্য সমুচ্চারিত শব্দ আছে। যে শব্দগুলোর বানান পার্থক্যের কারণে সম্পূর্ণ অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন ‘স্মরণ’ শব্দটির অর্থ ‘মনে করা’। কিন্তু ‘শরণ’ শব্দটির অর্থ ‘আশ্রয়স্থল’। শুধু বানান পার্থক্যের কারণে শব্দ দুটির অর্থ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়।
বাংলা একাডেমি সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে, বিদেশী শব্দের বানানে অবশ্যই-ই-কার লিখতে হবে এবং বিদেশী শব্দের বানানে অবশ্যই ণ-ত্ব- বিধান ত্যাগ করতে হবে কিন্তু আমরা হরহামেশায় নার্সারী, জানুয়ারী, কলোনী, ইংরাজী- ইত্যাদি ভুল বানান লিখে যাচ্ছি। সেদিন একজন ব্যাক্তি আমার কাছে জানতে চাইলেন টুর্নামেন্ট বানান কি হবে । আমি বানানটা বলে দিলাম এবং ব্যাখ্যা দিলাম, বিদেশী শব্দের বানানে ণ-ত্ব- বিধান হয় না। তিনি আমার কথা শুনলেন এবং ক্রেস্টে লিখলেন ফুটবল ‘টুর্ণামেন্ট’। আমি বিনয়ের সাথে ফোনে বললাম বানানটা ভুল। তিনি আমাকে অক্সফোর্ড থেকে শুরু করে হিল্লি দিল্লি সবই দেখালেন। তবু ভুল স্বীকার করলেন না। তর্ক আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।
বাংলা বাক্য প্রয়োগেও আমরা অসখ্য ভুল বাক্য লিখে থাকি তেমনি কথনের সময়ও অসংখ্য ভুল ্বাক্য বলে থাকি। কিছু মৌলিক বাক্য গ্রয়োগে করে ফেলি অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি। যেমন, আমরা বলে থাকি ‘পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে’। বাক্যটি ভুল , হবে ‘পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে’। আমরা বলি ‘ধুমপান নিষেধ’ ‘মোবাইল ব্যবহার নিষেধ’- ভুল বাক্য। হবে, ‘ধুমপান নিষিদ্ধ’ ‘মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ’। আমরা বলি, ‘খাঁটি গরুর দুধ’। বাক্যটি ভুল। কারণ গরু সাধারণত খাঁটিই হয়। ভেজালপ্রিয় মানুষ দুধে ভেজাল দিতে ভালবাসে। তাই সঠিক বক্যে বলতে হবে ‘ গরুর খাঁটি দুধ’।বাংলা ভাষার উপর বিদেশী শব্দের প্রভাব অপরিসীম। বিশেষ করে, আরবি ভাষার শব্দ আমরা খুব বেশি ব্যবহার করে থাকি। মনে রাখা দরকার,আরবি ভাষার একটি সমৃদ্ধ ব্যাকরণ আছে। সেই ব্যাকরণে সুনির্দিষ্ট কাল বা টেন্স রয়েছে। আমাদেরকে কোন ব্যক্তি সালাম দিয়ে যদি জিজ্ঞাস করে, কেমন আছেন? আমরা আল্লার নাম নিয়ে বলি ‘ ইনশাল্লাহ ভাল আছি’। বাক্যটি ভুল। হবে,‘ আলহামদুলিল্লাহ’ ভাল আছি। কারণ ইনশাল্লাহ ভবিষ্যত কালজ্ঞাপক শব্দ। যিনি একবার হজ করেছেন তিনি হাজি। আমরা প্রায় বলি আলহ্াজ অমুক মিয়া। যিনি একের অধিক বার হজ করেছেন তাকেই সাধারণত বলা হয় ‘আলহাজ’।
এমনিভাবে আমরা ভাষা ব্যবহারে অসংখ্য ভুল বানান ও বাক্য লিখে যাচ্ছি। যা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের ভাষা আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। কোন রকম আত্মতুষ্টিতে মগ্ন থাকলে চলবে না। মনে রাখা দরকার সংস্কৃত ভাষা এক সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে দুনিয়া কাঁপিযে বেড়িয়েছে। যখন তারা তাদের ভাষার গায়ে আভিজাত্যের তকমা লাগিয়ে আত্মতুষ্টিতে মেতে থেকেছে তখনই তাদের ভাষার উপর সর্বনাশ নেমে এসেছে। এমন দুনিয়া কাঁপানো এবং সমৃদ্ধ সংস্বৃত ভাষা আজ পৃথিবীতে ‘মৃত ভাষা’ নামে পরিচিত।
আমাদের ভাষার মাহত্ম্য সমুন্নত রাখতে বানানে ও বাক্যে অবশ্যই যতœশীল হতে হবে। তা না হলে সংস্কৃত ভাষার মতো আমাদের ভাষাও একই পরিনতি বরণ করতে পারে।